জীবন বীমা কর্পোরেশনে কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় গত বছর নভেম্বরে দুদকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিত নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। কিন্তু এখন ওই নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে আরো ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। খোদ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. জহুরুল হক নিজেই এই দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। প্রতিষ্ঠানটির উচ্চমান সহকারী, অফিস সহকারী এবং অফিস সহায়কের ৫১২টি পদে নিয়োগের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে অন্তত ৪০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে ব্যাপক তোলপাড় চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এই পদগুলোতে নিয়োগের জন্য আগামী ৩ এবং ৪ সেপ্টেম্বর এমসিকিউ পরীক্ষা হবার কথা রয়েছে। কিন্তু তার আগেই ইতিমধ্যে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেছে। খোদ জীবন বীমা কর্পোরেশেনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহুরুল হক নিজেই এই প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত। প্রশ্নপত্র তৈরিসহ পরীক্ষার যাবতীয় দায়িত্ব পালন করার কথা ছিলো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। ওই বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তি হয়েছে এবং চুক্তি অনুযায়ী তাদেরকে এজন্য অর্থও পরিশোধ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রশ্নপত্র তৈরিও করেছিলো। কিন্তু ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহুরুল হক তার তালিকার চাকরি প্রার্থীদের পাস করিয়ে দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতি কড়া শর্ত আরোপ করেন। বিশ্ববিদ্যায়লটি তাতে রাজি না হওয়ায় তিনি নিজেই প্রশ্নপত্র তৈরির উদ্যোগ নেন। এজন্য তার পছন্দের লোকদের দিয়ে একটি কমিটিও গঠন করেন। যা সম্পূর্ণ অবৈধ। এমডি জহুরুল হক নিজের হাতে প্রশ্নপত্র তৈরি করে ইতিমধ্যে ৫১২ জনের কাছে বিলি করে তাদের কাছ থেকে অগ্রিম ৮ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন। এমডির এই নিয়োগ কেলেংকারির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়াও কর্মচারী নেতাদের একটি সিন্ডিকেট জড়িত বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।
উচ্চমান সহকারী, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক এবং অফিস সহায়কের ৫১২টি পদের জন্য মোট আবেদনকারী ২ লাখ ৫৬ হাজার ২শ’ ৭২ জন। তারমধ্যে ১,৩২,২৯২ জন উচ্চমান সহকারী পদের জন্য আবেদন করেছেন, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদের জন্য আবেদন করেছেন ৭০,২৬৮ জন এবং অফিস সহায়কের জন্য ৫৩,৭১২ জন। আবেদনকারীদের সবারই প্রথমে এমসিকিউ এবং পরে উচ্চমান সহকারী ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদের এমসিকিউ উত্তীর্ণ প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা নেয়ার জন্য আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় জীবন বীমা কর্পোরেশন। ২৯ অক্টোবর, ২০২০ইং এই চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী তিন ক্যাটাগরির এই পদের জন্য প্রথমে আলাদাভাবে সবার এমসিকিউ পরীক্ষা গ্রহণ করবে বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর তারা উচ্চমান সহকারী ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদের এমসিকিউ উত্তীর্ণ প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা নেবে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষার খাতা প্রস্তুত, পরীক্ষার্থীদের হাজিরা শীট প্রস্তুত, পরীক্ষার কেন্দ্র ভাড়াকরণ, পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তরপত্র আনা নেয়ার জন্য পরিবহন ভাড়া, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সহায়তা গ্রহণ, সেবা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল প্রস্তুতকরণ প্রভৃতি যাবতীয় কাজগুলো চুক্তি অনুযায়ী ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিরই করার কথা। এরজন্য তাদেরকে মোট ২ কোটি ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ৪শ’ ৬৮ টাকা পরিশোধ করা হবে। এর একটি অংশ ইতিমধ্যে অগ্রিমও পরিশোধ করেছে জীবন বীমা কর্পোরেশন।
