।। ফারুক মঈনউদ্দীন ।।
প্রত্যেক বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে আমাদের দেশের সাহিত্যাঙ্গনে শুরু হয় নোবেল পুরস্কারের জল্পনা-কল্পনা। কে পাচ্ছেন বিশ্ব সাহিত্যের সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি, সেটা নিয়ে সাহিত্য বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পূর্বাভাস দিয়ে বিদেশী সাহিত্য নিয়ে কম জানা মানুষদের কিছুমাত্রায় শিক্ষিত করে তোলার প্রয়াস পান। ‘বিদেশী সাহিত্য’ একারণেই বলা যে স্বদেশের কোনো লেখক-কবিকে আমাদের দেশের বিশ্লেষকদের কেউই এই পুরস্কার বা পূর্বাভাষের আওতায় আনতে পারেন না বলেই বিদেশী লেখকদের দিকেই তাঁদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে। ধারণা করা যায়, একমাত্র বাংলাভাষী কবি ১০৮ বছর আগে এই পুরস্কারটি পেয়েছিলেন বলেই আশাবাদী না হয়েও এটির প্রতি আমাদের সবার কৌতুহলী দৃষ্টি থাকে। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার না পেলে আমাদের মধ্যে এই পুরস্কার নিয়ে কোনো আগ্রহ থাকত কি না জানি না, হয়তো থাকত, তবে এত ব্যাপকভাবে নয়। একথা বলাও ঠিক হবে না যে পুরস্কারটি পাওয়ার যোগ্য কোনো বাংলাভাষী লেখক রবীন্দ্রনাথের আগে বা পরে জন্মাননি। কিন্তু এই পুরস্কার পাওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি ও প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ড চালাতে হয়, সেটা তেমন গুরুত্বের সাথে কারো বেলায় কখনোই করা হয়নি। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর বিদেশিনী স্ত্রীর বদৌলতে এবিষয়ে কিছু কাজ হয়তো করতে পারতেন, কিন্তু তেমন কিছু করা হয়নি। তাঁর বিদেশীনী স্ত্রী-ও যে কোনো চেষ্টা করেছিলেন, তেমন কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। জীবনানন্দের বহু কবিতা তাঁর জীবদ্দশায় ইংরেজিতে অনূদিত হলেও সেসব তেমন জোরালো প্রচার পায়নি। তবে নোবেল কমিটির মহাফেজখানা থেকে জানা যায় রবীন্দ্রনাথের পর অন্তত দুজন ভারতীয় বাঙালির নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য পাঠানো হয়েছিল। তাঁদের একজনের নামও রবীন্দ্রনাথ, তবে দত্ত (১৮৩৩-১৯১৭)। তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৯১৬ সালে। অক্সফোর্ড থেকে পাশ করে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করতেন তিনি। তিনটি কবিতার বইয়ের উল্লেখ ছাড়া তাঁর সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। আরেকজন ভারতীয় বাঙালির নাম কমপক্ষে তিনবার প্রস্তাব করা হয়েছিল, তাঁর নাম হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৩৪ সালে শান্তি পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন দেবদত্ত ভান্ডারকর এবং এস কে গুপ্ত, দুজনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পরবর্তী সময়ে এঁরাই আবার তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন একজন সাহিত্যে এবং আরেকজন শান্তিতে।
রবীন্দ্রনাথ যদি নিজ উদ্যোগে গীতাঞ্জলীর ইংরেজি তর্জমা না করতেন এবং সেগুলো তাঁর বিদেশি বন্ধুদের নজরে না আনতেন, তিনিও পুরস্কারটি পেতেন কি না, সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ, ভিনদেশি ভাষার লেখা বই বা অন্য সাহিত্যকর্ম নোবেল কমিটি কিংবা প্রস্তাবকদের ইংরেজিতে অনুবাদ করে নেওয়ার কথা নয়। তাঁর পক্ষ হয়ে অনুবাদের এই কাজটি অন্য কেউ করতেন, সেরকম কোনো আভাসও আমাদের সামনে নেই। তাঁর গুটিকয় গল্প ও কবিতা কেউ বিচ্ছিন্নভাবে অনুবাদ করেছিলেন বটে, কিন্তু সেগুলো নোবেল কমিটির কাছে পেশ করার মতো যথেষ্ট ছিল না। একথা সবাই স্বীকার করবেন, কেবল ইংরেজিতে অনুবাদ করাটাই যথেষ্ট নয়, সেই অনুবাদ নিয়ে কাউকে মাঠে নামতে হয়। রবীন্দ্রনাথের হয়ে যেমন মাঠে নেমেছিলেন ইয়েটস কিংবা তাঁর পক্ষ হয়ে কবি স্টার্জ মুর। কারণ, তিনিই নোবেল কমিটির কাছে রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক সুপারিশ করেছিলেন।
