নায়িকা মাহিয়া মাহিকে কেন্দ্র করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের সঙ্গে ঢালিউড তারকা মামনুন ইমনের একটি অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়েছে। গত রোববার রাত থেকেই দেশের এটি আলোচিত একটি ঘটনা। এর আগে দেশের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খান ও চিত্রনায়িকা মৌসুমীকে নিয়েও এই প্রতিমন্ত্রী কটূক্তি করেছেন। এসব নজরে এসেছে বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী হায়াতের। সাম্প্রতিক সব ইস্যুতে গত মঙ্গলবার দুপুরে কথা বলেছেন সাংবাদিক মনজুর কাদেরের সঙ্গে।
মনজুর কাদের: সাবেক তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী মুরাদ হাসানের সঙ্গে চলচ্চিত্রের অনেকের দেখা হয়েছে। আপনার সঙ্গে কোনো দেখা–সাক্ষাৎ হয়েছে কি?
কাজী হায়াৎ: আমার পরিচালিত ‘বীর’ চলচ্চিত্রের মুক্তি উপলক্ষে ঢাকা ক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে মুরাদ হাসান এসেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে আলমগীর, ফারুকও ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছিলেন মন্ত্রী মহোদয়। তাঁর সেদিনের সেই বক্তব্যে আমি অবাক হয়েছিলাম, হতবাক হয়েছিলাম। একজন মন্ত্রী এভাবে বক্তৃতা করেন! তিনি চলে যাওয়ার পর আমার নিকটজন অনেককে বলেছিলাম, এই লোকটাকে পাগল মনে হলো।
মনজুর কাদের: প্রথম দিনই এমন ধারণা পোষণ করেছিলেন?
কাজী হায়াৎ: ওই এক দিনই তাঁকে আমি দেখেছি। প্রথম দিনের বক্তব্য শুনে এমন মন্তব্য করেছিলাম। আর এখন তো মোবাইলে দেখতে না চাইলেও তাঁর বক্তৃতা সামনে চলে আসে। একজন প্রতিমন্ত্রীর এ ধরনের কথা শুনে খুব খারাপই লাগছে। লজ্জা লাগছে। দেখতে, শুনতে একজন ভদ্র মানুষ, আমাদেরই মন্ত্রী (প্রতিমন্ত্রী) ছিলেন—তাঁর মুখ দিয়ে এ রকম অশ্রাব্য কথা কীভাবে বের হলো! অশ্রাব্য নয়, এত অশ্লীল কথা! একজন মন্ত্রী একজন নায়িকাকে, একজন নারীকে এভাবে বলতে পারেন! আমার মেয়ে আজ খাবার টেবিলে বলছিল, আব্বা, চলচ্চিত্রের নায়িকারা এত অসহায়, এত অসহায়—ইদানীং টের পাচ্ছি। আগে তো এত মিডিয়া ছিল না। ইদানীং মিডিয়ার কল্যাণে টের পাচ্ছি চলচ্চিত্রের নায়িকা কতটা অসহায়। তাঁদের সম্পর্কে, এটা আগেও ছিল নিশ্চয়, প্রভাবশালীরা কতটা প্রভাব খাটাতে চান তাঁদের ওপর। এটা এখন বুঝছি।
মনজুর কাদের: চলচ্চিত্রে আপনার দীর্ঘ জীবনে এ ধরনের ঘটনার কথা শুনেছেন?
কাজী হায়াৎ: আমার জীবনে কখনো এ অবস্থা দেখিনি। এমনটি কখনো ছিলও না। অবক্ষয় হয়েছে সর্বস্তরের মানুষের। তবে আমি সমগ্র রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করব না, এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করতে চাই। একজন রাজনীতিবিদের চরিত্র খারাপ বলে সব রাজনীতিবিদ তাই হবে, এমনটা ভাবছি না। তবে রাজনীতিবিদদের উচিত এমন রাজনীতিবিদদের প্রশ্রয় না দেওয়া। তাহলে তাদের ঘাড়েও দোষটা চাপে।
মনজুর কাদের: কিছুদিন আগে চিত্রনায়ক শাকিব খানকে নিয়েও কটূক্তি করেছেন সাবেক এই মন্ত্রী। তিনি বলেছেন, শাকিব খান তেলাপোকার মতো অভিনয় করেন…
কাজী হায়াৎ: বর্তমানে শাকিব খান সর্বোচ্চ অবস্থানে অবস্থান করছে। চলচ্চিত্রের তারকা হিসেবেই শুধু নয়, একজন অভিনয়শিল্পী হিসেবেও শাকিব সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছে গেছে। সে একজন ভালো অভিনেতা। ভালো নাচে, গুড লুকিং।
মনজুর কাদের: আপনার মতো পরিচালক বলছেন, শাকিব সুদর্শন, ভালো অভিনেতা। তাহলে একজন মন্ত্রীর এভাবে কথা বলার কারণটা কী বলে মনে করছেন?