চুক্তি অনুযায়ী পরীক্ষার যাবতীয় প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল গত বছর। ১৩ নভেম্বর, ২০২০ইং এই পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কথা ছিলো। কিন্তু পরীক্ষার মাত্র দুই দিন আগে ১১ নভেম্বর, ২০২০ দুর্নীতি দমন কমিশন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে এই মর্মে চিঠি দিয়ে জানায় যে, তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এসেছে জীবন বীমা কর্পোরেশনের কর্মচারী নিয়োগকে কেন্দ্র করে ব্যাপক ঘুষ লেনদেন হয়েছে এবং পরীক্ষায় অনিয়মের আলামত পাওয়া গেছে। ওই সময় জীবন বীমা কর্পোরশেনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ছিলেন প্রশাসনের অতিরিক্ত ওমর ফারুক। তার চাকরির বয়সের শেষ মুহূর্ত ছিলো তখন। তাই এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে তিনি বড় অংকের বাণিজ্যে নেমে পড়েছিলেন। কিন্তু দুদকের চিঠির কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ওই সময়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে কয়েকবার নিয়োগ পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে সম্ভব হয়ে উঠেনি। অবশেষে আগামী ৩ এবং ৪ সেপ্টেম্বর সেই এমসিকিউ পরীক্ষা হতে যাচ্ছে।
জীবন বীমার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে ওমর ফারুকের পরে আসেন জহুরুল হক। তিনি ইতিপূর্বে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সদস্য (প্রশাসন) পদে ছিলেন। পিডিবিতে থাকাকালে তার অনেক দুর্নীতি-অপকর্মের বিষয়ে সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজে ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এখানে এসেও তিনি ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে এই নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে তিনি ইতিমধ্যে প্রায় ৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, নিয়োগ পরীক্ষা আয়োজনের ব্যাপারে গত প্রায় তিন মাস ধরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্গে এমডি জহুরুল হকের বৈঠক এবং দেনদরবার চলছিলো। জহুরুল হক প্রকাশ্য মিটিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এই মর্মে প্রস্তাব দেন যে, অন্য সবই ঠিক থাকবে। তবে তিনি ৫১২জন প্রার্থীর তালিকা দেবেন। পরীক্ষার পরে খাতাগুলো পরিবর্তনের মাধ্যমে এদেরকে পাস করিয়ে আনতে হবে। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি তাতে রাজি হয়নি। ফলে এমডি জহুরুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির বরখেলাপ করে নিজেই নতুন করে প্রশ্নপত্র তৈরির উদ্যোগ নেন। এ ব্যাপারে জীবন বীমা কর্পোরেশনের তার পছন্দের লোকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। কাগজে কলমে কমিটি গঠন করা হলেও বাস্তবে প্রশ্ন তৈরি করেন তিনি নিজের একক হাতে। সেই প্রশ্ন জীবন বীমা কর্পোরেশনের কর্মচারী নেতা নামধারী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গোপনে বিলি করে প্রার্থীদের কাছ থেকে গড়ে জনপ্রতি ৮ লাখ টাকা করে প্রায় ৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ইতিমধ্যে এ ঘটনা জানাজানিও হয়ে গেছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে তোলপাড় চলছে।
সর্বশেষ জানা গেছে, এই প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রেসে ছাপানোর জন্য তাদের সহায়তা চেয়েছেন এমডি জহুরুল হক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টি বুঝতে পেরেছে, প্রশ্ন ফাঁসের দায় তাদের ওপর চাপাতে চান এমডি। তাই কর্তৃপক্ষ বলেছেন, তাদের প্রেসে প্রশ্ন ছাপা যাবে। তবে তারা কোনো লোকবল দিতে পারবেন না। প্রশ্নফাঁসের দায়িত্ব যাতে তাদের উপর না পড়ে এজন্যই তারা এমনটি বলেছেন। ফলে এমডি জহুরুল হক বাধ্য হয়েই গত ৩০ আগস্ট সোমবার নিজের ১৮/২০ লোক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসে প্রশ্ন ছাপার ব্যবস্থা করেছেন। তবে আগামী ৩ এবং ৪ সেপ্টেম্বর এই পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও এখনই নির্ধারণ হয়ে আছে, কারা নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন।