ঢাকা অফিস: টাকার বিনিময়ে ওয়ার্ড-থানা কমিটি গঠনের অভিযোগ উঠেছে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে। চাহিদা অনুযায়ী পদ-পদবি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ পদপ্রত্যাশীদের। তাদের মতে, একজন সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী প্রায় ৩০ লাখ টাকা দিয়েও কমিটির খসড়া তালিকায় নাম ওঠাতে পারেননি। তার মতো বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী আছেন, যাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী এ নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে এবং যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
প্রসঙ্গত, প্রায় দুই বছর আগে ইউনিট, ওয়ার্ড ও থানার সম্মেলন শুরু করে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ। ব্যাপক আয়োজনের মধ্যেই ওই সময় সম্মেলন-পর্ব শেষ করা হয়। উত্তর-দক্ষিণের আওতাধীন সব ওয়ার্ড-থানার প্রস্তাবিত কমিটির খসড়া তালিকা ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
কিন্তু কমিটি গঠনে নেতাদের আর্থিক লেনদেন ও অনিয়মের বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা। তাদের অভিযোগ-নগর উত্তর-দক্ষিণের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ড-থানায় ৫ থেকে ৭ জন প্রার্থীর সঙ্গে টাকা লেনদেন হয়েছে। গণহারে হয়েছে ‘পদ বাণিজ্য’। টাকার বিনিময়ে পদায়ন করা হয়েছে মামলার আসামি, চাঁদাবাজ, হাইব্রিড ও বিতর্কিতদের। এসব অনিয়মের বিষয়ে সঠিক তদন্তের দাবি তোলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন কেউ কেউ। তবে অভিযোগের সত্যতা নেই বলে দাবি করেছেন উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। তারা বলছেন, এসব অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। জানা গেছে, কমিটি গঠনে আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন মহানগর দক্ষিণের ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আলহাজ গিয়াস উদ্দিন। লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির আমাকে পুনরায় ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নগদ ১৫ লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আমি হুমায়ুন কবিরের কাছ থেকে টাকা ফেরত চাই।
হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন দক্ষিণের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নাঈম আহমেদ। অভিযোগে তিনি বলেন, হুমায়ুন কবির ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীর নাম প্রস্তাব করেছেন। এসব বিষয়ে দলীয় প্রধানের সুবিচার কামনা করেন তিনি।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, কমিটির তালিকা জমা হয়েছে। আমি শুনেছি কমিটি গঠনে অনিয়ম হয়েছে। তবে সত্যিই যদি কমিটির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে অবশ্যই যাচাই-বাছাই করা হবে। এ বিষয়ে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা খোঁজখবর রাখছেন। বিতর্কিতদের কমিটিতে আসার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, যারা পদে আসতে পারেননি, তারা কমিটি গঠনের নিয়মের বিষয়গুলো নিয়ে অপপ্রচার করছে কি না-সেই বিষয়েও খোঁজখবর নেওয়া হবে।
এদিকে থানা-ওয়ার্ডের শীর্ষ পদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়া হয়েছে, কমিটি ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত তারা কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তবে অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, দক্ষিণখান থানার আওতাধীন ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি পদ দেওয়ার কথা বলে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন ওই প্রার্থী। তাদের দুজনের টাকা লেনদেনের একটি অডিও রেকর্ড রয়েছে। ওই রেকর্ডে পদপ্রত্যাশী নগর উত্তরের সভাপতিকে জিজ্ঞেস করেন-‘ভাই কমিটি তৈরি করে দিয়ে দিচ্ছেন? আমি তো আপনাকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছি। আমাকে কোথায় রাখছেন?’ এ সময় শেখ বজলুর রহমানকে বলতে শোনা যায়, ‘এসব কথা ফোনে বলা ঠিক হয়নি। সামনাসামনি এসে বলবেন। আপনি যদি টেলিফোনে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে তো আপনাকে আমার না করতে হবে। আপনি আসেন, এরপর কথা হবে।’ এ বিষয়ে ওই প্রার্থী অভিযোগ করে যুগান্তরকে বলেন, ‘পদের জন্য আমি টাকা দিয়েছি। টাকাগুলো উত্তরের সভাপতির হাতেই দিয়েছি।’