কাজী হায়াৎ: আমার খুবই খারাপ লেগেছে, কেন একজন মন্ত্রী শাকিব খানের মতো একজন শিল্পীকে নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য করবেন। শাকিব খান তো তার প্রতিপক্ষ না। এমন না যে শাকিব খান রাজনীতি করে, কোনো দলের সমর্থন করে। এমনও না, শাকিব তাঁর বিরোধী পক্ষের কোথাও গেছে। শাকিব তার মতো করে চলচ্চিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছে। হঠাৎ করে শাকিবকে নিয়ে মন্ত্রীর এ রকম মন্তব্য করাটা, মন্ত্রীর এক ধরনের পাগলামি। এটার বাইরে আমি আর কিছু বলতে পারি না।
মনজুর কাদের: চিত্রনায়িকা মৌসুমীর শারীরিক গঠন নিয়েও কটূক্তি করেছেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী।
কাজী হায়াৎ: মৌসুমীর শারীরিক গঠন নিয়ে যে ধরনের মন্তব্য করেছেন মুরাদ হাসান, ইট ইজ ওয়ান কাইন্ড অব অ্যাবিউজড। এটা মানসিক নির্যাতন করার শামিল মনে করি। আমি যদি রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটা মেয়েকে বলি আপনি এত মোটা কেন? সেক্সুয়ালি হ্যারেসমেন্ট যেমন অপরাধ, এটিও একটা অপরাধ। একজন মানুষের স্বাভাবিক মানসিক প্রক্রিয়ায় এমন কথা ভীষণভাবে আঘাত করে। ওয়ান কাইন্ড অব অ্যাবিউজের পাশাপাশি এটিও ওয়ান কাইন্ড অব পাগলামি।
মনজুর কাদের: শিল্পাঙ্গনের মানুষদের সঙ্গে ক্ষমতাবানদের যোগাযোগ নিয়ে অনেকে অনেক ধরনের কথা বলেন।
কাজী হায়াৎ: এ ধরনের ক্ষমতাবানদের দৃষ্টি সেলিব্রেটিদের ওপর পড়ে। আগে শালীনতা বজায় রাখত, এখন শালীনতা বজায় রাখে না। আমি অবশ্য শিল্পীদের দোষ দেব না। কারণ, শিল্পীরা অসহায় হয়ে যান। আমি পড়লাম, ইমন বলেছে, আমার কী বলার ছিল, আমি কীই–বা বলতে পারতাম। এমনকি মাহি সেই ওমরাহ থেকে ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছে, আমি কী করতে পারতাম। আসলে ওরা কী করতে পারত। আমরা সমাজের বিভিন্নজন যদি ওদের ওপর দোষারোপ করি, সেটা অন্যায় হবে। মুরাদ হাসান একজন প্রতিমন্ত্রী হয়ে প্রশাসনের লোকদের ভয় দেখাচ্ছেন! ওরা তো ভয় পাবেই। আমাকে যদি একজন মন্ত্রী এভাবে ভয় দেখান, যদি বলেন এই ব্যাটা একজনরে নিয়ে তুই এখানে আয়, নইলে তোরে আমি তুলে নিয়ে আসব। আমিই তো ভয়ে কাঁপতে থাকব…। আমি কোথায় আশ্রয় নেব? আমার আশ্রয়ের জায়গাই তো তারা। আসলে এমন কোনো প্রকৃত শিল্পীকে আমি দেখিনি, এমন কোনো শিল্পীর সঙ্গে কাজ করিনি—যারা সমাজের উচ্চশ্রেণির ব্যক্তিদের সহায়তায় টাকাপয়সার মালিক হতে চান। বরং তাঁরা অভিনয় করে সুনাম করবেন, এটাতে কাতর থাকেন। ক্ষমতাবানদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে অযাচিতভাবে প্রকৃত শিল্পীরা ধনসম্পদের মালিক হতে চান না।
মনজুর কাদের: এ ধরনের ঘটনার পর প্রকৃত শিল্পীদের কী করা উচিত?
কাজী হায়াৎ: আমার মনে হয়, এখন সব শিল্পীর একত্র হয়ে নিজেদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করা উচিত। প্রকৃত শিল্পীদের ভাবা উচিত, আমরা কীভাবে সুরক্ষিত থাকব। আমাদের উদ্দেশে যদি কোনো তির ছোড়া হয়, সেই তিরকে আমরা কীভাবে প্রতিহত করব? আমাদের অপছন্দনীয় ঘটনা সুযোগসন্ধানী কেউ করলে এবং কোনো কিছু বললে সবারই একত্র হয়ে তার প্রতিবাদ করব। তাহলেই আমরা সুরক্ষিত থাকব।
মনজুর কাদের: কেউ কেউ আবার এমনও বলছেন, ক্ষমতাবানদের সঙ্গে শিল্পীদের যোগাযোগ তৈরি করিয়ে দেওয়ার জন্য সুযোগসন্ধানী একটা গ্রুপ বিনোদন অঙ্গনেই কাজ করে।
কাজী হায়াৎ: সে জন্যই তো বললাম, যাঁরা প্রকৃত শিল্পী, সময় এসেছে তাঁদের একত্র হয়ে এই অঙ্গনকে সুরক্ষিত রাখার। আমাদের প্রতি কেউ যদি তির ছোড়ে, কেউ যদি কটাক্ষ করে তাকায়—তখন আমরা একত্র হয়ে জোর গলায় যেন বলতে পারি, অমুকে এটা করেছে, আমরা বিচারপ্রার্থী। এখন তো এমন তো শিল্পী নামধারীদের কেউ কেউ সমাজের অন্য ক্ষেত্রের প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছবি তুলে শোঅফ করে। আমি কখনই কারও সঙ্গে ছবি তুলতে চাই না। সে জন্যই আমি বলব, সবাই সবার নিজেকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করব। সবাই সবাইকে ভালো রাখার চেষ্টা করি। কাউকে কারও গায়ের ওপর ঢলে গিয়ে নিজেকে সঁপে দেওয়া ঠিক নয়। ইঙ্গিতের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া যে আমি সহজলভ্য—শিল্পীদের আচার–আচরণে এমনটা প্রকাশ না পায় যেন। শিল্পীর মধ্যে গাম্ভীর্য,ব্যক্তিত্ব এবং শিল্পের অহংকার থাকা উচিত। শিল্পীকে ভাবা উচিত, আমি সমাজের প্রথম শ্রেণির একজন মানুষ।