।। মূল: ম্যারি এলিজাবেথ ব্র্যাডন, ভাষান্তর: অনিকেত সুর ।।
বাবাহারা ছোট্ট শিশুটি বড় হয়েছে কাকা উইলিয়ামের আদরে। সেই ছোট্ট ছেলেটি আজ টগবগে এক তরুণ। চিত্রকলার তুখোড় ছাত্র। যৌবন কত সুন্দর হতে পারে, ওকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। আশ্চর্য সুন্দর হবার পাশাপাশি ওর আছে আরও কিছু গুণ। বাকপটু, প্রাণোচ্ছল, বেপরোয়া এবং তারুণ্যের ক্ষেত্রে যা মানানসই, সংশয়বাদী। সেইসঙ্গে দুর্দান্ত এক পড়ুয়া। এরকম অবস্থায় সচরাচর যা ঘটে, তাই ঘটল। পতঙ্গ যেমন আগুনে ঝাঁপ দেয়, তেমনই ওর সৌন্দর্যের আগুনে ঝাঁপ দিল মেয়েটি। প্রেমে পড়ল ওর।
মেয়েটি আর কেউ নয়; স্বয়ং উইলিয়াম-দুহিতা গারট্রুড।
বয়স যখন আঠারো ছেলেটির, বিখ্যাত এক চিত্রকরের কাছে শিক্ষানবিশি শেষ ক’রে ফিরেছে, তখন থেকে ওদের মন দেওয়া-নেওয়া শুরু। গারট্রুড অবশ্য এই প্রেমের কথা ওর বাবাকে জানায় নি। কারণ, একমাত্র মেয়েকে কোনও ধনীঘরের ছেলের সাথেই বিয়ে দেবার ইচ্ছা তাঁর।
শহরতলীর সবচেয়ে রোমান্টিক জায়গাগুলিতে চলত ওদের অভিসার। বেড়ানোর জন্য ওরা বেছে নিয়েছিল দিনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলি। ঝলমলে রোদ-ওঠা সকাল, স্নিগ্ধ গোধূলি আর জোছনাফেনিল শুক্লাযামিনী, যখন প্রকৃতির সৌন্দর্য ফুটত সবচেয়ে মনোহর হয়ে — যুগলমনের বিহ্বল আনন্দে যে-সময়গুলি ছিল আরও রঙিন, আরও মনোহর।
একদিন সূর্য ডুবু ডুবু। একফালি চাঁদ উঠেছে আকাশে। দিন ও রাতের এরকম মুগ্ধ মিলনমুহূর্তে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ওরা বাগদানের কাজটি সেরে নিল। গারট্রুডের সরু সুন্দর অনামিকায় উঠল একটি চমৎকার আংটি, যার মালিক ছিল গারট্রুডের কাকীমা। সর্পাকৃতি আংটিটা দেখতে বেশ অদ্ভুতঃ একটি সোনালী সাপ কুণ্ডলি পাকিয়ে আছে। লেজের ডগাটি পুরে রেখেছে নিজ মুখের ভিতর। যে-কোনও প্রেমিকযুগলের কাছে এ হচ্ছে অনন্ত সম্পর্কের প্রতীক। বাগদানশেষে ওরা দু’জন একে অপরের প্রতি আজীবন বিশ্বস্ত থাকার শপথ নিল — সুখে-দুঃখে, দারিদ্র্যে-ঐশ্বর্যে যে কোনও অবস্থায় আমৃত্যু দু’জন দু’জনকে ভালবাসবে, কাছাকাছি থাকবে।
তরুণ প্রেমিকের কণ্ঠ গাঢ় আবেগে ভেজা। বলল, “মৃত্যুরও ক্ষমতা নেই, আমাদের আলাদা করতে পারে। আমি মরে গেলেও আমার আত্মা ঠিক কবর থেকে উঠে আসবে। ফিরে আসবে তোমার কাছে। আর যদি আমার আগে তুমি মারা যাও, প্রাণহীন মাটির কী এমন ক্ষমতা আমার কাছ থেকে তোমাকে লুকিয়ে রাখে! যদি আমাকে সত্যি ভালবাস, ফিরে তুমি আসবে নির্ঘাৎ। তোমার ঐ সুন্দর দু’টি হাত ঠিক এমনই ক’রে ভালবেসে আমার গলা জড়িয়ে ধরবে, শক্ত আলিঙ্গনে বাঁধবে আমাকে।”
গভীর নীল দ্যুতিময় পবিত্র চোখ দু’টি তুলে তাকাল গারট্রুড। সরল বিশ্বাস নিয়ে বলল, “কিন্তু মানুষ তো মৃত্যুর পর স্বর্গে চ’লে যায়। সেখানে গিয়ে তার আত্মা খুঁজে পায় পরম সুখ। এই দুঃখ-ক্লেশভরা পৃথিবীতে কিছুতেই আর ফিরে আসে না। কেবল যে আত্মহত্যা করে, দেবদূতেরা তার জন্য স্বর্গের দরজা বন্ধ ক’রে দেন। তার অতৃপ্ত আত্মা তখন জীবিত মানুষদের সাথে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়।”