এছাড়া তুরাগ থানায় সভাপতি পদ দেওয়ার কথা বলে এক প্রার্থীর কাছ থেকে ১১ লাখ টাকা নিয়েছেন উত্তরের এক শীর্ষ নেতা। এই নেতার নাম উল্লেখ করে ওই প্রার্থী অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি তুরাগ থানার সভাপতি হওয়ার জন্য ওই নেতাকে মোট ১১ লাখ টাকা দিয়েছি। কিছু টাকা সরাসরি নেতার হাতে দিয়েছি এবং কিছু টাকা এক কাউন্সিলরের মাধ্যমে দিয়েছি। কিন্তু আমাকে নেতা বানাবেন না। কারণ পদ দেওয়ার কথা বলে আরও অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। উল্লিখিত সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, অনেকে পদে থাকবেন কি না-এমন শঙ্কা থেকে এগুলো বলছেন। তাদের এসব অভিযোগের ভিত্তি নেই। এ রকম টাকা নিলে বহু টাকা নেওয়া যেত। প্রার্থীর সঙ্গে ১০ লাখ টাকার লেনদেন নিয়ে একটা অডিও রেকর্ড যুগান্তরের হাতে রয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এমন কথা বলতেই পারে। কারণ পদ পাইয়ে দেবে এমন কথায় সে অনেক মানুষকে টাকা দিয়েছে। আমার সঙ্গে টাকা লেনদেনের প্রশ্নই আসে না। এমন টাকা লেনদেন করলে তো কত কোটি টাকা বাণিজ্য হতো।
টাকার বিনিময়ে দুই নেতাকে শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বানানো হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ওই থানারই একজন প্রার্থী। তিনি বলেন, শাহবাগ থানার সাধারণ সম্পাদক বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা আমার কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা নিয়েছেন। সব টাকা আমি নিজের হাতে তাকে দিয়েছি। শুধু টাকা নয়, ওই নেতা বিভিন্ন সময় আমার কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। অথচ এখন বলছেন আমাকে নেতা বানাবেন না। আমাকে বাদ দিয়ে যাদের নেতা বানানো হচ্ছে, তাদের থেকে দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট নেতারা ৫০ লাখ করে টাকা নিয়েছেন। সঠিক তদন্ত করলেই সব সত্য বেরিয়ে আসবে। রমনা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ দিতে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা এক কোটি টাকা চান বলে অভিযোগ করেছেন এক প্রার্থী। টাকা দিতে না পারায় তাকে নেতা বানানো হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়। ওই প্রার্থী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি রমনা থানায় প্রার্থী হয়েছি। আমাকে দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ওই নেতা বলেছিলেন, তাকে ৬০ লাখ এবং তার সহকর্মী আরেক নেতাকে ৪০ লাখ টাকা দিতে হবে। আমি টাকা দিতে পারিনি। আমাকে তারা পদ দেবেন না।’
জানতে চাইলে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ সভাপতি আবু আহম্মদ মন্নাফি বলেন, আওয়ামী লীগ আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি নয়। তাই কমিটি গঠনে টাকার লেনদেনের প্রশ্নই ওঠে না। যদি টাকা লেনদেন হতো তাহলে অনেক আগেই কমিটি হয়ে যেত। তিনি বলেন, টাকা দিয়ে কমিটি করলে কখনোই গোপন থাকে না। এসব অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন এবং ষড়যন্ত্র। এই অভিযোগের ধারেকাছেও আমরা নেই। আর সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, কেউ যদি বলতে পারে আমি কারও কাছ থেকে টাকা নিয়েছি, তাহলে যে কোনো শাস্তি মেনে নেব। যারা এগুলো বলে তারা বিতর্ক সৃষ্টি করতে চায়। আমি কারও থেকে এক পয়সাও নিইনি। তারা আমার সম্মান ক্ষুণ্ন এবং বিতর্ক সৃষ্টি করতে এগুলো বলছে। এগুলোর সত্যতা নেই।