একটি বইয়ের গুণগতমান আপেক্ষিক হলেও নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, বইটি মানসম্পন্ন নাকি মানহীন! এমন কিছু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে বইয়ের বিষয়বস্তু, ছাপা, প্রচ্ছদ, নির্ভুল বানান, নির্ভুল বাক্যগঠন, সম্পাদনা, গবেষণা ইত্যাদি।
বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা ঘুরে দেখা যায়, বইয়ের মানের ব্যাপারে কোনো কোনো প্রকাশক চরম উদাসীন। বইয়ের জটিল বিষয় না হয় বাদই থাকল, শুদ্ধ বানান ও বাক্যগঠনের মতো বিষয়েও রয়েছে অনীহা। যেহেতু অনেক পাঠকও সচেতন নয়, তাই দেদারসে বিক্রি হচ্ছে এমন সব বই। তবে এ সব দেখার যেন কেউই নেই। বাংলা একাডেমি বইয়ের বিষয়বস্তু দেখার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করলেও বইয়ের মান দেখা তাদের কাজ নয় বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করছে তারা।
এবারের একুশে বইমেলায় ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠান জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে যার মধ্যে একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২০টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৫১৫টি। আর লিটল ম্যাগ প্রাঙ্গণে ১৭০টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
মেলা ঘুরে দেখা গেল, বইয়ের মান নিশ্চিতে অনেক প্রকাশনা সংস্থারই রয়েছে অনীহা। বইয়ের প্রচ্ছদ, ভাষা, বানান ও বাক্যগঠনের মতো মূল বিষয়েও নজর দেওয়া হয়নি। বড়দের ফিকশন, নন-ফিকশন তো বটেই, বাদ যায়নি শিশুদের বইগুলোও। শিশুদের বর্ণ পরিচয় থেকে শুরু করে ছড়া, কবিতা, গল্পের বইয়ে অসংখ্য বানান ভুল। প্রশ্ন উঠেছে এসব বই পড়ে শিশুরা আসলে কী শিখবে?
ভুলে ভরা বইগুলো প্রকাশের আগে সম্পাদনা করা হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে একাধিক স্টলের বিক্রয় প্রতিনিধিরা কিছু বলতে পারেননি। অধিকাংশ স্টলেই ছিলেন না প্রকাশক বা দায়িত্বশীল কেউ। আবার কিছু প্রকাশনীতে দেখা যায় কিছু বই সম্পাদনা করা আর কিছু বই একদম যাচ্ছেতাইভাবে ছাপানো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব প্রকাশকরা জানান, অনুরোধ বা টাকার বিনিময়ে ছাপা বই তারা অতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না। ভালো মানের লেখক বা ভালো বিষয়য়ের উপর লেখা বই তারা সম্পাদনা করেই তারপর ছাপেন।
পাঠকদের মধ্যেও রয়েছে দুটি ভাগ। একদল মনে করছেন বইয়ে একটু-আধটু ভুল থাকলে কোনো সমস্যা নেই। আরেকদল ভাবছেন একটি বই নির্ভুল ও সু-সম্পাদিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। বই কিনছেন এমন একাধিক পাঠকের কাছে বই কেনার সময় কী দেখেন জানতে চাইলে জানা গেল তারা মূলত বিষয়বস্তু দেখেন। এখানে বানান ভুল থাকলে কিছু যায় আসে না। তবে নিউজে নাম প্রকাশে কেউ রাজি হননি।
ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশের প্যাভিলিয়নে বই দেখছিলেন এমন এক পাঠিকার কাছে এই প্রতিবেদক জানতে চান কী ধরনের বই তিনি কিনবেন। ওই পাঠিকা বলেন, ‘প্রোগ্রামিংয়ের বই কিনতে এসেছি।’
এসব বই তো সারাবছর নীলক্ষেত থেকেই কেনা যায়। বইমেলায় যেহেতু এসেছেন অন্য কোনো বই দেখবেন বা কিনবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বই তো পড়ি না, শুধু শুধু কিনব কেন।’