একবছর পরের কথা। তরুণ আঁকিয়ে গেছে ইতালির ফ্লোরেন্সে। জনৈক ধনী ব্যক্তির জন্য রাফায়েল, তিতিয়ান এবং গুইডোর বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলি নকল করতে।
ইতোমধ্যে কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। তারপর বেশ কিছু মাস। প্রথমদিকে প্রায়ই চিঠি লিখত তরুণ প্রেমিক। শেষে ধীরে ধীরে কমে এলো চিঠির সংখ্যা। নেমে এলো শূন্যের ঘরে। গারট্রুড ছেলেটির পক্ষে নানান কৈফিয়ত খাড়া করতে লাগল। নিশ্চয়ই কোনও সমস্যায় পড়েছে ও; অথবা, কাজের খুব চাপ; তাই চিঠি লেখার সময় পাচ্ছে না। কিংবা নিশ্চয়ই চিঠি লিখেছে, কিন্তু ওর হাতে পৌঁছচ্ছে না। এই ভেবে গারট্রুড বহুদিন ছুটে গেছে দূরের ডাকঘরটিতে।
কিন্তু আশা রূপ নিয়েছে হতাশায়।
হতাশায় নুয়ে যেতে যেতে নতুন আশায় আবার বুক বেঁধেছে।
এবার দৃশ্যপটে হাজির হলো এক ধনবান পাণিপ্রার্থী। ওর বাবার অটল সিদ্ধান্ত, বিয়ে ওকে করতে হবে এবং তা যথাশীঘ্র। বিয়ের দিন-তারিখও ঠিক হয়ে গেল — ১৫ জুন।
বিয়ের ওই তারিখ ওর করোটিতে তীব্র ঘূর্ণি হয়ে ঘুরপাক খেতে শুরু করল। মগজের ভেতর জ্বালিয়ে দিল আগুন। মাথার শিরাগুলি সব দপ দপ করতে লাগল। দুই কানে তীক্ষ্ণ হয়ে বাজতে লাগল — ১৫ জুন…১৫ জুন…
কিছু সময় অবশ্য হাতে আছে এখনও। এখন মে মাসের মাঝামাঝি। এর মধ্যে ফ্লোরেন্সে ওর কাছে চিঠি পৌঁছানো যাবে। চিঠি পেয়ে ও নিশ্চয়ই চলে আসবে। ওকে নিয়ে পালিয়ে যাবে দূরে কোথাও, বিয়ে করবে। বাবা কেন, গোটা পৃথিবী বিরুদ্ধে গেলেও ওদের দু’জনকে আলাদা করতে পারবে না…
কিন্তু সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে গেল। চিঠির জবাবে কেউ এসে হাজির হল না। ফ্লোরেন্স থেকে কোনও সাড়াশব্দও পাওয়া গেল না। এবার সত্যিকার হতাশা গ্রাস করল ওকে।
১৪ জুন। শেষবারের মত ও ছোট্ট ডাকঘরটিতে গিয়ে হাজির হল। শেষবারের মতো পুরনো সেই প্রশ্নটি জিগ্যেস করল এবং শেষবারের মতো শুনল বহুবার শোনা সেই পুরনো জবাবটি — “কোনও চিঠি নেই।”
আগামীকাল ওর বিয়ের দিন। না, বাবা ওর কোনও অনুরোধেই কান দেবে না। ওই ধনী পাণিপ্রার্থীটির কানেও পৌঁছবে না ওর মনের প্রার্থনা। ওরা একদিনও দেরী করবে না। একঘণ্টাও না।
আজকের রাতটা কেবল ওর একার। ওর যা খুশি তাই করতে পারবে আজ রাতে…
ডাকঘর থেকে আর বাড়ির পথে ফিরল না গারট্রুড। তুলনামূলক অল্পব্যস্ত সড়কপথ দিয়ে চলে এলো শহর থেকে থেকে দূরে একটা নির্জন সেতুর ওপর — এই সেই জায়গা যেখানে সূর্যাস্তকালে ওরা দু’টিতে এসে দাঁড়াত প্রায়ই। তাকিয়ে দেখত, গোধূলির ফিকে লাল আভা নদীর বুকে টলমল করছে, তারপর ধীরে মিলিয়ে গেছে।
