তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে ডিজিটাল দুনিয়ায় পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অপরাধীদের বিচরণ। জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডসহ নানা প্রতারণার জাল বিস্তার করে ওত পেতে আছে তারা। তারপরও সাইবার সক্ষমতায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি ইনডেক্সে বাংলাদেশ আট ধাপ এগিয়ে ৬৫তম স্থানে উন্নীত হয়েছে।
তারপর দেশ এ অপরাধের ঝুঁকিমুক্ত নয় বলে মনে করেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, যে দেশটি সূচকে এক নম্বরে অবস্থান করছে তারাও ঝুঁকিমুক্ত নয়।
গত আগস্ট ও নভেম্বরে (২০২০) দুই দফায় সাইবার হামলার বিষয়ে সতর্কতা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের সাইবার নিরাপত্তার অবকাঠামোগুলোও সক্রিয় হয়ে ওঠে হামলা প্রতিরোধে।
সাইবার নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাইবার হামলা ও অপরাধ ঠেকানোর সক্ষমতায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। সাইবার অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। সার্বিকভাবে সাইবার অ্যাটাক বা অপরাধ ঠেকাতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ছাড়া সব দেশ থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে।
সাইবার অ্যাটাক বা অপরাধ মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সাইবার নিরাপত্তায় সক্ষমতা বাড়াতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। দেশের সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিটি ইউনিট ও বিভাগে সাইবার ইউনিট খোলা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল কমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) নামে আলাদা একটি অধিদফতরও কাজ করছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীন অনেক প্রতিষ্ঠান তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় কাজ করছে। লিভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স প্রজেক্ট প্রকল্পের ই-গভর্ন্যান্স কম্পোনেন্টের আওতায় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে (বিসিসি) জাতীয় ডাটা সেন্টার ও সরকারের সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি বিশেষ টিম কাজ করে যাচ্ছে। আইটি ও সাইবার বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত টিমটি বিজিডি ই-গভ সার্ট (BGD e-GOV CIRT) নামে পরিচিত।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে ইন্টারসেপশন সেবা দিয়ে যাচ্ছে এনটিএমসি। এরমধ্যে ল্যান্ডফোনের ভয়েসের আইনানুগ ইন্টারসেপশন, মোবাইল ফোনের ভয়েস ও এসএমএস-এর আইনানুগ ইন্টারসেপশন এবং রাষ্ট্রবিরোধী সংবেদনশীল তথ্যের অযাচিত প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ সেবায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এনটিএমসি এ বছরের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের কর্মসম্পাদন সূচকের মান শতভাগ ধরা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইনানুগ ইন্টারসেপশন সেবায়ও এই প্রতিষ্ঠানটির সাফল্যও প্রায় ৯০ ভাগ।
সিআইডি সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান বলেন, ‘সাইবার অপরাধ নিয়ে প্রতিদিন সিআইডির বিভিন্ন মাধ্যমে অন্তত দুই হাজার অভিযোগ আসে। সব অভিযোগ আমলে নিয়ে যেটার যে রকম ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, সেটাই গ্রহণ করছি। তদন্ত করছি। রিপোর্ট জমা দিচ্ছি। মামলার নিষ্পত্তি ও তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার হার হিসাব করলে দেখা যায়, আমরা খুব ভালোভাবেই অভিযোগগুলো সামলে সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছি।’
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার আশরাফুল আলম বলেন, ‘সাইবার সিকিউরিটি বা প্রযুক্তিগত অপরাধ নিয়ে সিআইডি ছাড়াও পুলিশের অন্যান্য ইউনিট কাজ করছে। সাইবার অপরাধ ঠেকাতে আমরা মোটামুটি প্রস্তুত। যেকোনও ধরনের অভিযোগ আমলে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করছি।’
সাইবার অ্যাটাক কিংবা অপরাধ ঠেকাতে বাংলাদেশের সক্ষমতা কেমন জানতে চাইলে সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘সক্ষমতার বিষয়টি আপেক্ষিক। সক্ষমতায় এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ যেমন ঝুঁকিতে আছে, সক্ষমতার দিক থেকে এক নম্বরে থাকা দেশটিও কিন্তু ঝুঁকিতে আছে। এটা কেউ পুরোপুরি ঠেকাতে পারবে না। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগের চেয়ে বাংলাদেশে এই বিষয়ে অনেক সচেতনতা তৈরি হয়েছে। সূচকে বাংলাদেশ যতই এগিয়ে যাক, বাংলাদেশ অ্যান্ড্রয়েড অ্যাটাকের ঝুঁকির দিক থেকে বিশ্বে এখনও এক থেকে পাঁচের মধ্যে আছে। এদিক থেকে আমরা মোটেও ঝুঁকিমুক্ত নই। সাইবার অ্যাটাকের বিষয়ে এই বছরই আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুই দফায় সতর্কতা জারি করেছে। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশের আওতায় সাইবার নিরাপত্তায় যেসব অবকাঠামো দরকার সেগুলো আমাদের আছে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির পরিচালক (অপারেশন) এবং বাংলাদেশ ই-গভর্নমেন্ট কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিমের (বিজিডি ই-গভ. সার্ট) প্রকল্প পরিচালক তারেক এম বরকতউল্লাহ বলেন, ‘আমরা আগের তুলনায় অনেক বেশি সক্ষম। এটা চলমান রাখতে হবে। সক্ষমতা বেড়ে গেছে বলে কাজ বন্ধ করে দিলেই অপরাধ বাড়বে। যেদিন বাংলাদেশ ব্যাংকে সাইবার অ্যাটাক হয়েছিল, সেদিন সাইবার নিরাপত্তায় বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৮। এখন ৬৫-তে নেমে এসেছে।’ @বাংলা ট্রিবিউন