বাংলাদেশ নিউজ ডেস্ক: ভুলপথে ঢাকার ইন্টারসেকশনের ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার কাজ করায় গত প্রায় দুই দশকে সরকারের অপচয় হয়েছে ৩০২ কোটি টাকা। ৩টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ১৮২ কোটি টাকা এবং এক দশকে ট্রাফিক সিগন্যালের বিদ্যুৎ বিল বাবদ খরচ হয়েছে ১২০ কোটি টাকা। ট্রাফিক সিগন্যাল প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিচালন খাতে বিপুল অর্থ খরচেও কোনো সুফল মেলেনি। এরপরও রাজধানীতে ফের নতুন ৬টি ইন্টারসেকশনের স্মার্ট ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিস্তারিত সমীক্ষা ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ ছাড়া খণ্ড খণ্ড উদ্যোগে সফলতা মিলবে না বলে জানিয়েছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, শহরের আয়তনের তুলনায় ঢাকার সড়কের পরিমাণ কম। অন্যদিকে তিন থেকে চারগুণ যানবাহন বেশি। যানবাহনের শ্রেণিও বেশি। কম গতি, বেশি গতির পরিবহণ একসঙ্গে চলাচল করে। এই বিশৃঙ্খলা নিরসন ছাড়াই ইন্টারসেকশনে ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার কোনো উদ্যোগ সফল হবে না।
এদিকে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন-রাজধানীর যানজট নিরসনে ট্রাফিক সিগন্যাল কার্যকরে পদক্ষেপ নিতে পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনার পর ট্রাফিক সিগন্যালের বিষয়টি ফের আলোচনায় এসেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো নড়েচড়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের উদ্যোগটি যেন আগের মতো যেনতেন না হয়। সমস্যার মূলে হাত দিয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। নইলে আবারও সরকারি অর্থের অপচয় ঘটবে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৪ সালের পর ঢাকার ইন্টারসেকশনে ব্যাপক হারে ট্রাফিক সিগন্যাল অবকাঠামো স্থাপন করা হয়। থেমে থেমে যার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। বিশেষ করে-সিগন্যাল বাতি, ট্রাফিক কাউন্টডাউন টাইমার, অটো বা স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা, ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেমের প্রযুক্তি ঢাকার ইন্টারসেকশনে স্থাপন করা হয়েছে। এসব উদ্যোগে গত দুই দশকে ৩০০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। গণপরিবহণে শৃঙ্খলা ফেরেনি, কমেনি যানজট। গুলশান-২ ছাড়া রাজধানীর সব ইন্টারসেকশনে হাতের ইশারায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে ট্রাফিক বিভাগ।
জানা গেছে, নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০১৯ সালে ট্রাফিক সিগন্যালের উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় ইন্টারসেকশনে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। সেটি সচল রাখতে সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়। এ প্রকল্প সম্পর্কে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে এই পদ্ধতি কোনো কাজেই আসেনি। এ খাতে ব্যয় হওয়া অর্থ পুরোটা অপচয় হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের আওতায় রাজধানীতে ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৯টি ইন্টারসেকশনে ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করা হয়। পাশাপাশি আরও ৩০টি ইন্টারসেকশনে কাউন্টডাউন টাইমার বসাতে ১৬ কোটি টাকা খরচ করা হয়। ২০০৪ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এই দুটো উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়েছে। এসব উদ্যোগে কোনো সুফল মেলেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ড-ডিটিসিএ ২০১৮ সালে ইন্টারসেকশনের উন্নয়নে ৫২ কোটি টাকা খরচ করে। ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম (আইএসটি) প্রকল্পের আওতায় এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে। এই প্রকল্পের আওতায়-ঢাকার মহাখালী, গুলশান-১, পল্টন, ফুলবাড়ীয়ায় আইটিএস স্থাপন করলেও তাতে কোনো সুফল মেলেনি। এছাড়া ঢাকার দুই সিটির ১০০টি ট্রাফিক সিগন্যাল পয়েন্টে সিগন্যাল বাতি রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে রয়েছে ৬০টি, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে রয়েছে ৪০টি। এসব বাতি সচল রাখতে বিদ্যুৎ বিল বাবদ দুই সিটির মাসে প্রায় ১ কোটি হিসাবে বছরে ১২ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। অর্থাৎ গত এক দশকে এ খাতে খরচ হয়েছে প্রায় ১২০ কোটি টাকা। জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নাঈম রায়হান খান যুগান্তরকে বলেন-ঢাকা