ঢাকা অফিস: পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি তুলে নিয়ে যাচ্ছে বিদেশিরা। এ কারণে শেয়ার বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ অর্থাৎ পোর্টফোলিও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য বলছে, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) প্রায় ৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ পুঁজি তুলে নিয়ে গেছে বিদেশিরা। বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার এ পরিমাণ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহামারি, যুদ্ধের কারণে যে বৈশ্বিক অস্থিরতা বিরাজ করছে, তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের শেয়ারবাজারে। ডলার সংকট, স্থানীয় মুদ্রার মান কমে যাওয়ার কারণেও বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ইতিবাচক ছিল। অর্থাৎ ওই সময় পর্যন্ত বিদেশিরা শেয়ার বিক্রির তুলনায় কিনেছে বেশি। তবে এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ তুলে নিয়ে যেতে থাকে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী লকডাউন কার্যকর হওয়ায় বিশ্ব অর্থনীতিতে স্থবিরতা চলে আসে। তখন থেকেই বিদেশিরা শেয়ার বাজার থেকে পুঁজি তুলে নিয়ে যেতে থাকে। পুঁজি প্রত্যাহারের এই ধারা আরও বেগবান হয় ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা এই সংকট আরও দীর্ঘায়িত করেছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২৪ এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পুঁজিবাজারে দেশের বাইরে থেকে ৪৫৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ পোর্টফোলিও বিনিয়োগ এসেছিল। পরের অর্থবছরে আসে ৩৪৯ মার্কিন ডলার। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৭১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পোর্টফোলিও বিনিয়োগ আসে। এরপর থেকেই শেয়ার বিক্রি করে পুঁজি তুলে নিয়ে যেতে থাকে বিনিয়োগকারীরা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৬৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ চলে যায়। সূত্র জানায়, পুঁজি বাজারে পোর্টফোলিও বিনিয়াগ আকর্ষণে ২০১৮ সালে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে চীনের শেনঝেন-সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের কনসোর্টিয়ামের কাছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)’র শেয়ার বিক্রি হয়। ওই সময় প্রায় ৯৪৭ কোটি টাকায় ডিএসইর ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করা হয়েছিল। পাশাপাশি সে সময় চীনা কনসোর্টিয়ামের পক্ষ থেকে ডিএসইকে বেশকিছু কারিগরি সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শীর্ষ পদে পরিবর্তন আনে সরকার। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে। দায়িত্ব নেওয়ার পর পুঁজিবাজারে প্রবাসী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের টানতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে রোড শোর আয়োজন করেন তিনি। তবে বৈশ্বিক অস্থিরতা এসব উদ্যোগের সুফল অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের পর সরবরাহ সংকটের কারণে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। বিনিয়োগকারীরা যখন দেখে নিজ দেশে বিনিয়োগে বেশি রিটার্ন আসে, তখনই তারা বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারেও তাই ঘটেছে। শেয়ার বিক্রি করে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ থেকে পুঁজি তুলে নিয়ে যাচ্ছে বিদেশিরা।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ বলেন, মহামারির পর ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে তাদের পুঁজি তুলে নিয়ে যেতে থাকে। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পুঁজিবাজার থেকেও বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ চলে যায়। কারণ, ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। একই সময়ে বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান কমতে থাকে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারানোর শঙ্কা দেখা দেয়। আবু আহমেদ আরও জানান, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পোর্টফোলিও বিনিয়োগ করে মূলত স্থানীয় মুদ্রায়। একটি ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার রেখে, সেই ডলারকে টাকায় রূপান্তর করে পুঁজিবাজার থেকে শেয়ার কিনে নেয়। টাকার মান কমতে থাকায় তারা যখন সেই শেয়ার বিক্রি করে আবার ডলার কিনতে যায়, তখন দেখা যায়, ৮৫ টাকার শেয়ার ১০০ টাকার ওপরে উঠে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেখছে, টাকার মান হারানোর কারণে বেশি শেয়ার বিক্রি করে তারা তুলনামূলক কম ডলার নিতে পারছেন। এ কারণে শেয়ার বিক্রি করে তারা পুঁজি তুলে নিয়ে যাচ্ছেন।