মেলার মধ্যে ঘুরতে থাকা দুই যুবকের কাছে জানতে চাওয়া হয় তারা কী ধরনের বই কিনতে এসেছেন বা কী ধরনের বই পড়েন? জানা গেল তারা মূলত ইতিহাস ও ইসলামের ইতিহাস নির্ভর বই খুঁজতে এসেছেন।
বই কেনার সময় শুধুই বিষয় নাকি লেখক, প্রকাশনা, বইয়ের মান, নির্ভুল বানান ইত্যাদিও দেখেন কিনা জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘এগুলো দেখার কী আছে? বইয়ে ভুল থাকতেই পারে। আমরা বই কিনি বিষয় দেখে।’
অন্যদিকে পাঠকদের মধ্যে যারা একটু সচেতন তারা বলছেন, বই কেনার সময় মান যাচাই অত্যন্ত জরুরি। প্রথমার প্যাভিলয়নে আনু মুহাম্মদের লেখা অর্থনীতি বিষয়ক বই কিনছিলেন একজন পাঠক।
জানা গেল, তিনি সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. এম খালেদ আহমেদ। সাবেক এই সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জানালেন তিনি বিষয়ভিত্তিক বই কেনেন। তার অভিমত বইয়ের বিষয়বস্তু, লেখার মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, ‘আমি যে ধরনের বই পড়ি সেটিতে গবেষণাভিত্তিক তথ্য, নির্ভুল তথ্য থাকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই দেখেশুনে বই কিনি। সেইসঙ্গে নির্ভুল বানান, বাক্যগঠন ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বই থেকে আমরা অনেককিছু শিখি। সেখানেই ভুল থাকলে তা গ্রহণযোগ্য নয়।’
পাঠক সমাবেশে বই দেখছিলেন সাংবাদিক ফখরুল ইসলাম হারুন। কথায় কথায় জানা গেল এখন মূলত নন-ফিকশন ও বিষয়ভিত্তিক বই-ই কেনেন। তবে তার অভিমত ফিকশন হোক কী নন-ফিকশন বইয়ের মান অত্যন্ত জরুরি।
তিনি বলেন, ‘আমি বই কেনার সময় গভীরতা, গবেষণা, মান, রেফারেন্স ইত্যাদি বিচার করি। এখন প্রকাশনী অনেক আছে কিন্তু সবাই মান ধরে রাখতে পারছে না। দেখা যায় প্রচ্ছদের সঙ্গে ভেতরে মিল নেই। সম্পাদনার অভাবও চোখে পড়ে। তাই দেখেশুনে বই কিনি। পাঠক যেহেতু তার মূল্যবান সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করছেন বইয়ের পেছনে তাই অবশ্যই বেছে বেছে বই কেনা উচিত।’
শিশুসাহিত্যিক আদিত্য রুপু বলেন, ‘আমার কাছে পরিশ্রমলব্ধ বই খুব ভালো লাগে। দেখা যায়, দশজন একই বিষয়ে বই লিখেছে। মলাট সরিয়ে ফেললে বোঝার উপায় নেই কার বই কোনটা? তাই ভালো সম্পাদনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য প্রয়োজন লেখক-প্রকাশকের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া। তাই নির্ভুল ও মানসম্মত বইয়ের ব্যাপারে লেখক-প্রকাশক দুইজনকেই সচেতন থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু মেলা উপলক্ষেই অনেক বই বের হয়। অনেক লেখক আছে যারা ঝাঁকের কই। চিপসের প্যাকেটের মত বই বের করছেন। বইয়ের মধ্যে সারবস্তু নেই কিন্তু বাইরে চকচকে মোড়ক। একজন সচেতন পাঠক বই দেখে কেনে। বাবা-মায়ের উচিত সন্তানকে চিপসের প্যাকেটের মতো বই না কিনে দেখেশুনে ভালো বই কিনে দেওয়া। আর বাংলা একাডেমিকেও স্টল বরাদ্দের বিষয়ে মান যাচাই আরও বাড়াতে হবে। আমি আশাবাদী এ সংকট কেটে যাবে।’
প্রকাশকরাও মানছেন বইয়ের ক্ষেত্রে সম্পাদনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জিনিয়াস পাবলিকেশন্সের প্রকাশক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘লেখক-প্রকাশক উভয়েরই দায় রয়েছে একটি মানসম্মত বই বের করার ব্যাপারে। বই পড়ে মানুষ নানারকম শিক্ষা পায়, জ্ঞান লাভ করে। বানান আর বাক্যরীতিও শেখে। তাই অবশ্যই বইয়ের বানান দেখা, সম্পাদনা গুরুত্বপূর্ণ। এতে খরচ বেশি হলেও বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই।’
ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের প্রকাশক জহিরুল আবেদীন জুয়েল বলেন, ‘আজকাল শুধু বইমেলাকে কেন্দ্র করে অনেক প্রকাশনী ও লেখক আত্মপ্রকাশ করছেন। লেখক এবং প্রকাশকদের এমন ব্যবসামনস্ক হওয়ার কারণে বইয়ে ভুল থাকছে। তারা কোনো দায়বদ্ধতা বোধ করছে না।’
জহুরুল আবেদীন জুয়েল আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, বই যতটা সম্ভব নির্ভুল হতে হবে। ফর্মা নির্দিষ্ট করতে গিয়ে লেখার মান বা আকারেও ছাড় দেওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে শিশুদের বইয়ে ভুল থাকা বড় ধরনের অপরাধ। বড়দের বইয়ের ভুল মেনে নেওয়া গেলেও শিশুদের বইয়ে ভুল মেনে নেওয়া যায় না।’
প্রথমা প্রকাশনের ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, বাঁধাই, প্রফু রিডিং সবই অত্যন্ত গুরুত্ব দেই। অনেকসময় ছাপা হওয়া বইয়েও কোনো ভুল থাকলে সেটি বাদ দিয়ে নতুন করে ছাপানো হয়।’
মেলায় মানহীন বইয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে একাডেমির বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ে ভুল বানান বা বাক্যরীতি দেখা নয়, তারা বইয়ের বিষয়বস্তু দেখেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। আর এটি নিশ্চিতের জন্য রয়েছে সাত সদস্য বিশিষ্ট টাস্কফোর্স। বইয়ে কারো বিরুদ্ধে কুৎসা বা অপবাদ রটানো, সমাজ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় পতাকা এবং জাতির পিতার প্রতি অবমাননা হচ্ছে কি-না তা নিশ্চিত করে এই কমিটি।’
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মো. আরিফ হোসেন ছোটন বলেন, ‘বইয়ে ভুল আছে কি-না কিংবা মান কেমন সেটি দেখার দায়িত্ব আমাদের না। আমরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিই। আমরা দেখি বইয়ে রাষ্ট্র, ধর্ম, ব্যক্তি বিদ্বেষী কিছু আছে কি-না। গত তিন বছরে অভিযোগের ভিত্তিতে অনেক প্রকাশককে শো-কজ করা হয়েছে।’
ভুলে ভরা বই ছাপছে এমন প্রকাশনী কীভাবে বইমেলায় স্টল পায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাংলা একাডেমি প্রকাশকদের সঙ্গে বসে স্টল বরাদ্দ দেয়। তার আগে নতুন প্রকাশনী হলে আমরা তাদের এক বছরের মধ্যে বের হওয়া জমাকৃত বই দেখে তারপর সদস্যপদ দেই৷ সেই সার্টিফিকেট অনুযায়ী বাংলা একাডেমি স্টল বরাদ্দ দেয়। এখানে বিষয়বস্তু গুরুত্ব পায়, নির্ভুল বানান, বাক্যরীতি, সম্পাদনা ইত্যাদি নয়।’
অনেক প্রকাশনীতেই দেখা যাচ্ছে কিছু বই বিনা সম্পাদনায় ছাপা আর পাশেই কিছু বই খুব ভালো করে সম্পাদনা করা। এদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক প্রকাশক বইমেলাকেন্দ্রিক কিছু বই বের করে। দেখা যায় এ সব বইয়ের লেখকও বইয়ের মানের বিষয়ে অতটা গুরুত্ব দেয় না। ফলে অনেক বই বের হয় যেগুলোর মান ভালো না।’
সম্পাদনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেক প্রকাশনীই সেটি মেনে চলে না স্বীকার করে নিয়ে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মো. আরিফ হোসেন ছোটন আরও বলেন, ‘ভুলভাল বই যারা প্রকাশ করে তারা বেশিদিন টিকে থাকবে না।’