ফ্লোরেন্স থেকে ফিরে এসেছে ছেলেটি। গারট্রুডের চিঠি ও পেয়েছিল ঠিক কিন্তু জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করে নি। চিঠি লেখার সময় গারট্রুডের চোখের জল বাঁধ মানত না। হাতের পিঠে বার বার চোখ মোছার পরেও টপ টপ ক’রে এক একটি ফোঁটা পড়ত কাগজের ওপর। চিঠির লেখাগুলি তাই জায়গায় জায়গায় অশ্রুজলে ধোয়া, কোথাও বা অস্পষ্ট। হতাশা, অনুরোধ আর কাতর মিনতিভরা সেই চিঠি…
কিন্তু এতদিনে ওর প্রতি ছেলেটির পুরনো ভালবাসা আর নেই। এক তরুণী ফ্লোরেন্টাইনের মোহে মজেছে ওর মন। প্রায় ভুলে গেছে গারট্রুডকে। ওর বিয়ের জন্য ধনীঘরের কোনও ছেলে এসে থাকে তো মন্দ কী! বিয়ে করুক না। সেই তো ওর জন্য ভালো। আর এই বয়সে বিয়ে-শাদি ক’রে বউয়ের ঝামেলা সে পোহাতে যাবে কেন!
গারট্রুডের সাথে দেখা করার ব্যাপারে কিছুটা বিলম্ব করার সিদ্ধান্ত নিল ও — বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলেই ও হাজির হবে আর নবপরিণীতা কনেকে অভিনন্দন জানাবে। অতএব, জুনের ১৫ তারিখ সকালবেলা ও প্রবেশ করল ওর পুরনো পরিচিত শহরে সেই সেতুর ওপর দিয়ে যেখানে গোপন বাগদত্তার সাথে কাটিয়েছে কত গোলাপ গোধূলিকাল, যখন সন্ধ্যারা গড়িয়ে গেছে রাতের দিকে, আকাশে একটি-দুটি ক’রে জ্বলে উঠেছে অনেক তারার প্রদীপ আর নিঃশব্দ রাতের বুকে মৃদু তরঙ্গ তুলেছে যুগল মনের গুঞ্জন।
সেতু পেরিয়ে এসে ও নামল জলের কিনারায়। পোষা কুকুরটা হাঁটছে ওর পায়ে পায়ে। তামাকের ছোট সাদা পাইপটা থেকে কুণ্ডলী-পাকানো নীল ধোঁয়া মিলিয়ে যাচ্ছে সকালের তাজা বিশুদ্ধ বাতাসে। কোনও তাড়া নেই ওর। ছবি আঁকার খাতাটা বগলের নিচে। চারপাশে নজর বুলাতে বুলাতে হঠাৎ থামল। খাতা খুলে মগ্ন হলো ছবি আঁকায়। জলের কিনারে কিছু নলখাগড়া আর নুড়ি — নদীর অন্য পাড়ে একটি উঁচু পর্বত — দূরে ডগাছাঁটা উইলো গাছের সারি…। আঁকা শেষ হলে ছবিটার দিকে মুগ্ধচোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খাতা বন্ধ করল। পাইপের ছাই ফেলে দিয়ে তামাক ভরতে ভরতে গুনগুনিয়ে গাইল একটা গানের কলি। তারপর ধোঁয়া টানতে টানতে ধীরপায়ে হাঁটা শুরু করল।
হঠাৎ একটা দৃশ্য ফের নজর কাড়ল। শবযাত্রার দৃশ্য নয়। কোনও শবানুযাত্রী উপস্থিত নেই ওখানে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নয়, কিন্তু একটা শবাধারে পুরনো ক্যানভাসের কাপড়ে ঢাকা একটি মৃতদেহ বহন ক’রে চলেছে দু’জন বাহক। পরনে জেলেদের পোশাক। ও যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছে, সেই জায়গা থেকে একশো গজ দূরে নদীতীরে শবাধারটা নামিয়ে রাখল ওরা। শবাধারের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন বাহক। দ্বিতীয় জন বসে পড়ল এর পায়ের কাছে।
দৃশ্যটা মনে ধরেছে ওর। দু’তিন কদম এগিয়ে এসে দাঁড়াল একটা জুৎসই জায়গায়। দ্রুত হাত চালিয়ে একটা স্কেচ তৈরি করতে শুরু করল। শববাহক দু’জন নড়েচড়ে ওঠার আগেই শেষ ক’রে নিল আঁকার কাজ। শুনতে পেল ওরা কথা বলছে, যদিও বুঝতে পারল না ঠিক কী বলছে ওরা। এগিয়ে এসে জিগ্যেস করল, “কেউ মারা গেছে বুঝি?”
