প্রতি বছরের নভেম্বর মাসে আয়োজিত টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বাৎসরিক বাংলা নাট্যোৎসব ‘A Season of Bangla Drama’র এবারের থিম ‘Act of Love‘কে কেন্দ্র করে গত ২৫ নভেম্বর পূর্ব লণ্ডনের ব্র্যাডি আর্টস অ্যান্ড কমিউনিটি সেন্টারে মঞ্চস্থ হলো খ্যাতিমান নাট্যকার বুলবুল হাসান রচিত এবং খ্যাতিমান নাট্য নির্দেশক সৈয়দা সায়মা আহমেদ এর নাটক ‘পৃথক পালঙ্ক’।
কিংবদন্তী কবি আবুল হাসান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক কবি সুরাইয়া খানমের অসামান্য প্রেমের কাহিনী নিয়ে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র ইউকে’র পৃষ্ঠপোষকতায় পরিবেশিত এই নাটকটিকে ‘দ্যা গ্রেট বেঙ্গল টুডে’ ইতোমধ্যে এবছরের সেরা নাটক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
নাটকটিতে কবি আবুল হাসানের চরিত্রে নাট্যকার ও সুঅভিনেতা বুলবুল হাসান এবং নাটকের নির্দেশক ও সুঅভিনেত্রী সৈয়দা সায়মা আহমেদ সুরাইয়া খানমের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
প্রায় এক বছর গবেষণার পর মঞ্চস্থ হতে যাওয়া এই নাটকটি দেখতে নাট্যপ্রেমী দর্শক এবং কবি আবুল হাসান ও কবি সুরাইয়া খানমের ভক্ত অনুরাগীরা উন্মুখ হয়েছিলো। একদিন আগেই নাটকের সব টিকিট সোল্ড আউট হয়ে গিয়েছিলো। নির্ধারিত দিনে হল কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিলো। কোথাও বসার জায়গা ছিলো না। টিকিট না পেয়েও অনেক দর্শক নাটকটি দেখতে এসেছিলো। পরে বাইরে থেকে কিছু অতিরিক্ত চেয়ার এনে দাড়িঁয়ে থাকা দর্শকদের বসানো হয়েছিলো।
নাটকটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দু’জন কবির চিন্তা, কথা–বার্তা, সর্বোপরি কবিতাকে কেন্দ্র করে তাদের যাপিত জীবন ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। দর্শক অনুরোধে নাটকটা যেহেতু আগামীতে আবারও মঞ্চস্থ করা হবে, কাজেই নাটকের পুরো ঘটনা এখানে তুলে ধরছিনা। শুধু এটুকু বলবো, নাট্যকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নাটকটিতে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি কবি আবুল হাসান ও কবি সুরাইয়া খানমের কবিতা, তাদের প্রেম ও তাঁদের জীবনের কঠিন বাস্তবতার এক সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। এই গল্পের সমান্তরালে তিনি পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি ইংরেজ কবি টেড হিউজ আর সিলভিয়া প্লাথের অনবদ্য প্রেমের উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে পূর্ব এবং পশ্চিমের সেতুবন্ধন রচনা করেছেন। নাট্যকার বুঝাতে চেয়েছেন, প্রেম স্বর্গীয়। পৃথিবীর সব দিকে, সব যুগে, সব কালে প্রেমের ভাষা এক।
আমেরিকা থেকে ফুলব্রাইট কমিশন স্কলারশিপ নিয়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই কবি সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় কবি টেড হিউজের। নাটকটিতে কবি টেড হিউজ ও কবি সিলভিয়া প্লাথের রোমান্টিক জীবনের ক্যামব্রিজ পর্ব তুলে ধরা হয়েছে। প্রেমের মধ্য দিয়ে নাটকটি শুরু হয়েছে। কবি আবুল হাসানের বিয়োগান্তক পরিণতির মাধ্যমে যা শেষ হয়েছে। নাটকটিতে দর্শক এতটাই বুদ হয়েছিলেন যে নাটক শেষে বুঝতেই পারেননি কখন তাদের চোখে পানি চলে এসেছে! বিশেষ করে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আবুল হাসানরুপি বুলবুল হাসান যখন আবৃত্তি করেন–‘ ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও, ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও’। তখন নাটক দেখতে আসা দর্শক অশ্রুশিক্ত না হয়ে পারে না। কথাগুলি ব্যাপ্তিতে সংক্ষিপ্ত কিন্তু ভাবে অন্তহীন, অতল। জগতের সব কবি আসলে কবি না। কিছু মানুষ কবিতার মতো করে সব লিখতে পারেন। বাকীরা পারেন না। কবিতার মতো কবিতা কিংবা কবিতার মতো গদ্য যা-ই লিখুক, প্রতিটি লেখা যেনো রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা শিউলি ফুল। সেই ফুলগুলো এড়িয়ে যাওয়া যায় না। হেঁটে হাটু গেড়ে বসে থাকা যায় সেই ফুলের কাছে। তার উপর সেই ফুলের মধ্যে যদি জীবন থাকে, জীবনবোধ থাকে, ফুল যদি হয় জীবনঘনিষ্ঠ তবে কী-ই-বা বলার বাকী থাকে? নন্দিত কবি আবুল হাসানকে সমসাময়িক অনেক কবিই ঈর্ষা করতেন। কবি আবুল হাসান মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে ঝরে গেছেন। কিন্তু আবুল হাসান ওইটুকু জীবনে যা অর্জন করেছেন, ঈর্ষাতুর একশত কবি দুইশ বার জন্ম নিলেও তা করতে পারবে বলে মনে হয়না। এসব করতে হলে অন্তরের শুদ্ধতা, সাধনার সততা আর ভালোবাসার অতল গভীরতা থাকতে হয়।
মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে সুরাইয়া খানম প্রসংগে মাহাবুব তালুকদারকে কবি আবুল হাসান বলেছিলেন- “ওর জীবনে এমন একজন এসেছে, যাকে পেয়ে সে ধন্য। সে পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যকে একজনের মধ্যে দেখেছে। জীবনে যা কিছু চেয়েছিল, সব পেয়ে গেছে। জীবনের কাছে আর কিছু চাওয়ার নেই তার।” শরীফের ক্যান্টিনে আড্ডা মারতে মারতে একবার বলেছিলেন, “শি ইজ গ্রেট”। কবি আবুল হাসান মারা গেলে সুরাইয়া খানমকে সবাই বারণ করছিলেন, মৃত মানুষকে চুমু খেতে নেই, কিন্তু সুরাইয়াকে কিছুতেই থামানো যাচ্ছিল না। আবুল হাসানের মৃত্যুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে বাদ আসর মিলাদ ও দোয়া মাহ্ফিল হয়েছিল। এরপর তবারক হিসেবে জিলাপি বিতরণ করেছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। নাটকে অবশ্য এটুকু দেখানো হয়নি।
কিংবদন্তী কবি আবুল হাসানের চরিত্রে বুলবুল হাসান ও সুরাইয়া খানম চরিত্রে সৈয়দা সায়মা আহমেদ দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। তাঁদের কেমিস্ট্রি, আই কন্টাক্ট, দরদমাখা অনুভূতি, কবিজীবনের কথকতা, প্রেম, ডায়ালগ ডেলিভারী, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ সবই ছিলো দেখার মত, এক কথায় দুর্দান্ত। ফলে দর্শকদের একবারের জন্যও মনে হয়নি যে মঞ্চে তারা বুলবুল হাসান ও সায়মা আহমেদের অভিনয় দেখছেন। বুলবুল হাসান ও সায়মা আহমেদ চরিত্রের সাথে এতটাই মিশে গিয়েছিলেন যে দর্শকদের বরং মনে হয়েছে তাঁরা মঞ্চে স্বয়ং কবি আবুল হাসান ও সুরাইয়া খানমকে দেখছেন। বুলবুল হাসান ও সায়মা আহমেদের বলিষ্ঠ ও মনোমুগ্ধকর অভিনয় নাটকটির প্রাণ।
নন্দিত কবি টেড হিউজের চরিত্রে মার্ক ফোল্ডস ও সিলভিয়া প্লাথের চরিত্রে ডেবোরা পাইক এবং কবি নির্মলেন্দু গুনের চরিত্রে রাজ্জাকও যথেষ্ট ভালো করেছেন। ফিরোজ আহমেদ বিপুল ও আদনীন তারান্নুম সারথী নিজেদের চরিত্রে খুব ভালো করেছেন। নাটকের ধারা বর্ণনায় মাইকেল সার্চ, কবিতায় সাদেক আহমেদ ও আরফুমান চৌধুরী দারুণ করেছেন। দর্র্শকেরা প্রথমে রেকর্ডেড বর্ণনা ভেবে পরে ব্যাকস্টেজ থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে দেখে অবাক হয়েছেন!
এছাড়া নাচে সাকিবা চৌধুরী মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। নাটকের প্রত্যেক শিল্পী যার যার চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করছেন। নন্দিত কবি আবুল হাসান ও সুরাইয়া খানম এবং কবি টেড হিউজ ও সিলভিয়া প্লাথ’কে নিয়ে এরকম একটি সুন্দর নাটক উপহার দেওয়ার জন্য নাটক শেষে দর্শক বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
নাটকের প্রত্যেক শিল্পীর অসাধারণ অভিনয়ে নাটকটি দেখে দর্শকেরা মুগ্ধ হয়েছেন। নাট্যকার বুলবুল হাসান ও নির্দেশক সৈয়দা সায়মা আহমেদসহ নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন! নন্দিত কবি আবুল হাসান ও সুরাইয়া খানম এবং নন্দিত কবি টেড হিউজ ও সিলভিয়া প্লাথের জন্য বুক ভরা ব্যথা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে দর্শক রাতে অশ্রুসিক্ত নয়নে ঘরে ফিরেছেন।
উল্লেখ্য, গত ২০ বছর ধরে পথ চলা টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বাৎসরিক এই বাংলা নাট্যোৎসব এখন শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাঙালি সম্প্রদায়ের কাছে পরিচিত ও কাঙ্খিত উৎসব, তা নয়। নিজস্ব পরিমণ্ডলের বাইরে এর ব্যাপকতার পরিসর বাড়িয়ে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের এ আয়োজন এখন সাংস্কৃতিক-সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। এ উৎসবের জন্য নাট্যপ্রেমী দর্শক বছরজুড়ে অপেক্ষায় থাকেন।