জাতীয় যুবদিবস আজ। তবে দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা কত তার নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে। বিভিন্ন বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিপ বলছে, যুব জনগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থসামাজিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। করোনা মহামারির ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্বের তরুণসমাজ। কিন্তু কর্মসংস্থান পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে তারা এখনো পিছিয়ে আছে। যুবক-তরুণ জনগোষ্ঠী সংখ্যায় বিশাল হলেও তাদের কতটা ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে, তা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।
সাধারণত ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের তরুণ-যুব জনগোষ্ঠী ধরা হয়। এই বয়সীদের সংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ। ২০২২ সালে প্রকাশিত ডিজিটাল জনশুমারির তথ্য বলছে, ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের সংখ্যা ৪ কোটি ৫৯ লাখ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও চলতি বছর জানুয়ারি মাসে প্রকাশ করা এক জরিপ প্রতিবেদনে বলেছে, তরুণ-যুবকদের ১০.৬ শতাংশ বেকার। সে হিসাবে গড়ে ৪০ লাখের বেশি যুবক বেকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণ-যুবকদের দক্ষ করে গড়ে তুলে কর্মসংস্থান সৃষ্টিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। করোনা মহামারির পর রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ^জুড়ে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের মুখে চাকরি পাওয়া বা বেকারত্ব ঘোচানোর ক্ষেত্রে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে যুব জনগোষ্ঠী। এমন পরিস্থিতিতে ক্রমেই শ্রমবাজার সংকুচিত হতে থাকায় যুবকদের মধ্যে হতাশাও বেড়েছে। চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও বাংলাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি মানুষের কর্মস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্বের অবসান ঘটানোর বিষয়ে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল-এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে প্রতিবছর দেশের অভ্যন্তরে ১৮.৪ লাখ এবং বৈদেশিক কর্মে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করতে হবে।
এদিকে গতকাল জাতীয় যুবদিবস ২০২২ উপলক্ষে সচিবালয়ে এক প্রেস কনফারেন্সে যুব ও ক্রীড়া সচিব মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘দেশে এখন যুবকের সংখ্যা পাঁচ কোটি ৩০ লাখ। এদের মধ্যে ৬৫ লাখ সরকারিভাবে প্রশিক্ষিত। তাদের অনেকেই এখন চাকরি করছেন বা নিজ উদ্যোগে ব্যবসা করছেন।’
তবে দেশে এখন বেকারের সংখ্যা কত, সেই হিসাব নেই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে। সচিব আরও জানান, ১ নভেম্বর জাতীয় যুবদিবস। দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুবসমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ‘প্রশিক্ষিত যুব, উন্নত দেশ’ এই স্লোগানে এবার জাতীয় যুবদিবস পালিত হচ্ছে। সচিব বলেন, ‘আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকেই জোর দেওয়া হয়েছে।’
আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে সফল যুবকদের ২১ জনকে পুরস্কার দেওয়া হবে। এর মধ্যে ছয় জন রয়েছেন যুব সংগঠক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, দেশে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ। অন্যদিকে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
সর্বশেষ জনশুমারির অনুযায়ী, দেশে এখন জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ। জনসংখ্যার বয়সভিত্তিক বিভাজন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা ৯ শতাংশ। ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরা মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। জনশুমারির তথ্য বলছে, দেশের জনসংখ্যার ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশই তরুণ। সংখ্যায় সাড়ে চার কোটির বেশি তরুণ ও যুব জনগোষ্ঠীই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নির্মাতা।
২০২১ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছেন কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন।
সরকারি সংস্থা বিআইডিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারের হার বেশি। ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার। দেশে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছে ২০ লাখ মানুষ। কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে বড় একটি অংশ বেকার থেকে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘জনমিতির লভ্যাংশকে (ডমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) সফল করতে চাইলে তরুণ জনগোষ্ঠী যাতে গুণগত শিক্ষা পায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। সরকার যদি তরুণদের গুণগত শিক্ষা দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে না পারে, তাহলে জনমিতির লভ্যাংশের সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ।’
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের জন্য শ্রমবাজার আরও কঠিন হয়েছে। অন্যদের চেয়ে তারা পিছিয়ে আছেন। ‘দ্য গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ’ বা ‘বিশ্বজুড়ে তরুণদের কর্মসংস্থানের প্রবণতা ২০২২’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে আইএলও বলেছে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশি তরুণদের বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, যদিও জাতীয় পর্যায়ে (সরকারি হিসাবে) বেকারত্বের হার মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ। তবে সরকারের তথ্যের চেয়ে প্রকৃত বেকার যুবকের সংখ্যা দ্বিগুনের বেশি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারির সময় তরুণদের বেকারত্ব উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, দেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা ৩ কোটি ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৮১১, মোট জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ।
সম্প্রতি একশন এইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে যুব গোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থসামাজিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তারা চাকরি পাবেন না, গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণে নেই ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ।
আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তরুণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের হার দাঁড়াতে পারে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশে। এটি বৈশ্বিক হারের সমান। তবে এই অঞ্চলের সব দেশের অবস্থা এক নয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে যেমন তফাত আছে, তেমনি উচ্চ আয়ের দেশগুলোর সঙ্গেও তাদের পার্থক্য আছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২২ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশগুলো তরুণদের কর্মসংস্থানে প্রাক-মহামারি পর্যায়ে ফেরত যাবে। তবে অন্য দেশের তরুণদের বেকারত্বের হার প্রাক-মহামারি সময়ের তুলনায় ১ শতাংশ বেশি থাকবে।
এদিকে গত ৪ জুলাই প্রকাশিত শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ‘জাতীয় কর্মসংস্থান নীতি ২০২২’ বলছে, প্রতিবছর দেশের ২২ লাখ জনবল শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ৬ কোটির বেশি। এদের ১৫ ভাগ ফরমাল সেক্টরে এবং ৮৫ ভাগ ইনফরমাল সেক্টরে কাজের সুযোগ পেয়েছেন। দেশের কর্মক্ষমদের অর্ধেক নারী। তবে তাদের বেশিরভাগই বেকার। নারীদের মধ্যে ৩৩ ভাগ ইনফরমাল সেক্টরে নামমাত্র পারিশ্রমিক বা সুবিধা নিয়ে কর্মরত। সরকারের জাতীয় কর্মসংস্থান নীতি ২০২২ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ এবং ছদ্ম বেকারের সংখ্যা এক কোটি ২৫ লাখ।
করোনা মহামারির প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর বড় অংশই তরুণ- উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিপুল এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে কর্ম উপযোগী করার বিষয়ে এখনো কোনো সমন্বিত উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না, যা সত্যিই হতাশার। যদিও দেশের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় এ উদ্যোগ নেওয়া সবচেয়ে জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘তরুণ-যুব জনগোষ্ঠীর হাত ধরে দারুণ এক জনমিতিক সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশের সামনে। যদিও সেই সম্ভাবনার পুরোটাই নির্ভর করে এই বিপুল তারুণ্য কতটা কার্যকরভাবে দক্ষ করে কাজের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া যাচ্ছে তার ওপর।’