“হ্যাঁ, ঢেউয়ের ধাক্কায় কিনারে এসে লাগল। ঘণ্টাখানেক আগে,” জবাব দিল শববাহকদের একজন।
“পানিতে ডুবেছে?”
“হ্যাঁ, অল্পবয়েসী এক মেয়ে। খুব সুন্দরী।”
“হুঁ! আত্মহত্যা যারা করে, তারা সবসময় সুন্দরই হয়,” ধীরে আর নিচুস্বরে কথাগুলি বলল পেইন্টার; অনেকটা স্বগতোক্তির মতো। অলস ভঙ্গিতে ধোঁয়া টানতে টানতে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। ধ্যানস্থ মুখ। কিছু একটা ভাবছে। রুক্ষ্ম ভারী ক্যানভাসের ভাঁজে ফুটে-ওঠা মৃতদেহের ধারালো অবয়বটা নিরীক্ষণ করতে লাগল — আচ্ছা! মৃত মেয়েটির একটা ছবি আঁকলে কেমন হয়? বিশেষ ক’রে মেয়েটি যখন এতোই সুন্দর! জেলেদের রাজি করাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিল ওদের হাতে। ভারী রুক্ষ্ম ক্যানভাসের কাপড়টা নিজ হাতে ধীরলয়ে সরাল মৃতদেহের মুখের ওপর থেকে। কী দেখল? —
সেই মুখ! যা ওর কাকার সঙ্গীবিহীন ঘরটিতে একদা অফুরান আলো আর উষ্ণতা ছড়াত, যে-মুখ ওর কৈশোরক স্বপ্নের ভিতর ঝলমলিয়ে জেগে উঠেছিল, বিষণ্ণ মেঘের প্রান্তরেখায় ঝিকিয়ে-ওঠা সূর্যকিরণের মতো।
মাত্র এক পলকের দৃষ্টি। একবার মাত্র দম নিয়েছিল ও। কিন্তু ফের দম ফেলতে ভুলে গেল। সেই মুখ, অথচ কেমন নিষ্প্রাণ, শীতল আর নির্লিপ্ত — মর্মরপ্রস্তর দুই বাহু — নিস্পন্দ বুকের ওপর আড়াআড়ি স্থাপিত নিশ্চল দু’টি হাত — বাঁ হাতের মধ্যমায় পরা ওর মায়ের সেই আংটি — সেই সোনালী সর্প অঙ্গুরি, অন্ধ হয়ে গেলেও যে-আংটি কেবল হাতের একটুখানি ছোঁয়ায় ওরকম হাজারটা আংটি থেকে ও আলাদা করে নিতে পারবে —
নাহ! পালাতে হবে। এই অভিশপ্ত শহরের স্মৃতি থেকে, এই ভয়ানক নদীর তীরভূমি থেকে, তীব্র মনস্তাপ থেকে, দূরে কোথাও, বহুদূরে — ভুলে যেতে হবে সবকিছু… আর অমনি জেলেদের দুইজোড়া ছানাবড়া বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে পড়িমরি ক’রে সে দৌড়াতে শুরু করল। পাগলের মতো, অন্ধবেগে। মাইলের পর মাইল সে দৌড়াল অবিরাম, একটানা। মনে হল, মৃতদেহটাও ছুটছে ওর পাশাপাশি। মনে হল ওর পা দু’খানা এক জায়গাতেই থেমে আছে। কিছুতেই দূরে যেতে পারছে না।
কত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিল, কতক্ষণ দৌড়াল, জানা নেই। যখন পোষা কুকুরটা হাঁপাতে হাঁপাতে শুয়ে পড়ল ওর পায়ের কাছে, তখনই কেবল বুঝতে পারল, কতোখানি ক্লান্ত হয়েছে ও। বিশ্রাম নেবার জন্য বসে পড়ল নদীর কিনারে। চারপাশের জমিন যেন চক্রাকারে ঘুরছে চোখের সামনে। সকালবেলায় আঁকা ক্যানভাস-ঢাকা শবাধার ও দু’জেলের ছবিটা গোধূলির আবছায়ায় দপদপিয়ে জ্বলে উঠতে লাগল।
বহুক্ষণ ও বসে থাকল রাস্তার পাশে। অলস ভঙ্গিতে খেলা ক’রে চলল পোষা কুকুরটার সঙ্গে। মাটির ওপর কনুইয়ের ভর দিয়ে শুয়ে রইল। ছুটিতে ভ্রমণরত ফুরফুরে-মেজাজ কোনও ছাত্রের মত। আর এসবের মধ্যেই সকালবেলার সেই দৃশ্যটা ওর তেতে-ওঠা মগজের স্নায়ুগুলিতে আগুনের হলকা ছড়াতে লাগল।
