স্বাস্থ্য ডেস্ক: বাংলাদেশের ডায়াগনস্টিক ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। তাই রোগ নির্ণয় বাংলাদেশে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা মানা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারি কোনো তদারকি নেই। ল্যাব টেকনিশিয়ান দিয়ে ক্লিনিকগুলো রিপোর্ট তৈরি করায়। রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় না হওয়ায় দেশের অর্ধেক রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যান বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বিভিন্ন রোগের পরীক্ষার রিপোর্টে গরমিল থাকায় দেশের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি মানুষের আস্থা কম বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে রোগ নির্ণয়ে ভুল করছে দেশের নামিদামি ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ ক্লিনিকগুলো। ভুল পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে অনেক রোগী অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। ভুল প্যাথলজিক্যাল টেস্ট থেকে ডাক্তারের আত্মীয়স্বজনরাও নিরাপদ নয়। ভুল পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে রোগী ও তার পরিবার শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
এদিকে, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো সরকারি বিধিনিষেধ না মেনে রোগ নির্ণয় করে যাচ্ছে।
জনসাধারণের রোগ নির্ণয়ে রক্ত, প্রস্রাব, মলসহ এক্সরে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে প্রতিষ্ঠানের অশিক্ষিত ও অদক্ষ জনবল দিয়ে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে আসা লোকজনের সরলতাকে পুঁজি করে প্রতিষ্ঠানগুলোর নামকরা চিকিৎসকের ভুয়া স্বাক্ষর ও সিল ব্যবহার করে রিপোর্ট দিয়ে থাকে। এতে সুফল পায় না রোগীরা। তাদের বিরুদ্ধে মেয়াদোত্তীর্ণ, রি-এজেন্ট কেমিক্যাল ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। অভিযোগ আছে, যে ডাক্তার ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠান তাকে শতকরা হারে কমিশন দিতে হয়। রোগীদের অভিযোগ তাদের কাছ থেকে উচ্চমূল্য আদায় করছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি হাসপাতালকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুয়া ডাক্তাররা চিকিৎসা দিচ্ছেন। দালালের মাধ্যমে সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগীদের এনে ওই সব রোগীর চিকিৎসা করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্লিনিকে ভুয়া ডাক্তার অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করে। মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি সার্টিফিকেট না নিয়ে তারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে রোগী দেখছেন। দালালরা রোগীদের বুঝিয়ে ভুয়া বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কাছে নিয়ে যায়। প্রশাসনের নাকের ডগায় ভুয়া চিকিৎসক, ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো এসব চালিয়ে আসছে।
দেশের ডায়াগনস্টিক ব্যবস্থা খুবই দুর্বল উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং সাবেক পরিচালক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না রোগীর কী রোগ হলো। একই পরীক্ষা ভিন্ন ভিন্ন ল্যাবে আলাদা আলাদা রেজাল্ট আসছে। ফলে রোগ নির্ণয়ে ভুল হয়। আবার রোগী ওষুধ খাচ্ছেন রোগ সারছে না। এতে রোগীর সন্দেহ বা সংশয় তৈরি হয়। তখন রোগী বিদেশমুখী হন। বিদেশে গেলে ওখানকার চিকিৎসকরাও প্রশ্ন তুলেন বাংলাদেশে কেন রোগ ধরতে পারলো না। তাহলে প্রশ্ন ওঠে বাংলাদেশি ডাক্তাররা কী লেখাপড়ায় খারাপ? একদম না। সিনিয়ররা বেশির ভাগ খারাপ না। যদিও জুনিয়রদের নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। পরীক্ষা মানসম্পন্ন না। উন্নত বা গোল্ড স্ট্যানডার ল্যাব নেই। রেফারেন্স ল্যাবও সেই রকম নেই। সরকারি একটা রেফারেন্স ল্যাব থাকলেও তার সক্ষমতা নেই বলে মনে করেন অধ্যাপক হামিদ। দেশের ডায়াগনস্টিক টেস্টের দুর্বলতার কারণে রোগ ধরতে না পারায় দায়টা শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকের উপরেই বর্তায়। ফলে চিকিৎসক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থা কমে যাচ্ছে। এতে দেশের ক্রমাগত বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
কেইস স্টাডি: ক্যান্সারের চিকিৎসা হিসেবে ফিরোজা খাতুনকে দেয়া হয় ক্যামোথেরাপি। প্রস্তুতি নেয়া হয় স্তন কেটে ফেলে দেয়ার। একে একে চারটি ক্যামোথেরাপি দেয়ার পর স্বজনদের পরামর্শে তিনি ভারত যান। সেখানে ডাক্তারের কাছে গেলে তারা তাকে নিয়ে গবেষণা করেন। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে জানানো হয় আপনার ক্যান্সার হয়নি। আপনি সুস্থ আছেন। এ সংবাদ পেয়ে কী করবেন ফিরোজা? দেশে যে ডাক্তাররা ক্যামো দিয়েছেন তাদের কথা বিশ্বাস করবেন, নাকি ভারতের ডাক্তারের কথা? ক্যান্সার না হওয়া সত্ত্বেও তাকে যে ক্যামোথেরাপি দেয়া হয়েছে এর কী হবে? তার শারীরিক কোনো ক্ষতি হবে না তো? নানা দুশ্চিন্তায় ফিরোজার ঘুম হারাম। এভাবেই কেটে গেছে তিনটি বছর। ফিরোজা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু তাতে কী? পেশায় একজন শিক্ষক ফিরোজার প্রশ্ন না জানি আমার মতো কতো মানুষ ভুল পরীক্ষায় অকালে জীবন হারাচ্ছে। কিংবা অপারেশন করে অঙ্গ হারাচ্ছে। ভুল চিকিৎসার ফাঁদে যেন কেউ না পড়েন সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। ২০১২ সালের মার্চ মাস। তার জীবনের এক উল্লেখযোগ্য সময়। দেশের নামিদামি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলা হয়েছে, আপনার ডান পাশের স্তনে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। কথা শুনে আঁতকে উঠলাম। জীবিত ফিরোজা মৃত হয়ে গেলাম। তিনি বলেন, স্লাইড পরীক্ষায় মেডিনোভা ও আনোয়ারা মেডিক্যাল সার্ভিসেস নামের দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকেই ক্যান্সার থাকার কথা বলেছিল। এরপর একটি নয়, দুটি নয়, চারটি ক্যামোথেরাপিও দেয়া হয়। প্রস্তুতি চলে অপারেশনেরও। ডাক্তাররা বললেন, অপারেশন করে স্তন ফেলে দিতে হবে। কিন্তু অপারেশন করার আগে ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দেন আত্মীয়স্বজনরা। স্বজনদের কথায় ভারতের কলকাতায় পাড়ি দেন তিনি। ওখানেও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান ডাক্তাররা। কিন্তু এসব পরীক্ষায় ক্যান্সারের কোনো উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বলা হয়েছে ক্যান্সার আছে, ভারতের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বলেছে ক্যান্সার নেই।
রাজধানীর ধানমণ্ডিস্থ নামিদামি এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যান দেশের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সাবেক এক পুরুষ কর্মকর্তা। সেখানে তিনি তার রক্ত পরীক্ষা করান। ওই ব্যক্তির সঙ্গে তার অফিসে আলাপকালে তিনি জানান, দেশের ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অনেক রিপোর্টই ভুল। তারা নিজেরা দক্ষ লোকবল দিয়ে এসব পরীক্ষা করায় না। ল্যাব টেকনিশিয়ান কখনোবা ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট লেখান। তার নিজের রক্তের পরীক্ষায় ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি ভুল রিপোর্ট দিয়েছে উল্লেখ করেন তিনি। জানান, রিপোর্টে তাকে গর্ভবতী হিসেবে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্টরা। পরে ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ তাদের ভুল স্বীকার করে আবার ভুক্তভোগীর রক্ত পরীক্ষা নিতে চায়। তাতে আর আগ্রহ দেখাননি ওই কর্মকর্তা।
গত কয়েক দশকে স্বাস্থ্যসেবা খাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগও ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, নব্বইয়ের দশকে দেশে বেসরকারি হাসপাতাল ছিল ৩৮৪টি। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, জেলা বা জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা হাসপাতালসহ (ইউনিয়ন পর্যায় বাদে) বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতাল রয়েছে ৬৪০টি। এর বাইরেও সরকারের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অন্যদিকে দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা এখন ৭ হাজার ৮৫৪টি। দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট শয্যা সংখ্যা ১ লাখ ৭৯ হাজারের বেশি। এর মধ্যে বেসরকারিতেই রয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার শয্যা। আর বেসরকারি রোগ নিরীক্ষা কেন্দ্র আছে প্রায় ১০ হাজার। ব্লাড ব্যাংক আছে ১৮০টি।
দেশের জনস্বাস্থ্যবিদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কোথাও মানসম্পন্ন নেই। আমাদের ডায়াগনস্টিকও মানসম্পন্ন না। ডায়াগনস্টিক ব্যবস্থা খুবই খারাপ। রোগ নির্ণয়ে ভুল করছে দেশের নামিদামি ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ক্লিনিকগুলো। ভুল পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে অনেক রোগী অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। একটা পরীক্ষা তিন জায়গায় করালে তিন ধরনের ফল পাওয়া যায়। এখানে মানুষের আস্থা থাকে কীভাবে। বিদেশে গিয়ে একই রোগী সঠিক ডায়াগনস্টিক ব্যবস্থা পাওয়ার ফলে দ্রুত সুস্থ হচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো না। শুধু চিকিৎসকদের ব্যবহারকে দায়ী করলে হবে না। গুণগত চিকিৎসা বৃদ্ধির জন্য সরকারকে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, মেডিকেল ভিসা সহজ এবং ভারতের সঙ্গে আমাদের বড় সীমান্ত রয়েছে, তাই মানুষ সহজে পাশের দেশে গিয়ে চিকিৎসা করান এবং শপিংও করে আসেন। ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে চিকিৎসকদের খাপ খাওয়াতে রাষ্ট্রকে বিনিয়োগ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুল হক বলেন, বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার বহু কারণ রয়েছে। দীর্ঘ দিনের মানুষের ধারণা বা বিশ্বাস বাইরের চিকিৎসা ভালো হয়। মানুষের আস্থা তৈরি করতে পারেনি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা।
এদিকে, ১০ই জুলাই মাদারীপুরের শিবচরে শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব হেলথ অ্যান্ড টেকনোলজি পরিদর্শন শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় না হওয়ায় দেশের অর্ধেক রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যায়। বিভিন্ন রোগের পরীক্ষার রিপোর্টে গরমিল থাকার কারণেই দেশের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি মানুষের আস্থা কম। দেশের টেকনোলজি শক্ত হলে, রোগের চিকিৎসা দেশেই করা সম্ভব। টেকনিশিয়ানরা সঠিকভাবে বিভিন্ন পরীক্ষার সঠিক রিপোর্ট প্রদান করলেই দেশের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে দেশের উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে স্বাবলম্বী করার তাগিদ দেয়া হচ্ছে। সূত্র: মানবজমিন