বাংলাদেশের অর্থনীতি নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। মূল্যস্ফীতির অব্যাহত চাপ, দেশীয় মুদ্রামানের পতন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে আসা, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্য ও শিল্পপণ্যের দাম বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবাহে পতন এবং সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি, যা অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন ও যোগাযোগ অবকাঠামোকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ উসকে দিচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই সংকটের শেষ কোথায়?
যদিও সরকারের তরফ থেকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে কৃচ্ছ্রসাধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের পাশাপাশি এবার জ্বালানি খাতে ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরেছে সরকার। সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ কোম্পানিগুলো এখন থেকে জ্বালানি খরচের সর্বোচ্চ ৮০ ভাগ পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারবে। আর বিদ্যুৎ খাতের বরাদ্দের ২৫ ভাগ সাশ্রয় করতে হবে। এতে করে সরকারের বেশ ভালো অঙ্কের অর্থ বেঁচে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। শুধু জ্বালানি খাতে বছরে সাশ্রয় হবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, পেট্রল, অয়েল লুব্রিকেন্ট গ্যাস ও জ্বালানি খাতে দুটি কোডে চলতি অর্থবছরে বাজেটে দুই হাজার ৪২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে ২০ ভাগ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হলে সরকারের অর্থ বাঁচবে ৪৯৩ কোটি টাকা। আর বিদ্যুৎ খাতে ২০ ভাগ খরচ কমানো গেলে আরও কয়েক গুণ অর্থ বাঁচানো যাবে। তবে সরকারের এ সিদ্ধান্ত কতখানি পরিপালন করা সম্ভব হবে তা বছর শেষেই বলা যাবে।
এ দিকে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করে গত দুই অর্থবছরে ২৯ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সাশ্রয় হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে খরচ কমানো গেছে চার হাজার কোটি টাকা। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি বাহুল্য ব্যয় কমানোর জন্য গাড়ি কেনা বন্ধ, সরকারি কর্মকর্তাদের সম্মানী ভাতা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ ছাড়ও বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, কোভিডকালে গত দুই অর্থবছর থেকে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে সরকারি প্রকল্পে গাড়ি ক্রয়, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া অন্যতম। এই উদ্যোগের ফলে প্রথম বছরে বেশ ভালো পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। যার পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু গত অর্থবছরে কোভিডপরবর্তী অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার জন্য কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি থেকে কিছু পিছু হটা হয়েছিল। বন্ধ থাকা অনেক প্রকল্পে অর্থ ছাড়ও করা হয়েছে, বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ফলে গেল অর্থবছরে অর্থ সাশ্রয়ের পরিমাণ ছিল বেশ কম, ৪ হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু এবার গাড়ি কেনা, কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ ব্যয় বন্ধ করাসহ নতুন করে আরও একটি বিষয় যোগ করা হয়েছে। আর সেটি হলো, কর্মকর্তারা বিভিন্ন বৈঠকে যোগদান করে যে সম্মানী ভাতা পান তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে চলতি অর্থবছরে বেশ ভালো অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে গত নয় বছরের মধ্যে খাদ্যপণ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে, যা এক মাসের ব্যবধানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। একই সঙ্গে বেড়েছে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হারও। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অবাধ সুষ্ঠু পণ্য সরবরাহে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পণ্য সরবরাহে অসাধু ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেট দূর করতে হবে। এ ছাড়া সরকারকে এ মুহূর্তেই ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করতে হবে।
অন্যদিকে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। অথচ গত বছরের একই সময়ে এই উদ্বৃত্ত ছিল ৮ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। এ দিকে বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) বাংলাদেশে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। এ ক্ষেত্রেও রেকর্ড হয়েছে। এর আগে কখনই এত বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েনি দেশ। গত অর্থবছরের একই সময়ের এই ঘাটতি ছিল ২০ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। আর পুরো অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ২২ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে বাজারে ডলারের চাহিদা বেশি। কিন্তু সরবরাহ কম। সংকটের কারণে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে মার্কিন ডলারের দাম। এতে বৈদেশিক মুদ্রানির্ভর অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে নেতিবাচক অবস্থান স্পষ্ট হচ্ছে, যা অর্থনীতিকে প্রবল চাপে ফেলেছে। বৃহস্পতিবারও ব্যাংকগুলোতে ডলারের দাম আরও এক দফা বেড়েছে। এই দফায় ডলারের দাম বেড়েছে ৫০ পয়সা। আমদানির জন্য ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছে প্রতি ডলার বিক্রি করছে ৯৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে। আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা দরে।