একসময় যাবতীয় তোলপাড়, উত্তেজনা আর সন্তাপ থিতিয়ে এল ওর ভেতরে। গারট্রুডের আত্মহত্যার ঘটনাটা ভুলে গিয়ে মনোযোগ ফেরানোর চেষ্টা করল নিজের দিকে। অপ্রত্যাশিত ঐ ঘটনাটা বাদ দিলে আর সবকিছুই তো ঠিকঠাক আছে। নিজের শক্তি ও ক্ষমতার ব্যাপারে ও যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। এটিকে কোনও অজুহাতেই নষ্ট হতে দেবে না ও। ফ্লোরেন্সে থাকাকালীন যে আয়-রোজগার করেছে, তাতে এখনও ওর পকেট বেশ ভারী। নিজের ভাগ্যকে নিজের ইচ্ছায় চালিত করার ক্ষমতা আছে ওর। পৃথিবীর যেখানে খুশি, সেখানেই ও যেতে পারে।
রাস্তার পাশে বসে ও যখন সকালবেলার সেই দৃশ্যটি থেকে মনের ভাবনাগুলিকে অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা করছিল, চাইছিল ভেজা ক্যানভাসে ঢাকা শবদেহের ছবিটিকে মন থেকে মুছে ফেলতে, ভাবছিল কী করবে এখন, কোথায় যাবে, তখন হঠাৎ একটা জায়গার কথা মনে পড়ল ওর। শিস দিয়ে ডাকল পোষা কুকুরটিকে। ছুটন্ত একটা ঘোড়াগাড়ির চালককে থামিয়ে লাফিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
গাড়ির মধ্যে যাত্রীরা খোশগল্পে মত্ত। পুরো সন্ধ্যা, সমস্ত রাত ওর চোখে ঘুম নেই। তবু মুখে কুলুপ এঁটে রইল। কিন্তু পরদিন সকালে যখন অন্য যাত্রীরা একে অন্যের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তুলেছে, তখন সেও যোগ দিল ওদের সঙ্গে। বলল, ছবি আঁকা ওর পেশা এবং কলোন শহরে যাচ্ছে ম্যাটসিসের একটা বিখ্যাত ছবি নকল করতে। মনের গোপন ঝড় চাপা দেবার চেষ্টায় ও কথা বলছিল অস্বাভাবিক বেশ উঁচু গলায়। হাসছিলও খুব জোরে জোরে। এক গম্ভীরমুখ বুড়ো যাত্রীর কাছে ব্যাপারটা অসহ্য বোধ হওয়ায় তিনি ওর হাতের কাছের জানালাটা খুলে দিয়ে বললেন, “কথা যদি বলতে চাও তো জানালার বাইরে মাথা রেখে বলো।”
খোলা জানালাপথে বাইরে তাকিয়ে সেই মুহূর্তে ওর মনে হল, রাস্তাসংলগ্ন জমি আর দূরের সমতল মাঠ যেন টলমল ক’রে দুলছে।
একটা হোটেলে পুরো দেড়মাস থাকল ও। মনের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে পায়ে হেঁটে রওনা দিল কলোনের উদ্দেশে। মেজাজটা ওর ফুরফুরে হয়ে উঠেছে আবার। তামাকের সাদা পাইপটা থেকে ফের কুণ্ডলী-পাকানো ধোঁয়া উঠল সকালের শান্ত বাতাসে। ঠোঁটের ফাঁকে আবার গুনগুনিয়ে উঠল পুরনো প্রিয় গানের কলি। ভ্রমণপথে থেমে থেমে মগ্ন হাতে ছবি আঁকাও চলতে লাগল আগের মতো।
কলোনের প্রবেশপথে বিশাল গির্জাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও। পাশে আছে ওর পোষা কুকুরটি। গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং ক’রে এগারোটা বাজল। পূর্ণ জোছনায় রুপালি কাঠামোটাকে জমকালো লাগছে। তন্ময় হয়ে তার সৌন্দর্য লেহন করছে ওর চোখ।