ভারত উপমহাদেশের এক কবির ইংরেজিতে অনূদিত কবিতাগুলোসহ তাঁকে ব্রিটিশ পাঠকদের সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে শিল্পী স্যার উইলিয়াম রোদেনস্টাইনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। দুবছর আগে কলকাতায় পরিচিত হওয়া রোদেনস্টাইনের সঙ্গে ২০১২ সালে লন্ডনে আবার দেখা হলে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিজের অনূদিত কবিতাগুলো দেখতে দিয়েছিলেন। কবিতাগুলো দেখে রোদেনস্টাইন এতই চমৎকৃত হয়েছিলেন যে সেগুলো প্রকাশ ও প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। এই উদ্যোগের প্রথম প্রয়াস হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে পরিচিত করানোর উদ্দেশ্যে এক সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে লন্ডনের সাহিত্য জগতের কিছু নামজাদা ব্যক্তিত্বকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন রোদেনস্টাইন। ছোট সেই সুধী সমাবেশে কবি ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। আসরে অন্যান্যদের সাথে উপস্থিত ছিলেন তরুণ কবি এজরা পাউন্ডও। রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং ব্যক্তিত্বের ছটায় মুগ্ধ পাউন্ড শিকাগোভিত্তিক পোয়েট্রি পত্রিকার সম্পাদক হ্যারিয়েট মুনরোর কাছে চিঠি লিখে তাঁর ভাষায় ‘বাংলার খুব বড় কবি’ রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা পাঠিয়েছিলেন। ফলে পোয়েট্রির সেবছরের (১৯১২) ডিসেম্বর সংখ্যায় তাঁর ছয়টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে গীতাঞ্জলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে সেটিতে ইয়েটস যে প্রশংসামূলক ভূমিকাটি লিখেছিলেন, সেটিও রোদেনস্টাইনের অনুরোধে। উল্লেখ্য ইয়েটসকে কবিতাগুলো সম্পাদনার কাজটি করে দিতে অনুরোধ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। তবে ইয়েটস সেগুলোতে খুব কমই হাত লাগিয়েছিলেন, কারণ, তাঁর মতে কবিতাগুলোকে উন্নততর করার কোনো প্রয়োজন এবং অবকাশ নেই।
রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির এসব ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। কিন্তু এসবের উল্লেখ করা একারণেই প্রাসঙ্গিক যে, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য বিশেষ কিছু প্রচারণামূলক ভিত্তি তৈরি করতে হয়। এই হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভাগ্যবান নোবেল বিজয়ীদের একজন, যাঁর নাম বছরের পর বছর ধরে নোবেল কমিটির বিবেচনার জন্য পাঠাতে হয়নি। ইংরেজি ভাষায় অনূদিত কবিতা নিয়ে আত্মপ্রকাশের এক বছরের মাথায় রবীন্দ্রনাথের নাম সুপারিশ করা হয় এবং প্রথমবারেই নোবেল কমিটি সেই সুপারিশ মেনে নিয়ে তাঁকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে। অথচ সেবারের পুরস্কারের জন্য রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে প্রায় বিশ বছরের জ্যেষ্ঠ টমাস হার্ডিও ছিলেন খুব শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী, এবং