গত বছরের এই সময়ে আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। এক বছরের ব্যবধানে আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম বেড়েছে ৯ টাকা ৬৫ পয়সা। এই সময়ে সমান হারে টাকার মানও কমেছে। টাকার মান কমায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। অপরদিকে বেড়ে যাচ্ছে আমদানি ব্যয়। এতে মূল্যস্ফীতির হারও বাড়ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। তবে যে কোনো সংকেটর পরই অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হয়। তবে সেটি হতে একটু সময় লাগবে। আস্তে আস্তে জিনিসপত্রের দাম কমতে শুরু করেছে। ভোজ্যতেলের দাম কমেছে। জ্বালানি তেলের দামও হয়তো কমতে শুরু করবে। এই মুহূর্তে সুদরে হার বৃদ্ধিই বড় চ্যালেঞ্জ। প্রকৃত অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। মূল্যস্ফীতির ওপর আঘাত আসবে। প্রবৃদ্ধি কমবে। তবে এর বিকল্প নেই। এরপর আস্তে আস্তে গতিশীল হবে অর্থনীতি।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, চলমান সংকট আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং আমরা সুচিন্তিতভাবে উদ্যোগ নিচ্ছি কিনা? আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে আমাদের হাত নেই। তবে সেখানে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় দিকটিতে আমাদের প্রাধান্যগুলো ঠিক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান স্বাভাবিক রাখতে হবে। ডলার বাজারে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে একটি ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করছে। এটা সামাল দেওয়ার জন্য রিজার্ভ ব্যবহার করা কোনো সমাধান নয়, কারণ রিজার্ভ ফুরিয়ে গেলে কী করবেন? এই সমস্যার অতি শিগগিরই সমাধান করা সম্ভব নয়। সে জন্য ডলারের এক্সচেঞ্জ রেট মানে ডলারের দাম বৃদ্ধি অ্যালাউ করা দরকার। এত দিন ডলার বিক্রি করে ডলারের দাম কমিয়ে রাখা হয়েছে, ডলারের দাম যতটা বৃদ্ধির দরকার ছিল সেটা হতে দেওয়া হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো ডলারের দাম বাড়লে কারেকশনটা কীভাবে হচ্ছে। কারেকশন দুই দিক থেকে হয়।
প্রথমত চাহিদার দিক থেকে। ডলারের দাম বাড়লে কিছু কিছু আমদানি ব্যয় কমবে। সে ক্ষেত্রে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করে ফেলি। যেমন বিদেশ ভ্রমণ করা, বিদেশে চিকিৎসা করতে যাওয়া, বিলাসী পণ্য আমদানি করা এগুলো কমবে। সেই সঙ্গে এক্সপোর্ট আয় বৃদ্ধিরও একটি সুযোগ তৈরি হয়। যদিও এটা দীর্ঘমেয়াদে নয়। কতটা হবে এটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কিন্তু রেমিট্যান্সের দিক থেকে এটা হতে বেশি সময় লাগে না। সেই দিক থেকে একদিকে চাহিদা কমল, অন্যদিকে জোগান বাড়ল- এর মাধ্যমে ভারসাম্যহীনতা কমে যায়।
দ্বিতীয় হলো, জোগানের দিক থেকে। ফর্মাল আর ইনফর্মালের ব্যবধানটা কমে গেলে ফর্মাল চ্যানেলে যে রেমিট্যান্সটা আসত, ব্যবধান থাকার কারণে ইনফর্মাল চ্যানেলে পাঠালে পাঁচ টাকা বেশি পাচ্ছে। অর ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠালে পাঁচ টাকা কম পাচ্ছে। ব্যাবধানটা যদি কমে যায় তা হলে ইনফর্মাল চ্যানেলে ইনসেনটিভটা কমে যায়। সেই দিকে থেকে মুদ্রা বাজারে জোগানটাও বাড়বে। সেই সঙ্গে আমদানি ব্যয় কমানোর জন্য যে সব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এলসি মার্জিন বাড়িয়ে দেওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার লাগেজ রুলসটা শিথিল করা, কম প্রয়োজনীয় আমদানিগুলো কমিয়ে আনা, এসব সংশোধনীগুলো সহায়তা করবে। আমদানি ব্যয় যদি কমে যায় তা হলে ভারসাম্যহীনতা কমাতে কিছুটা সহায়তা করবে।
তিনি বলেন, রিজার্ভ শেষ হলে পুরো অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। উৎপাদন ব্যবস্থা ধসে পড়বে। মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের চেয়ে মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা তা দেখা উচিত। কৃত্রিমভাবে ধরে রাখলে সংকট আরও ঘনীভূত করে। এটা নির্ভর করছে ম্যানেজমেন্টের ওপর। শ্রীলংকা যে ধরনের নীতি গ্রহণ করেছিল, এখন আমার কাছে সব চেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা হলো এতগুলো রিজার্ভ যদি খরচ করে ফেলি তা হলে তো ওই ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। আপনার হাতে যখন ডলার আছে, রিজার্ভ আছে সেই অবস্থা থেকে আপনি ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটটা অ্যাডজাস্টমেন্টটা হতে দেন। রিজার্ভ বিক্রি বন্ধ করার কারণে যদি বাজারে কোনো অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তা হলে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয় বা কোনো স্পেকুলেটাররা এটার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে তা হলে আপনি বাজারে নামতে পারবেন; ডলার ছেড়ে রোধ করতে পারবেন। তখন ওরাই মার খাবে। সে জন্য তারা ওই চেষ্টা করবে না। তিনি আরও বলেন, গত দেড় বছরে ১২ থেকে ১৪ লাখ মানুষের বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ছে না। বাজারের চেয়ে ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেশি হলে তারা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাবে। এতে দেশের ক্ষতি।