উত্তর সিটি এলাকায় বড় ধরনের ৫৯টি ইন্টারসেকশন রয়েছে। ছোট আকৃতিরগুলো মিলিয়ে ইন্টারসেকশন হবে অন্তত ১২৭টি। এর মধ্যে গুলশান-২ এর ইন্টারসেকশনের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সচল রয়েছে। নতুন করে ফার্মগেট, বিজয় সরণি, জাহাঙ্গীরগেট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের ইন্টারসেকশন, তেজগাঁও লাভরোড ইন্টারসেকশন, বিজয় সরণি মেট্রোস্টেশনসংলগ্ন ইন্টারসেকশনের উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী মো. লুৎফর ফকির বলেন, আগের হিসাব অনুযায়ী দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ইন্টারসেকশনের সংখ্যা ৫৩টি। তবে আমরা কাজ করতে গিয়ে আরও ৮টি ইন্টারসেকশন চিহ্নিত করেছি। এর বাইরে ছোট অনেক ইন্টারসেকশন রয়েছে। নতুন করে কোনো ইন্টারসেকশনের উন্নয়ন করা হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, গুলশান-২ ছাড়া রাজধানীর সব ইন্টারসেকশনের ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা অকেজো। ইন্টারসেকশনের উন্নয়ন কাজ করে সিটি করপোরেশনসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থা। ঢাকা মহানগর পুলিশ শুধু সংস্থাগুলোর পদ্ধতি বাস্তবায়নে কাজ করে। ট্রাফিক সিগন্যালে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেসব কার্যকর না থাকায় হাতের ইশারায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের অভিমত : জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. মো. হাদিউজ্জমান যুগান্তরকে বলেন, যারা ঢাকার ইন্টারসেকশনে ট্রাফিক সিগন্যাল অটোমেশন করার চেষ্টা করেছে, তাদের ঢাকার যানবাহন সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। তিনি বলেন, শহরের যানবাহনের চাহিদা ইন্টারসেকশনের সক্ষমতার চেয়ে বেশি হলে সেখানে অটোমেশন ট্রাফিক সিগন্যাল সফল হয় না। শুধু বাংলাদেশ নয়, এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের কোনো শহরে সফলতা পাবে না। বর্তমান ঢাকার ইন্টারসেকশনের সক্ষমতার চেয়ে তিন থেকে চারগুণ বেশি যানবাহন রয়েছে। আর সিগন্যাল সর্বরোগের ওষুধ নয়, যখন সিগন্যাল কাজ না করলে গ্রেট সেপারেশনে যেতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহরের ১৮ থেকে ২০ সংস্করণের যানবাহন চলাচল করে। এর মধ্যে ধীরগতির যানবাহন আছে, দ্রুতগতির যানবাহনও রয়েছে। এটা বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা; সিগন্যাল বাতি জ্বলার সময় একই গতিতে সবাইকে ওই ইন্টারসেকশন পার হতে হবে। ঢাকার বিদ্যমান অবস্থায় তা সম্ভব নয়। এখানে রিকশার গতি ৫ কিলোমিটার, মোটরসাইকেলের গতি ৬০ কিলোমিটার। এটা কোনোভাবে সম্ভব নয়।
তিনি জানান, ঢাকার যানবাহনের শৃঙ্খলা ফেরাতে নীতির পরিবর্তন নিয়ে কোনো কাজ করছে না। সরকারের বিশেষ আগ্রহ অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নে। যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কাজ বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে করতে হবে। বাস রুট ফ্যাঞ্চাইজিংয়ের মাধ্যমে ঢাকার যানবাহনের বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। গণপরিবহণে আকর্ষণীয় সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে রিকশা, মোটরসাইকেল বা ব্যক্তিগত গাড়ি ছেড়েও মানুষ গণপরিবহণে চলাচল করতে পারে। আরও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ঢাকার যানজট নিরসন বা গণপরিবহণের সংকটের সমাধান কোথায় সে বিষয়ে ভালো মানের সমীক্ষা করা দরকার। যেটা আজও পর্যন্ত হয়নি। এটা হলে সমাধানগুলো সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে; তখন রাজধানীর ট্রাফিক সিগন্যালগুলো মহৌষধ হিসাবে কাজ করবে।
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক মহাপরিচালক ও গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ড. এসএম সালেহ উদ্দিন বলেন, ঢাকায় সড়ক কম গাড়ি বেশি, অর্থাৎ শহরের ২০ থেকে ২৫ ভাগ সড়ক থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ৮ থেকে ১০ ভাগ। আবার চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত মানসম্মত গাড়িও নেই। যার ফলে রিকশা, অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বেড়েছে। এ অবস্থায় ইন্টারসেকশনের ট্রাফিক সিস্টেম অটোমেশন করলে পুরো ঢাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হবে। এজন্য ট্রাফিক পুলিশ ম্যানুয়ালি বা হাতের ইশারায় ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে থিওরিটিক্যালি কথা বলে কোনো লাভ হবে না। সমস্যাটি কোথায় তা চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে। তারপর অটোমেশনে যেতে হবে।