ঢাকা অফিস: গিরগিটির মতোই রঙ পাল্টাচ্ছে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসররা। ইনিয়ে-বিনিয়ে এখন চেষ্টা চালাচ্ছে ‘হাসিনা ও আওয়ামীবিরোধী’ সাজার। যারা সরাসরি হাসিনার দল করতেন-তারা তো পালিয়েই গেছেন। যারা বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ভেতর ওঁৎ পেতে থাকা ‘হাসিনা প্রেমিক’রা ভোল পাল্টাচ্ছেন নানা কৌশলে। কেউ বলছেন, এতদিন তারা বাধ্য হয়েই হাসিনাকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছেন।
কেউবা চামড়া বাঁচাতে ধরছেন রাজনৈতিক ‘নিরপেক্ষতা’র ভ্যাক। আওয়ামী লীগ তথা মাফিয়াতন্ত্রের অবয়ব লুকাতে অনেকে পরছেন ‘পেশাদারিত্ব’র মুখোশ। বলা চলে, রঙ বদলানোর মাহেন্দ্রক্ষণ এখন। শিক্ষক, সাংবাদিক, বিচারক, বিচারপতি, আইনজীবী, আমলা, ব্যবসায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতরে থেকে যারা ষোলটি বছর শেখ হাসিনার পদলেহন করেছেন, উচ্ছিষ্ট ভোগ করেছেন। রঙ বদলানো প্রতিযোগিতা তাদের মধ্যেই বেশি। তবে এ ধরনের ‘রঙ বদল’ যে ঘটতে পারে। সেটি রাজনৈতিকভাবে আগেভাগে টের পেয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। তাই পটপরিবর্তনের পরপরই গত ৮ আগস্ট দলটি অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী বা অরাজনৈতিক ব্যক্তির বিএনপিতে যোগদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপির দূরদর্শিতা দিয়েছে। মর্মে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু সব মানুষই তো সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। শেখ হাসিনার ফ্যাসিজমকে অন্ধের মতো সমর্থন দিয়ে গেছেন, এখনো করছেন। এমন অ-দলীয় ‘হাসিনা সমর্থক’ রয়েছেন রন্দ্রে রন্ধ্রে। তাদের অনেকেই নিজ পেশায় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে রয়েছেন। মাফিয়াতন্ত্রকে প্রলম্বিত করার পেছনে প্রাণপণ ভূমিকা রেখেছেন তারা। কাউকে বলে না কয়ে হুট করে হাসিনার পলায়নে মাথায় ব্রজপাত হয় তাদের। গত ৪ আগস্টের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দালাল-চামচারাও ৫ আগস্ট দুপুরের পর আকস্মিক অথৈ দরিয়ায় পড়ে যান। দুই সপ্তাহের হতোদ্যম দশা কাটিয়ে ধূর্ত শেয়ালের মতোই তারা ভিড়তে শুরু করেছেন হাসিনাবিরোধী শিবিরে। ইনিবিনিয়ে ব্যখ্যা করতে চাইছেন এতদিনকার রাজনৈতিক অবস্থান ও ভূমিকার কথা। আর ভোল পাল্টানোর ক্ষেত্রে দুঃখজনকভাবে সহযোগিতা করছেন স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ের নেতৃত্ব দানকারী প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির একশ্রেণির নেতা-কর্মী।
ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে সবসময়ই আ’লীগের পক্ষে এবং বিএনপির বিরুদ্ধে দুন্ধুমার প্রপাগান্ডায় লিপ্ত ছিল ‘সময় টিভি’, ‘একাত্তর টিভি’, ‘ডিবিসি’সহ অধিকাংশ ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও পোর্টাল। প্রচার মাধ্যমগুলোর একচোখা নীতির নিষ্ঠুর শিকার হয়েছে বিএনপি-জামায়াত। কথিত এসব টিভি চ্যানেলে ‘সাংবাদিক’ পদবি ধারণ করে যেসব আওয়ামী লীগাররা প্রপাগান্ডা চালাতেন, হাসিনা উৎখাতের পর নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের চেয়ার থেকে উৎখাত হন তারা। আত্মগোপনে চলে যান বেশির ভাগ। কেউ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত পালিয়ে যাওয়ার সময় আটক হয়েছেন। কেউ বা তুরষ্ক হয়ে ফ্রান্স পালিয়ে যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টে সস্ত্রীক গ্রেফতার হয়েছেন।
হাসিনার তল্পিবাহক কথিত এসব সাংবাদিক এবং তাদের মিডিয়া ছাত্র-গণমানুষের আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। হাসিনার গণহত্যাকে সমর্থন করেছে। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এই বাঁকবদলের কালে যারা নিষ্ঠুরতায় সমর্থন যুগিয়েছেন সেসব মিডিয়া এবং সাংবাদিকদের নিষিদ্ধ করে বিচারের কাঠগড়ায় তোলার দাবি এখন সর্বত্র। এদের হাসিনার দালাল আখ্যা দিয়ে অন্তত ২৩৫ জনের একাধিক তালিকাও প্রকাশিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি তালিকা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। এ বাস্তবতায় রঙ বদলাচ্ছে অনেক তথাকথিত সাংবাদিক। ডাক্তার, প্রকৌশলী, আমলাদের মধ্যেও চলছে রঙ বদলের প্রতিযোগিতা। তবে আওয়ামী শাসনামলে অনেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে আসীন ছিলেন। ব্যাপক দুর্নীতির কারণে তাদের প্রায় সবাই এখন বিচারের মুখোমুখি। আইনি জটিলতায় পড়ে তারা ‘হায়ার’ করছেন বিএনপিপন্থি নামী-দামি ডাকসাইটে আইনজীবীদের। আদালতে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। এমন আশায় তারা ধরছেন এ কৌশল। এমন প্রক্রিয়ার অতি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত সময় টিভি থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আহমেদ জোবায়ের। সময় টিভির মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে সংবাদ পরিবেশন ও সম্প্রচার নিশ্চিতে নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করে ‘সময় মিডিয়া লিমিটেড’-এর পক্ষে নবনিযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে শম্পা রহমান একটি রিট করেন।