তাঁর পেছনে ছিল লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি অভ আর্টসের বিরাটসংখ্যক সদস্যের সমর্থন। কিন্তু বাংলাভাষা থেকে সদ্য অনূদিত কবিতাগুলোর সুষমা এবং গভীরতার বিষয়ে তাঁর সুপারিশকারীদের সাথে নোবেল কমিটিও এমনভাবে ঐকমত্য পোষণ করেন যে হার্ডির প্রবল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পুরস্কারটি আধ্যাত্মচেতনায় পরিশীলিত ভারতের এই কবিকে একবারের সুপারিশেই দেওয়ার জন্য মনোনীত করা হয়। বলাবাহুল্য, সেবার অমনোনীত হওয়ার পর হার্ডি আর কখনো পুরস্কারটা পাননি।
অবশ্য একবারের প্রস্তাবে নোবেল পাওয়া কবি-লেখকদের মধ্যে কেবল রবীন্দ্রনাথই নন, আরো অনেকেই প্রথমবার প্রস্তাবিত হয়েই পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছে মার্কিন কথাসাহিত্যিক সিনক্লেয়ার লুইস (১৯৩০), ইতালির কথাসাহিত্যিক, কবি ও নাট্যকার লুইগি পিরানদেল্লো (১৯৩৪), মার্কিন কথাশিল্পী পার্ল বাক, (১৯৩৮), ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল (১৯৫০) এবং হিস্পানি কথাশিল্পী ক্যামিলো হোসে সেলা (১৯৮৯) সহ আরো কয়েকজন।
রবীন্দ্রনাথ আকস্মিকভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যাওয়ায় পশ্চিমের অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন, ব্যাপারটা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি কেউ কেউ। ইয়েটসের সমর্থন ও উদ্যোগের বিষয়েও অনেকের ছিল বিরূপ মনোভাব। কারো মতে রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির ব্যাপারে ইয়েটসের সমর্থনের মূল কারণ ছিল ভারতীয়দের মন থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের প্রতি বিতৃষ্ণা দূর করা। ধারণাটার পক্ষের যুক্তি খুবই নড়বড়ে ও ভিত্তিহীন। যাঁরা এই ধারণা পোষণ করতেন তাঁদের যুক্তি হয়তো এমন ছিল যে, রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির আগে অন্ততপক্ষে একবার ইয়েটসের নাম এই পুরস্কারের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল। সুতরাং নিজের যোগ্যতাকে ছাপিয়ে স্বল্পপরিচিত এক ভারতীয় কবির কবিতার অনুবাদ কী কারণে তিনি পরিমার্জনা করে নোবেল কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণের সুযাগ করে দেবেন? সুতরাং এমন ধারণা পোষণকারীদের যুক্তি যে একেবারেই ফেলনা ছিল, সেটাও বলা যায় না। তবে ধারণা কেবল ধারণাই, তার মধ্যে সবসময় সত্যতা থাকে না। তবে ইয়েটস যে কারণেই রবীন্দ্রনাথের পৃষ্ঠপোষকতা করুন না কেন, দশ বছর পর তিনিও নোবেল পেয়েছিলেন পাঁচ কিংবা ছয়বার প্রস্তাবনার পর।
রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে এ লেখার অবতারনা নয়। প্রতিবছর নোবেল নিয়ে আমাদের এবং নোবেল প্রত্যাশী অন্য দেশের সাহিত্যামোদী মহলের উৎকণ্ঠা, কৌতুহল এবং মনোনয়নের দীর্ঘ তালিকা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের পরিচিত ও অপরিচিত সম্ভাব্য প্রাপকের সফলতার বিষয়ে নানান পূর্বাভাস এবং নোবেল পুরস্কারের পেছনের কিছু জানা-অজানা বিষয় নিয়ে কিঞ্চিত আলোকপাত করাই আপাতত উদ্দেশ্য। প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে আমাদের দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন কাগজের সাহিত্য সাময়িকীতে কমপক্ষে একটি করে লেখা পাওয়া যাবে, যেখানে থাকে সেবছরের সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ীকে(দের) নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ, পূর্বাভাস