হঠাৎ ঠাণ্ডা শিরশিরে একটা অনুভূতি হল ওর ঘাড়ের কাছে। তারপরই মনে হল, কে যেন শীতল দু’টি হাতে ওর গ্রীবা জড়িয়ে ধরেছে। দ্রুত পাক খেয়ে পেছনে ঘুরল ও। কেউ নেই। গ্রীবার ওপর ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ এখনও টের পাচ্ছে। কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
শীতল ওই আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল ও। গ্রীবার ওপর চেপে-বসা ঠাণ্ডা হাতগুলিকে দুই হাতের মুঠিতে ধ’রে হ্যাঁচকা টানে আলগা করতে চাইল। কিন্তু পারল না। চিকন ধারালো ঠাণ্ডা আঙুলগুলি লাগছে ওর হাতে। মধ্যমায় মায়ের সেই আংটি। সেই সর্প অঙ্গুরি। ভয় পেয়ে চিৎকার ক’রে ডাকল পোষা কুকুরটিকে — “হেই লিও! এখানে — এই যে! ওপরে।”
সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল কুকুরটা। কিন্তু পরমুহূর্তেই তীক্ষ্ণ ভয়ার্ত এক আওয়াজ তুলে ছিটকে সরে গেল দূরে। করুণ সুরে গোঙাতে লাগল। কুকুরের চিৎকার শুনে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এলো একজন প্রহরী। পলকে ঠাণ্ডা হাত দু’টিও গ্রীবা থেকে আলগা হয়ে গেল। হোটেল পর্যন্ত প্রহরীকে সঙ্গে নিতে ভুল করল না ও। কৃতজ্ঞতাবশে কিছু টাকাও দিল তাকে।
এরপর থেকে একটা নতুন আতঙ্ক তাড়া ক’রে ফিরতে লাগল ওকে। একা থাকা কিংবা একাকী কোথাও যাওয়ার চিন্তা পরিহার করতে হল। গায়ে প’ড়ে অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হল এবং অন্য এক ছাত্রের সাথে ভাগাভাগি ক’রে একই কক্ষে থাকতে শুরু করল। সঙ্গী ছাত্রটি যদি কখনও রুমে না থাকত, তবে দৌড়ে চলে আসত রাস্তায়। ওর এই অদ্ভুত আচরণ দেখে লোকে ওকে পাগল ভাবতে শুরু করল।
এরপর কলোন ছাড়ল ও। বাধ্য হয়েই এবার পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। কারণ, পকেট হালকা হয়ে এসেছে। রাস্তায় যথাসম্ভব মানুষের ভীড়ের মধ্যে থাকার চেষ্টা করল। ভয়, একা হলেই যদি সেই হাত দু’টি আবার জড়িয়ে ধরে! এবং রাত কাটাতে লাগল হোটেলের রান্নাঘরে আগুনের পাশে।
গারট্রুডের মৃত্যুর পর বেশ কয়মাস পেরিয়ে গেছে। টাকা-পয়সা যা ছিল, সবই প্রায় শেষ এখন। দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কে ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্য। কারণ, একা হলেই ঘাড়ের ওপর সেই ঠাণ্ডা হাতের ছোঁয়া অনুভব করছে। অবিরাম ভয়ের তাড়নায় চেহারাটা হতশ্রী। ঠিক কার্নিভালের সময় প্যারিস পৌঁছতে চাইছে ও। সেখানে পৌঁছতে পারলে কখনও আর একা থাকতে হবে না। অদৃশ্য ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শও আর অনুভব করবে না। ফিরে পাবে স্বাস্থ্য, মনের প্রফুল্ল ভাব। ছবি এঁকে আবার আয়-রোজগার করবে। সুনাম-সুখ্যাতি জুটবে।
