কলকাতা: ফোনে অভিযোগ জানার পর এবার রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চিঠিতেও রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতির জন্য ডিভিসি-কেই দায়ী করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অভিযোগ, ডিভিসি-র অতিরিক্ত জল ছাড়ায় এবং তাদের জলাধারগুলিতে ড্রেজিং না করানোয় তার ফল ভুগতে হচ্ছে বাংলাকে। এ দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে খোঁজ নিতে মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করলে তখনও একই অভিযোগ জানিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দিয়ে এমন বেশ কিছু নদী বয়ে গিয়েছে যেগুলির অববাহিকা রয়েছে ঝাড়খণ্ড বা বিহারে। ফলে ওই রাজ্যগুলিকে বৃষ্টি হলে তার জল চলে আসছে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে বয়ে যাওয়া মূল নদীগুলিতে। উদাহরণ হিসেবে ঝাড়খণ্ডে প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দামোদর এবং বরাকরের অববাহিকার কথা তুলে ধরেছেন মুখ্যমন্ত্রী। যার ফলে ঝাড়খণ্ডে মাঝারি বৃষ্টি হলেও এ রাজ্যের জলাধারগুলিতে বিপুল পরিমাণ জল জড়ো হয়। মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ‘গত কয়েকদিন নিম্নচাপের জেরে পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খণ্ডে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। মাইথন, পাঞ্চেত এবং তেনুঘাট জলাধার থেকে ২ লক্ষ কিউসেক জল ছাড়ায় পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, হুগলি, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।’
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, অতি বর্ষণ এবং বন্যায় রাজ্যে ১৬ জনের প্রাণহানি ছাড়াও লক্ষ লক্ষ মানুষ এবং কৃষক দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। বাড়ি, ঘর, চাষের জমি, রাস্তাঘাট, সেতু, বিদ্যুতের খুঁটি সহ অন্যান্য পরিকাঠামোরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ডিভিসি-র দিকে আঙুল তুলে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতেও ম্যান মেড বন্যার অভিযোগ তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ নদীমাতৃক রাজ্য। ডিভিসি-র জলাধার থেকে বিপুল পরিমাণ জল ছাড়ায় অতীতেও বছরের পর বছর রাজ্যে ম্যান মেড বন্যা হয়েছে। ২০১৫ সালের পর ২১০৭, ২০১৯ এবং এ বছরও রাজ্যকে জটিল বন্যা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ‘ মুখ্যমন্ত্রী আরও অভিযোগ করেছেন, ২০১৫ সালেও এই সমস্যার কথা উল্লেখ করে ডিভিসি-র জলাধারগুলির জলধারণ ক্ষমতা বাড়াতে ড্রেজিংয়ের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। যাতে পশ্চিমবঙ্গকে বন্যার গ্রাস থেকে রক্ষা করা যায়। কিন্তু তার পরেও সমস্যার সমাধানে কোনও নজর দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি এড়াতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবও দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার মধ্যে যেমন পাঞ্চেত এবং মাইথনের জলাধারগুলি থেকে পলি তোলার প্রস্তাব রয়েছে, সেরকমই ঝাড়খণ্ডের বালপাহাড়িতে ডিভিসি-র ষষ্ঠ বাঁধ তৈরি করারও প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রীর মতে, বিচ্ছিন্ন ভাবে নয়, আঞ্চলিক সমস্যা হিসেবে কেন্দ্র বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। তিনি আরও লিখেছেন, যে বাঁধগুলি ঝাড়খণ্ড এবং বাংলায় রয়েছে, পলি জমে এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলির জলধারণ ক্ষমতা অনেকটাই কমে গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও অভিযোগ করেছেন, বিভিন্ন কারণে বাঁধগুলির নকশা অনুযায়ী সেগুলির যথাযথ ব্যবহার করা হচ্ছে না। ফলে বাঁধগুলি থেকে কখন জল ছাড়া হবে তা আগাম অনুমান করা যায় না। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বঙ্গোপসাগরের উপরে এখন ঘন ঘন শক্তিশালী নিম্নচাপ তৈরি হয়ে প্রবল বর্ষণ হচ্ছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষয়টির সঙ্গে যেহেতু তিনটি রাজ্যের স্বার্থ এবং ডিভিসি জড়িয়ে রয়েছে, তাই জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে দ্রুত এর নিষ্পত্তি করার জন্যও অনুরোধ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, ‘অমূল্য জীবন এবং সম্পদ রক্ষায় এটা করতেই হবে। কারণ পশ্চিমবঙ্গ নদীমাতৃক রাজ্য হওয়ায় প্রতি বছর তার খেসারত দিতে হচ্ছে। ‘
চার পাতার চিঠির শেষ দিকে মুখ্যমন্ত্রী আরও অভিযোগ করেছেন, নিয়মিত ঘূর্ণিঝড় এবং মানুষের তৈরি করা বন্যার মতো দুর্যোগের শিকার হতে হচ্ছে বাংলাকে। তা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে কোনওরকম আর্থিক সাহায্যই পাচ্ছে না রাজ্য। এবারের বন্যাতেও রাজ্যের কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার হিসেব খুব শিগগিরই কেন্দ্রীয় সরকারকে পাঠানো হবে বলে চিঠিতে লিখেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতেও অনুরোধ করেছেন তিনি। পাশাপাশি রাজ্যের বন্যা সমস্যার সমাধানে ডিভিসি-র জলাধারের সংস্কার সহ দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।