ও আশাবাদ। যেমন গত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে জাপানের কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামিকে নিয়ে যে ব্যাপক আলোচনা এবং আশাবাদ চলছিল, জাপানের হারুকিভক্তরা সেই তথ্যটা জানলে শ্লাঘা অনুভব করবেন নিশ্চয়ই। জাপানি এই লেখককে নিয়ে আমাদের দেশে যে উন্মাদনা চলছে, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে এখান থেকে বাংলাভাষায় অনুদিত ও প্রকাশিত তাঁর গল্প ও উপন্যাসমালার তালিকা দেখলে। একজন সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ীর এত সংখ্যক বইয়ের বাংলা অনুবাদ ও প্রকাশ আর কারো বেলায় ঘটেনি।
আমাদের দেশেই যদি মুরাকামিকে নিয়ে এমন উচ্ছাস ও আশাবাদ চলতে থাকে, তাহলে খোদ জাপানে কি ঘটে, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। বিশ্বসাহিত্যে পরিচিত জাপানি লেখকের সংখ্যা নেহাত কম নয়, কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে নোবেলপ্রাপ্তিতে জাপানি নাগরিকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হলেও সাহিত্যে দেশটির নোবেল বিজয়ীর সংখ্যা মাত্র দুজন। তিনজন হতে পারত যদি ২০১৭ সালের নোবেল বিজয়ী লেখক কাজুও ইশিগুরো ব্রিটিশ নাগরিক না হতেন। তবু জাপানিরা এই দোশোয়ালি লেখকটিকে বুক ফুলিয়ে জাপানি বলে দাবি করতে দ্বিধা করে না। সুতরাং জাপানে মুরাকামিকে নিয়ে এই আশাবাদ ও উন্মাদনা খুবই স্বাভাবিক একটা জাতীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। কিন্তু ২০০৭ সাল থেকেই জাপান এবং বহির্বিশ্বের অসংখ্য মুরাকামিভক্তের প্রত্যাশা ও আশাভঙ্গ হওয়া যেন প্রতিবছর অক্টোবরের একটা নিয়মিত সূচি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু তিনি পুরস্কারটা কেন পাচ্ছেন না সেটাও এক বিরাট ধাঁধা। একথাও স্বীকার করতে হবে যে পাঠকপ্রিয়তা কিংবা মনোনয়নের সংখ্যা কখনোই নোবেল কমিটির বিবেচ্য বিষয় ছিল না। যদি তা-ই হতো তাহলে অতীতের পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকার চেহারাটা এরকম থাকত না।
নোবেল কমিটির মহাফেজখানার ভেতরের তথ্যগুলো প্রকাশ করা হয় প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পঞ্চাশ বছর পর। যেমন ১৯৬৭ সালের নোবেল পেয়েছিলেন গুয়েতেমালার কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার মিগেল আনহেল আসতুরিয়াস (১৮৯৯Ñ১৯৭৪)। তার পঞ্চাশ বছর পর (২০১৭) নোবেল কমিটির প্রকাশ করা দলিল থেকে দেখা যায় সেবছর মোট সত্তর জনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। এঁদের মধ্যে আসতুরিয়াস ছাড়াও ছিলেন লুই আরাগঁ, ডব্লিউ এইচ অডেন, স্যামুয়েল বেকেট, সল বেলো, বোর্হেস, ফরস্টার, গ্রাহাম গ্রিন, কাওয়াবাতা, আঁদ্রে মালরোঁ, ইউকিউ মিশিমা, মোরাভিয়া, নেরুদা, এজরা পাউন্ড। তবে এতগুলো যোগ্য নামের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন বোর্হেস, আসতুরিয়াস, গ্রাহাম গ্রিন, ডব্লিউ এইচ অডেন এবং ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা। জানা যায়, নোবেল কমিটির মধ্যে দ্বিধাবিভক্তির কারণেই আসতুরিয়াসের পথ সুগম হয়ে যায়। তবে পরবর্তী সময়ে এঁদের মধ্যে কেবল বেকেট ১৯৬৯, সল বেলো ১৯৭৬ আর কাওয়াবাতা পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৬৮ সালে।