পথের দূরত্ব যেন কমতে চায় না। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে ক্রমশ। পা দু’টি অবশ আর ভারী হয়ে আসছে। কিন্তু একসময় দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমণের সমাপ্তি ঘটল। জীবনে প্রথমবারের মতো প্যারিসে পা রাখল ও। সেই প্যারিস! বহুদিন যার স্বপ্ন দেখেছে ও। যেখানে লক্ষ মানুষের কোলাহলের ভিতর ভূত-প্রেতের কোনও ঠাঁই নেই।
উৎসবে মাতোয়ারা প্যারিস শহরটা নানারঙের আলো, সঙ্গীত আর হুল্লোড়ে ভরা। চোখের সামনে ওই বিরামহীন আলোর নাচন, কর্ণবিদারী সঙ্গীতের অবিশ্রান্ত ধ্বনিতরঙ্গ, অগুনতি মানুষের চিৎকার, উল্লাস আর অন্তহীন আনন্দগুঞ্জরন কিছুক্ষণের জন্য ওকে বিমূঢ়-বিহ্বল ক’রে রাখল।
অপেরা হাউজে মুখোশ এঁটে বলনাচ চলছে। নাচে অংশ নেবার উদ্দেশ্যে টিকেট কেনা এবং গায়ের জীর্ণ পোশাকটার ওপর চাপানোর জন্য একটা ডোমিনো ভাড়া করার মতো যথেষ্ট অর্থ ওর আছে।
এভাবে প্যারিসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অপেরা-হাউজের উদ্দাম আনন্দস্রোতে গা ভাসিয়ে দিল ও।
আর অন্ধকার নয়। একাকীত্ব নয়। — চারিদিকে মত্ত জনতার আনন্দনাচ, হুল্লোড় এবং তার মাঝে বাহুলগ্না এক তরুণীর মদির সান্নিধ্য, উষ্ণ নিঃশ্বাস –- মনের হালকা ভাবটা ফিরে এসেছে আবার — ওর দেহের নৃত্যপর ভঙ্গিতে, কথনে, চিৎকারে তার ছলকে-ওঠা উচ্ছ্বাস। শুনতে পেল, চারপাশের লোকেরা কোনও এক পানোন্মত্ত ছাত্রের বেসামাল আচরণ নিয়ে কথাবার্তা বলছে এবং আঙুল তুলে ওকেই দেখাচ্ছে। অথচ গতকাল দুপুর থেকে কিছুই পান করে নি ও। কণ্ঠটা ওর ভারী আর কর্কশ; উচ্চারণগুলি কেমন অস্পষ্ট, তবু বুনো আনন্দের জোয়ারে নেচে চলেছে — ফিরে এসেছে মনের সেই পুরনো তারল্য, সেই উচ্ছ্বাস…
নৃত্যসঙ্গী তরুণীটি ওর অনিঃশেষ মাতলামির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না; ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এবং ওর কাঁধের ওপর মেয়েটির দুই হাত সীসার চেয়েও ভারী ঠেকছে।
নৃত্যপর যুগলেরা সব বিদায় নিয়েছে। ঝাড়বাতির সব আলো নিভে যাচ্ছে একে একে। অস্পষ্ট আলোয় মঞ্চের সাজসজ্জা কেমন ফ্যাকাসে, যা ফুটিয়ে তুলেছে না-দিন-না-রাতের আবহ।
নিভন্ত বাতিগুলির ক্ষীণ আলো, নতুন দিনের ঠাণ্ডা ধূসর কিরণরেখা আধখোলা শাটারের ফাঁক গ’লে ভিতরে প্রবেশ করছে। এবং সেই আলোয় স্বচ্ছনয়না তরুণীটি চারিদিকে বিষণ্ণতার ছায়া ফেলে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। তার চোখের ঔজ্জ্বল্য তেজ হারিয়ে কেমন বিবর্ণ আর নিষ্প্রভ। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে ও দেখল কেমন ধবধবে শাদা সেই মুখ, যেন শাদা আলোয় ভরাট এক বৃত্ত। এখন সেই মুখটাও উধাও! শুধু তার ছায়াময় একটা আভাস তার চোখের ওপর স্থির।
