আসাম নিউজ ডেস্ক: বাংলা আমার মাতৃভাষা; ঈশান বাংলা মা’! আহ! বাংলার নামে প্রাণ জুড়োয়। সাল ১৯৬১, তারিখ ১৯ শে’মে। অসমের (Barak valley) বরাক উপত্যকায় অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আত্মবলিদানের এক ঐতিহাসিক দিন। এ দিন শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে মোট ১১ জন ভাষা সংগ্রামীকে প্রাদেশিক পুলিশ গুলি করে হত্যা করে।
বাংলা ভাষার দাবিতে নিজের বুক রক্তে রক্তে রাঙা করেছিলেন শহিদ কমলা ভট্টাচার্য, কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ । শহীদ সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারের মতোই মহাকাল মনে রাখবে তাঁদের নাম। এই আত্মদান এবং আন্দোলনের পর বাংলা ভাষা বরাকে সরকারি ভাষা হিসেবে মর্যাদা পায়।তাই আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো যেমন আছে তেমনি আছে আমার বোনের রক্তে রাঙানোও।
ভাষার জন্যে নিজেকে শহীদ করে দেয়া কমলা ভট্টাচার্য আখ্যায়িত হয়ে থাকেন মাতৃভাষার লড়াইয়ে বিশ্বের প্রথম নারী শহীদ হিসেবে। তখন তিনি কিশোরীই। গুলিতে প্রাণ হারানোর সময় কমলা ভট্টাচার্যের বয়স ছিল মাত্র ১৬। তখন সবে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েই ভাষা আন্দোলনে কমলার ঝাঁপিয়ে পড়া।এমন তেজস্বী একজন নারী ছিলেন তিনি।
বাবা হারা এই কিশোরী বড় ভাই রামরমণ ভট্টাচার্যের সাথে শিলচর শহরে থাকতেন। কমলার পরিবার ১৯৫০ সালে সিলেট ছেড়ে কাছাড়ে চলে আসে। তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন তৃতীয়।আমরা যেন ভুল করেও এই বাংলাকে অবহেলা না করি। কারণ বাংলা ভাষার অধিকারের জন্যে এমন লড়াই, ত্যাগ অন্য ভাষার জন্যে হয়েছে কিনা সন্দেহ। ফলে আধুনিক হয়ে গিয়েছি, বাংলা পারি না—এই কথা বলার মধ্যে কোন গর্ব নেই, মনে রাখতে হবে। মাতৃভাষা বলতে না পারার মধ্যে গৌরবের কিছু নেই।
ভাষা–সৈনিক কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য ১১ ভাষা শহীদদের মাঝে অন্যতম। অসমের বহুভাষিক চরিত্রকে অস্বীকার করে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে জোর করে অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার যে একটা গভীর চক্রান্ত শুরু হয়েছিল তার বিরুদ্ধে গর্জে উঠে যারা বরাক উপত্যকার শিলচরের বুকে আত্মবলিদান দিয়েছিলেন, আপামর বাঙালির পক্ষ থেকে তাঁদের চরণে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
বাংলা ভাষার দাবিতে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন বা একষট্টির ভাষা আন্দোলন—এই দুয়ের প্রেক্ষিত হিসেব করলে একটি জিনিস স্পষ্ট দেখা যায়, ইতিহাস আমাদের একটি ভুলের দিকেই ইঙ্গিত করে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ঐতিহাসিক ভুলটিই বারবার সামনে আসে এবং এই ভুলের মাশুল বাংলাদেশ যেমন দিয়েছে ২৩ বছরের পাকিস্তানি দুঃশাসন এবং ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, তেমনি তথাকথিত দেশভাগে ওপারের মানুষকে দিতে হয়েছে বারবার।
বিংশ শতাব্দীর সেই ১৯৬০ সালে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা তীব্র থেকে তীব্র হতে শুরু করে। উগ্র অসমিয়া জাতি বাঙালি অভিবাসীদের আক্রমণ করে ভয়ংকরভাবে। জুলাই এবং সেপ্টেম্বর মাসে সহিংসতা চরম রূপ নেয়। ঠিক সে সময় প্রাণের ভয়ে প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়।
অন্যান্য আরো ৯০ হাজার বরাক উপত্যকা এবং উত্তর-পূর্বের অন্যত্র পালিয়ে যায়। গঠন করা হয় ন্যায়াধীশ গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক ব্যক্তির একটি তদন্ত কমিশন। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের ৪,০১৯টি কুঁড়েঘর এবং ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস এবং আক্রমণ করা হয়; এই জেলা ছিল সহিংসতার সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকা। এদিকে ৯জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়। প্রাণে বেঁচে গেলেও চরম আহত হয় শতাধিক মানুষ।
‘বুঢ়ালুইত’ ব্রহ্মপুত্র যেমন অসমের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কৃষ্টি–সংস্কৃতির বহমান বাহক, তেমনি ‘বরবক্র’ বা বরাক (বড় বড় বাঁক যার) নামে আরও একটি মহাভারত–বর্ণিত নদী আছে এই অসমে। মাতৃভাষা বাঙালির মুখ থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল জাতীয়তাবাদীরা। সেই ভাষিক আগ্রাসন বুকের রক্ত দিয়ে রোধ করলেন শহিদেরা।