নোবেল কমিটির অর্ধশতাব্দীর গোপনীয়তার কারণে ১৯৭০ সালের পর ঘোষিত পুরস্কারের মনোনয়ন সংক্রান্ত কোনো তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তাই বছরের পর বছর মুরাকামি, মিলান কুন্দেরা কিংবা নগুুগির পুরস্কার না পাওয়া এবং তাঁদের মনোনয়ন ও প্রস্তাবনা বিষয়ক কোনো সঠিক তথ্য এখনো সুলভ নয়। ১৯৭০ সালের আগে ঘোষিত নোবেল মনোনয়ন ও পুরস্কারপ্রাপ্তি সম্পর্কে যা কিছু তথ্য পাওয়া যায়, তাতে ওপরের তিনজনের পুরস্কার না পাওয়াটা প্রায় নিয়মে পরিণত হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে তাঁদের সমর্থক ও ভক্তরা হয়তো কিছু সান্তনা খুঁজে পেতে পারেন।
আমরা জানি, নোবেল পুরস্কার প্রবর্তিত হওয়ার (১৯০১) পর আরো দশ বছর বেঁচে ছিলেন তলস্তয়, ১৯০২ থেকে ১৯০৬ পর্যন্ত প্রতিবছর তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, কিন্তু তাঁকে দেওয়া হয়নি। যার মূল কারণ হিসেবে ধারণা করা যায় তলস্তয়ের রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় মতাদর্শের প্রতি কমিটির বিচারকমণ্ডলির সদস্যদের বিরূপ মনোভাব কিংবা সুইডেনের এবং রাশিয়ার মধ্যকার ঐতিহাসিক বৈরি সম্পর্ক। নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে ১৯৩১ থেকে শুরু করে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বছর (২৫ বার) প্রস্তাব করা হয়েছিল স্পেনীয় ভাষাবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ র্যামন মেনেনদেস পিদাল-এর (১৮৬৯Ñ১৯৬৮) নাম, কোনো এক বছরে তাঁর নাম প্রস্তাবকারীর সর্বোচ্চ সংখ্যা ছিল ১৬০ জন। কিন্তু নোবেল কমিটির মন গলেনি। কিংবা ১৯৪৭ থেকে ৭০ সালের মধ্যে ফরাসি ঔপন্যাসিক আঁদ্রে মালরোঁর (১৯০১-৭৬) নাম প্রস্তাবিত হয়েছিল বিশ বার, তাঁকেও নোবেল কমিটি যোগ্য মনে করেনি। ড্যানিশ লেখক জোহানেস জেনসেনের (১৮৭৩-১৯৫০) নাম ১৯২৫ সাল থেকে মোট আঠার বার প্রস্তাব করার পর ১৯৪৪ সালে তাঁর ভাগ্যে নোবেলের শিকে ছিঁড়েছিল। আবার ইতালিয় ঔপন্যাসিক আলবার্তো মোরাভিয়ার (১৯০৭-১৯৯০) নাম ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে ১৬ বছর ধরে প্রস্তাব করা হলেও তাঁকে দেওয়া হয়নি। আমরা ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ই এম ফরস্টারের (১৮৭৯-১৯৭০) দুর্ভাগ্যের কথা বলতে পারি। ১৯৪৫ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে তাঁর নাম বিশ বার প্রস্তাব করা হয়েছে, কিন্তু নোবেল বিচারকদের সন্তুষ্ট করা যায়নি। নোবেল মনোনয়নে প্রথমবারের মতো উঠে আসা মিশরিয় লেখক তাহা হুসেনকে (১৮৮৯-১৯৭৩) ১৯৪৯ থেকে তেরো বার মনোনয়ন দেওয়া হলেও তিনি পাননি। পাননি আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্ট (১৮৭৪-১৯৬৩) ১১ বার, কিংবা গ্রাহাম গ্রিন (১৯০৪-১৯৯১) ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে ১৫ বারের প্রস্তাবের পরও। ব্রিটিশ কবি এজরা পাউন্ডের নাম ১২ বার প্রস্তাব করা হলেও তাঁকে দেওয়া হয়নি। হোর্হে লুই বোর্হেসের নামও প্রস্তাব করা হয়েছে কমপক্ষে নয় বার। অনেকবারের মনোনয়নের পর যাঁরা অবশেষে পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে আলবেয়র ক্যামু সপ্তমবারের পর ১৯৫৭ সালে, জন স্টাইনবেক ১৯৪৩ সাল থেকে নয় বছরের প্রস্তাবের পর ১৯৬২ সালে, উইনস্টন চার্চিল পেয়েছেন সপ্তমবারের প্রস্তাবের পর ১৯৫৩ সালে, নেরুদা পেয়েছিলেন ১২তম বছরের প্রস্তাবের পর ১৯৭১ সালে। জাঁ পল সার্ত্রে আটবারের মনোনয়নের পর ১৯৬৪ সালে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তিনি সেটা প্রত্যাখ্যান করেন। নোবেলের ইতিহাসে এটাই একমাত্র সত্যিকার প্রত্যাখ্যানের ঘটনা।
