করোনাকালে পুকুর ও খাল উন্নয়নের প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশ যাওয়ার ছক সাজাচ্ছেন ৪৮ কর্মকর্তা। এক্ষেত্রে মূল ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ২৪ জনের সংস্থান থাকলেও এখন তা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হচ্ছে।
ফলে এ খাতে মূল অনুমোদিত বরাদ্দ এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই কোটি ৮৮ লাখ টাকা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে পুকুর ও খালের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ পাঁচজন থেকে বাড়িয়ে করা হচ্ছে ১৭ জন। এ খাতে বাড়ছে ব্যয়ও। ‘সারা দেশে পুকুর, খাল উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে ঘটেছে এমন ঘটনা। অথচ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে তেমন গতি নেই। আড়াই বছরে বাস্তব অগ্রগতি ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা, আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৭১ শতাংশ।
এ অবস্থায় মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়ে প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) যে কোনো সভায় উপস্থাপনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এদিকে কোভিড-১৯ এর প্রভাবে রাজস্ব আদায়ের গতি কমে গেছে। এতে উন্নয়নে অর্থায়ন সংকটের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ অবস্থায় অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটছে সরকার। ঠিক সে সময়েও বসে নেই সুবিধাভোগীরা। প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাব জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) আগামী বৈঠকে উপস্থাপনার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, টাকা বাঁচাতে সরকার ইতোমধ্যেই প্রকল্পের আওতায় গাড়ি কেনায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
সেক্ষেত্রে করোনা মহামারীর এ সংকটময় মুহূর্তে পুকুর ও খাল উন্নয়নের মতো প্রকল্পের আওতায় বিদেশ সফরের খাত বাদ দেয়া উচিত। কেননা এক্ষেত্রে ব্যাপক অর্থের অপচয় ঘটে। এ প্রকল্পের বিদেশ সফর না কমিয়ে বরং বাড়ানোটা অবশ্যই অপচয়। এটা এক ধরনের অপতৎপরতা।
সূত্র জানায়, সারা দেশে পুকুর, খাল উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য হাতে নেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুই হাজার কিলোমিটার খাল এবং দুই হাজার ১’শ একর প্রাতিষ্ঠানিক পুকুর বা দীঘি পুনঃখনন করে ভূ-উপরিস্থ পানির মজুদ বৃদ্ধি করা।
এছাড়া এগুলো বিভিন্ন আয়বর্ধক কাজে ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামীণ বেকার ও দরিদ্রদের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। কিন্তু প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক না হওয়ায় বাস্তবায়ন সময় এক বছর বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল এক হাজার ৩৩৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।
এখন সেখান থেকে ৪২২ কোটি ৫২ লাখ টাকা বাড়িয়ে করা হচ্ছে এক হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ছে ৩১ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, মূল প্রকল্পে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ খাতে তিন ব্যাচে (প্রতিটি ব্যাচে আটজন করে) ২৪ জনের সংস্থান ছিল। এক্ষেত্রে বরাদ্দ ছিল এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এখন প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবে ছয় ব্যাচে (প্রতি ব্যাচে আটজন করে) ৪৮ জনের সংস্থান রাখা হয়েছে। ফলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে প্রত্যেক কর্মকর্তার পেছনে বিদেশ সফরে ব্যয় হবে ছয় লাখ টাকা করে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অনুবিভাগ) মেজবাহ উদ্দিন মঙ্গলবার বলেন, প্রকল্প তো আমরা তৈরি করিনি। ওরা (স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর) তৈরি করেছে। তবে এ ধরনের বিদেশ সফর বাদ দেয়া উচিত। কেননা এটা এক ধরনের অপচয়। সব ধরনের বিদেশ সফর পরিকল্পনা কমিশন বাদ দিয়ে দিলেও সমস্যা হতো না।
এদিকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মূল ডিপিপিতে পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন স্পোশালিস্ট (পরামর্শক) একজন, ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভে স্পেশালিস্ট একজন এবং ডিজিটাল সার্ভে স্পেশালিস্ট তিনজনের সংস্থান ছিল। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল তিন কোটি ৪৭ লাখ টাকা। কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাবে পরামর্শকের সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৭ জন। এর মধ্যে পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন স্পেশালিস্ট ধরা হয়েছে দু’জন। ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভে ও ডিজিটাল সার্ভে স্পেশালিস্টের পরিমাণ একই রয়েছে। কিন্তু এগুলোতে বেড়েছে ব্যয়। সেই সঙ্গে নতুন পরামর্শক হিসেবে যোগ হয়েছে হাইড্রোলিক ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার একজন, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার একজন, সুপারভিশন অ্যান্ড মনিটরিং ইঞ্জিনিয়ার সাতজন, ল্যান্ড স্ক্যাপিং অ্যান্ড বিউটিফিকেশন এবং আইজিএ সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ স্পেশালিস্ট একজন। এসব মিলে সংশোধিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
প্রকল্পটির ব্যয় প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মূল অনুমোদিত প্রকল্পে ৪০টি মোটরসাইকেল কেনার জন্য বরাদ্দ ছিল ৭২ লাখ টাকা। এখন বাড়িয়ে ২৪০টি মোটরসাইকেল কেনার জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে চার কোটি ২৮ লাখ টাকা। এছাড়া আটটি আরটিকে-জিপিএস (ফুল সেট) কেনার জন্য বরাদ্দ ছিল এক কোটি ২০ লাখ টাকা। এখন সেটি বাড়িয়ে ৫৬টি ফুল সেটের জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১০ কোটি ৪ লাখ টাকা।
২০ সেট ডেস্কটপ কম্পিউটার (প্রিন্টার ও স্ক্যানারসহ) কেনায় বরাদ্দ ছিল ১৬ লাখ টাকা। এখন সেটি বাড়িয়ে ৪৪০ সেটের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে চার কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এছাড়া ২০০টি রোবোটিক টোটাল স্টেশন (ইন্টারনেট সাপোর্টেড) কেনায় বরাদ্দ ছিল ১০ কোটি টাকা। এখন সেটি বাড়িয়ে ৪০০টি করে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এমন আরও অনেক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিকভাবে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে গেছে।
পিইসি সভার সুপারিশ মেনে যেসব খাতের ব্যয় বাদ দেয়া হয়েছে সেগুলো হল- প্রকল্পের আওতায় ড্রেজিং কাজের সম্ভাবনা এবং টোটাল স্টেশন বা আরটিকে-ইজিপিএস জরিপ প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সংক্রান্ত দুটি স্টাডি বাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণের সংস্থান বাদ দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ৬০ হাজার মিটার সেচ নালা নির্মাণ কার্যক্রমও বাদ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।