এ রিটে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের দোসর আহমেদ জোবায়েরের পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এ এম ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন। আপিল বিভাগের চেম্বার জাস্টিস মো: আশফাকুল ইসলামের আদালতে তিনি লিভ টু আপিলে আহমেদ জোবায়েরের পক্ষে শুনানি করেন তিনি। মামলাটির পরবর্তী শুনানি ২৫ আগস্ট। সে পর্যন্ত টিভি চ্যানেলটির সম্প্রচার বন্ধ রাখা হয়েছে।
এছাড়া ফ্রান্সে পালিয়ে যাওয়ায় সময় এয়ারপোর্ট থেকে গ্রেফতার ফ্যাসিবাদের দোসর ৭১ টিভির চাকরিচ্যুত প্রধান বার্তা সম্পাদক শাকিল আহমেদ এবং ‘হাসিনা-ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক’ হিসেবে পরিচিত ফারজানা রূপা। হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে তারা এখন রিমান্ডে রয়েছেন। রূপা-শাকিলের পক্ষেও একজন জাতীয়তাবাদী ঘরানার আইনজীবী আইনি লড়াই করছেন। ‘পেশাদারিত্ব’র আবরণে তাদের এই সহযোগিতা মূলত ফ্যাসিবাদের পক্ষেই কাজ করা বলে মনে করছেন অনেক আইনজীবী। কারণ, গত ১৬টি বছর যখন বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ প্রায় সকল পর্যায়ের নেতারা হাজার হাজার মিথ্যা, গায়েবি, ভুয়া মামলায় অকারণ কারাভোগ করেছেন। তাদের পক্ষে একজন আওয়ামী ঘরানার আইনজীবীও ‘ পেশাদারিত্ব’র টানে পাশে দাঁড়ায়নি। সর্বশেষ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে যখন একের পর এক হাস্যকর মামলা দিয়ে শেখ হাসিনা বিচারিক হয়রানি করছিলেন, তখনও ‘পেশাদারিত্ব’ নিয়ে একজন আওয়ামীপন্থি আইনজীবীও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে দাঁড়াননি। একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিচারিক হয়রানি করা হচ্ছে। মর্মে বক্তব্য দিলে তাকে চাকরিচ্যুত করেন শেখ হাসিনার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আরেক আইনজীবী গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে মিডিয়েটর হিসেবে কাজ করায় তার বিরুদ্ধে দুদককে দিয়ে মামলা করা হয়। যে আইনজীবী, যারা পরিবেশবাদী কিংবা মানবতার ফেরিওয়ালা হিসেবে নিজেদের জাহির করেন, তারাও দাঁড়ায়নি। অথচ পেশাদারিত্বের সঙ্গে কথিত সাংবাদিক আহমেদ জোয়ায়েরের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন নন। শুধু একজন মাহবুবউদ্দিন খোকনই নন- স্বৈরাচার বিরোধী লড়াইয়ের অগ্রভাগে ছিলেন, এমন সিনিয়র আইনজীবীদের এখন খুব কদর। আদালতে সুফল লাভের আশায় অনেক আওয়ামী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আমলা, প্রতিষ্ঠান মালিক এবং উচ্চবিত্ত মানুষ আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের পরিবর্তে বিএনপিপন্থি আইনজীবী নিয়োগ দিচ্ছেন। এ ছাড়া আরেকটি বাস্তবতা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট বারের আওয়ামী রাজনীতি করতেন, হাসিনা সরকারের ফ্যাসিজমের ভাগিদার এমন আওয়ামী আইনজীবীরা এখন আত্মগোপনে। এর ফলে এসব আইনজীবীর মক্কেলগণ মামলা নিয়ে পড়েছেন মহাবিপাকে। এ প্রেক্ষাপটে অনেকে এক প্রকার বাধ্য হয়েই বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবী নেতাদের বেছে নিচ্ছেন। বিএনপি ঘরানার কোনো কোনো আইনজীবী অধিক ফি’র বিনিময়ে আদালতে দাঁড়াচ্ছেন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের পক্ষে।
তবে ফ্যাসিবাদের দোসর কারো পক্ষে দাঁড়ানোর আগে জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের আইনজীবীদের আগে বিবেকের কাছে স্বচ্ছ থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। গতকাল শনিবার তিনি টেলিফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, যদি একজন আইনজীবী হিসেবে বলি তাহলে আইনের আশ্রয় প্রত্যাশী যেকোনো নাগরিকের পক্ষেই যেকোনো আইনজীবী দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু যদি এমন হয়, একজন আইনজীবী একাধারে একজন রাজনীতিবিদও হয়ে থাকেন এবং তিনি যদি একটি দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পদ-পদবি ধারণ করেন, তাহলে তার রেসপন্সিবিলিটি ডবল। যে স্বৈরশাসন এবং ফ্যাসিজমকে হটানোর জন্য ছাত্র-জনতা রক্ত দিলেন সেই স্বৈরাচার কিংবা তার দোসরের পক্ষে আইনি লড়াই করা রক্তের প্রতি বেঈমানি। ফ্যাসিজমের দোসর কারও পক্ষে দাঁড়িয়ে আইনি সহায়তা দেয়াটা নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন। আমাদের মধ্যে এমন যদি কেউ থাকেন তাহলে সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর বিবেকের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। বিবেকের কাছে স্বচ্ছ থাকা প্রয়োজন।