তারপর সেসবও উধাও হল একে একে — সেই স্বচ্ছ উজ্জ্বল নয়নযুগল, সেই মুখ আর মুখের ছায়া — সবকিছু। বিশাল স্যালুনে এখন ও সম্পূর্ণ একা।
একা! এবং সেই ভয়ানক নৈঃশব্দের মধ্যে, সঙ্গীতবিহীন নীরস নৃত্যের ভেতরে ও শুধু শুনতে পেল নিজেরই পায়ের ধ্বনি। — নাহ্! কোনও সঙ্গীত নয়, শুধু ওর নিজের হৃদস্পন্দন, তার ভয়ার্ত ধুকপুক। — কারণ গ্রীবার ওপর সেই ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ! ওর ঘূর্ণ্যমান দেহের সাথে মিলে সেই স্পর্শও ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে, সেঁটে আছে গ্রীবার সঙ্গে, কিছুতেই আলগা হচ্ছে না — সেই শীতল কঠিন অমোঘ বন্ধন থেকে পালাতে পারছে না ও কিছুতেই। পেছনে তাকিয়ে দেখল, জনশূন্য স্যালুনে আর কেউ নেই — স্পষ্ট অনুভব করল মৃত্যুবৎ সেই হিমের ছোঁয়া। হ্যাঁ, একেবারে স্পষ্ট সেই অনুভব — সেই ধারালো আঙুল — সেই সর্প অঙ্গুরি…
ও চিৎকার করতে চাইল কিন্তু শুকনো গলা থেকে কোনও শব্দ বের হল না। যেন আপনাআপনি ক্রমাগত নেচে চলেছে ওর নিয়ন্ত্রণহীন দেহ। কিছুতেই থামতে পারছে না। ফাঁকা জনশূন্য জায়গার নৈঃশব্দ চিরে জেগে উঠছে ওর নিজেরই পায়ের ধ্বনি। অবিরাম। অন্তহীন। — কে বলেছে ওর সঙ্গী নেই! এই তো পরিচিত হাতগুলো — যদিও ঠাণ্ডা, হিম — জড়িয়ে আছে ওর বুকে — ওহো! এই ঘনপ্রণয়স্পর্শ তুমি কী ক’রে এড়াবে! নাহ্! নেচে চলো। নাচো। আরও এক পাক। আরও এক চক্কর, আরও একটি — আরও, আরও… থেমে যাও যদি, নির্ঘাৎ পতন আর সেইসঙ্গে মৃত্যু! —
নিভে গেছে সব বাতি। এবং আধঘণ্টা পর থিয়েটার কক্ষের ভেতরে একটি কুকুরের অনর্গল ঘেউ ঘেউ শুনে লণ্ঠন-হাতে এগিয়ে এলো ক’জন প্রহরী। কিন্তু প্রধান প্রবেশপথেই ওরা থমকে দাঁড়ালো একটি মৃতদেহের কাছে। (সমাপ্ত)
ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ম্যারি এলিজাবেথ ব্র্যাডনের জন্ম লন্ডনে; ১৮৩৫ সালের ৪ অক্টোবর। বহুপ্রজ এই লেখক আশিটির বেশী উপন্যাস লিখেছেন। ১৮৬২ সনে প্রকাশিত Lady Audley’s Secret তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সর্বাধিক বিক্রিত উপন্যাস। অনেকবার মঞ্চায়িত হয়েছে এর নাট্যরূপ। চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে বেশ কয়েকবার। ১৮৬৬ সালে তিনি Belgravia নামে একটি ম্যাগাজিন চালু করেন, প্রকাশের পর থেকেই এটি বেশ পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। Temple Bar নামে আরেকটি ম্যাগাজিনেরও সম্পাদক ছিলেন। মৃত্যুবরণ করেন ১৯১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। The Cold Embrace তাঁর বিখ্যাত একটি গল্প। বাংলায় অনুবাদ করা হলো ‘যুগলবন্দি’ শিরোনামে।