।। মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ।।
বাংলাদেশে উদীয়মান তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রবৃদ্ধির জন্য ২০১১ সাল থেকে ২৭টি ডিজিটাল সেবা খাতে সরকার কর অব্যাহতি দিয়ে আসছে। ১৩ বছর ধরে চলা এসব ডিজিটাল সেবা খাতে সরকারের কর অব্যাহতির মেয়াদ আগামী ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
তবে এ খাতে কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০৪১ সাল পর্যন্ত নিতে হবে। সোনার ডিম কিন্তু একটা একটা করেই হয়। কর অব্যাহতি দিলে তথ্যপ্রযুক্তি খাত এ দেশের জন্য হবে ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’। এ খাত এখন রাজস্ব না দিলেও কর্মসংস্থান দেবে, ডলার দেবে, আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেবে।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অসংখ্য পণ্য রপ্তানি হয়। তবে সবচেয়ে মুনাফা অর্জন করে সফটওয়্যার খাত। একটা শার্ট একবার বানালে বারবার বিক্রি করা যায় না; কিন্তু সফটওয়্যার একবার একটা বানালে বারবার বিক্রি করা যায়। নিজ দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ব্যবসা করার সুযোগ পেয়েছে বলেই যুক্তরাষ্ট্রে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হয়েছে অ্যাপল।
বাংলাদেশেও টেক কোম্পানিকে আগামী ২০৪১ সাল পর্যন্ত কর অবকাশের সুযোগ দিলে এ দেশে ফরেন রিজার্ভ রাখার জায়গা থাকবে না। সদ্য আইটি কোম্পানিগুলো হাঁটিহাঁটি পা পা করে দাঁড়ানো শুরু করেছে। আর একটু ভালোমতো দাঁড়ালে বাংলাদেশকে রিটার্ন দেওয়া শুরু করবে। এমন সময়ে কর অবকাশ না দিলে এ খাত আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না।
আমার সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ফ্লোরা সিস্টেমস তৈরি করেছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বহুল সমাদৃত কোর ব্যাংকিং অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার ‘ফ্লোরা ব্যাংক’। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, দ্য ট্রাস্ট ব্যাংক, সীমন্ত ব্যাংক, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ মোট ১৩টি ব্যাংকের ২ হাজার ২৫৫টি শাখায় এই সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, আমার সফটওয়্যার বিদেশ থেকে নিয়ে আসা। আসলে এটা মেইড ইন বাংলাদেশ।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান টেমেনোস বিশ্বের ১৪৫টি দেশের ব্যাংকিং সফটওয়্যার সেবা দিয়ে আসছে। বাংলাদেশও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যাংকিং সফটওয়্যার কোম্পানি থেকে সেবা নিয়ে আসছে। তবে বিশ্বের ১ নম্বর সিবিএস (কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার) প্রতিষ্ঠানকে সরিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রেখেছে এ দেশের অনেক ব্যাংক। ফলে বিদেশে মোটা অঙ্কের পেমেন্ট দিতে হচ্ছে না।
বিশ্ববাজারে আমার প্রতিষ্ঠানের মতো আরও অনেক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানই এভাবে সেবা দিচ্ছে। বিদেশে সফটওয়্যার বিক্রি করে দেশে টাকা নিয়ে আসছে। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি খাত যেভাবেই কাজ করি না কেন, দেশের রিজার্ভ সমৃদ্ধ করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছি।
দেশের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতের বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এমন প্রায় আড়াই হাজার ব্যবসায়ীদের এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছে। যারা কর অব্যাহতির সুযোগ পেয়ে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সফটওয়্যার সেবা খাতের ব্যবসায়ীদের অগ্রগামী করতে যে কয়েকজন উদ্যোক্তা মিলে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আমিও একজন অন্যতম সদস্য।
আমি বেসিসে ২০০২ সালে অর্থসম্পাদক এবং ২০০৪ সালে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। আমার নেতৃত্বেই বেসিসের বিডিবিএল ভবনে স্থাপিত হয় দেশের প্রথম সফটওয়্যার ইনকিউবেটর। আমিই দেশের প্রথম বেসিস সফটএক্সপোর আহ্বায়ক ছিলাম।
আমি চারবার যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত কমডেক্সফলে সফটওয়্যার ও আইটি সেবা রপ্তানি প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছি। এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে দেশের প্রথম জাতীয় আইসিটি নীতিমালার খসড়া প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছি। সংগঠনটিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে আমি ‘টিম সাকসেস’-এর পক্ষে বেসিস ২০২৪-২৬ মেয়াদের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতেও বেসিস সদস্যদের উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালন করতে পারব।
নির্বাচনে বিজয়ী হলে দ্রুততম সময়ে বেসিসের সংবিধান সময়োপযোগী এবং দূরদর্শী করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে চাই। সদস্যদের সবচেয়ে জরুরি দাবি কর অব্যাহতির সময় বাড়াতে কাজ করতে চাই। ২০২৪ সালের জুনে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে, বিশেষত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি দেখা করে বিষয়টি সুরাহা করতে চাই।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ২০৪১ সাল পর্যন্ত আমরা এই সুবিধা পেতে চাই। বর্তমানের ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতায় বিশ্বে কেউই আমরা একা চলতে পারি না। অন্যান্য দেশের, অন্তত পক্ষে এশিয়ার তথ্যপ্রযুক্তি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেধার আদান-প্রদান বজায় রেখে বৈশ্বিক রাজনীতি মোকাবিলা করার জন্য আমরা অন্য দেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী।
সফলতার প্রথম ধাপেই দরকার আর্থিক সচ্ছলতা। যেকোনো সাফল্য সামগ্রিকভাবে আনতে হলে দরকার অর্থনৈতিক সহায়তা। এই লক্ষ্য সামনে রেখেই কাজ করার ইচ্ছা আছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে। আইটি কোম্পানির জন্য সহজ আর সুলভে ঋণ পাওয়ার কাজ করতে নীতিমালা পরিবর্তন, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, সর্বোপরি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর্থিক প্রণোদনা বা সহায়তা পাওয়া নিয়ে আমরা টিম সাকসেস কাজ করবে।
নীতিমালা প্রণয়ন করে আমরা ডিজিটাল ব্যাংকগুলোতে সম্ভাবনাময় আইটি খাতে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার একটা সুযোগ রাখার অনুরোধ আর ব্যবস্থা দুটিই করতে সচেষ্ট থাকবে। আমাদের প্রস্তাবিত নীতিমালাতে ডিজিটাল ব্যাংকের মোট ঋণ প্রদানের একটা অংশ তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা থাকবে।
ঢাকা সিটি উত্তরের মেয়র এবং রাজউক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বেসিস সদস্যদের জন্য খুব তাড়াতাড়ি একটা নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা গড়তে চাই। সেই সঙ্গে আমাদের শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য আবাসন নিশ্চিত করতে চাই। এই লক্ষ্যে টিম সাকসেস কাজ শুরু করেছে বেশ কয়েক মাস আগেই। আশা করি নির্বাচনে বিজয়ী হলে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব বাস্তবায়ন করবে।
এবারের বেসিস নির্বাচনে তিনটি প্যানেলে মাত্র তিনজন নারী অংশগ্রহণ করছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন নারী সদস্য আমাদের প্যানেল থেকে নির্বাচন করছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, কোনো কোনো সময় এই দুজন নারীর যোগ্যতা ছেলেদের চেয়ে বেশি। আমি স্বপ্ন দেখি, আমাদের প্রিয় সংগঠন বেসিসের মূল নেতৃত্বে আসবেন নারী। তাঁরাই এই সংগঠনকে লিড দেবেন।