নোবেল পুরস্কার পাওয়া-না পাওয়ার এই দীর্ঘ উদাহরণ বিবেচনা করলে বছরের পর বছর ধরে মুরাকামি, মিলান কুন্দেরা কিংবা নগুগির সম্ভাবনা ঝুলে থাকার বিষয়টাকে আত্মস্থ করে নেওয়া সহজ হবে। বলা বাহুল্য ২০২১ সালের নোবেলের জন্যও মুরাকামির বিষয়ে তাঁর ভক্তদের আশা জাগ্রত ছিল। লন্ডনভিত্তিক জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠান ল্যাডব্রোকসও মুরাকামির বছরের পর বছরের অপ্রাপ্তির হতাশায় হাল ছেড়ে দেয়নি, তবে তাঁর নামটা ছিল দ্বিতীয় স্থানে। কানাডার মার্গারেট অ্যাটউডও ছিলেন একই কাতারে। বেসবল খেলা দেখতে গিয়ে খেলার মাঠে এক মুহূর্তের ভাবনায় লেখক হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর পাঠকভাগ্যে সরস্বতী ও লক্ষ্মীকে একই সাথে পেয়েছেন মুরাকামি, লাভ করেছেন বহু সম্মাননা ও পুরস্কার, তবু সাহিত্যের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতির পুরস্কারটা তাঁর কপালে জোটেনি এখনো। গত কয়েক বছর ধরে মুরাকামিভক্তরা নোবেল পুরস্কার ঘোষণার দিন তাঁর উপন্যাসের চরিত্রদের মতো সাকে নয়, বিয়ার বা স্কচের গ্লাস হাতে নিয়ে টেলিভিশনের সামনে বসে থাকেন, নোবেল কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর অগনিত ভক্তের উৎকণ্ঠার হৃদস্পন্দন পৌঁছায় না। একই ঘটনা ঘটে আসছিল বোর্হেসের বেলায়, প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার ঘোষণার দিন জনতা এবং সাংবাদিকেরা তাঁর বাড়ির সামনে গিয়ে জড়ো হতো, আর হতাশ হয়ে ফিরে আসত। বোর্হেস বলতেন, ‘এটা একটা পুরনো স্ক্যান্ডিনেভিয় রীতি, ওরা আমাকে মনোনয়ন দেয়, আর পুরস্কারটা দিয়ে ফেলে অন্য কাউকে, এটাই একধরনের আচার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
বহুবার প্রস্তাব করার পরও যাঁরা নোবেল পান না, তাদের না পাওয়ার কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন মহলের নানান মতামত থাকে। তেমনই এক মহলের ধারণা, নোবেল না পাওয়ার জন্য বোর্হেসের রক্ষণশীল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীই ছিল প্রধান কারণ, আরো খোলাসা করে বললে, বন্ধুদের নিষেধ সত্ত্বেও চিলির স্বৈরশাসক পিনোচেটের কাছ থেকে রাষ্ট্রিয় সম্মান গ্রহণ করতে রাজি হওয়ার কারণেই তাঁকে পুরস্কারটা দেওয়া হয়নি। নোবেল কমিটির এক সদস্য আর্তুর লান্ডকভিস্ট, যিনি পাবলো নেরুদার বন্ধুও ছিলেন, তিনিই খুব জোরালোভাবে বোর্হেসকে এই পুরস্কার দেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন। আর্তুর বলেছিলেন যে পিনোচেটের কাছ থেকে সম্মাননা গ্রহণ করার জন্য বোর্হেসের ব্যাপারে ভেটো দেবেন তিনি। তিনি এমনও বলেছিলেন যে তিনি বোর্হেসের ভক্ত, এমনকি তাঁর লেখা অনুবাদও করেছেন, কিন্তু একটা ফ্যাসিস্ট শাসনের ব্যাপারে তাঁর মারাত্মক রাজনৈতিক ভুল তাঁকে নৈতিক ও মানবিক বিচারে নোবেল পুরস্কারের অযোগ্য করে তুলেছে। (বার্টন ফেল্ডম্যান: দ্য নোবেল প্রাইজ: অ্যা হিস্ট্রি অভ জিনিয়াস, কনট্রোভার্সি অ্যান্ড প্রেস্টিজ)
বোর্হেসের প্রতি আর্তুরের এই মনোভাবের কথা উঠে এসেছে এডউইন উইলয়ামসনের লেখা বোর্হেস: অ্যা লাইফ জীবনীগ্রন্থে। তিনি লিখেছেন বোর্হেসের জন্য যতবারই প্রস্তাব এসেছে প্রতিবারই তার বিরোধিতা করেছেন আর্তুর। পরবর্তী সময়ে বোর্হেসের আরেক জীবনীকার চিলির কমিউনিস্ট পার্টির একসময়ের সভাপতি ভলোদিয়া তাইতেলবৌমকে আর্তুর লান্ডকভিস্ট বলেছিলেন যে জেনারেল পিনোচেটকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়ার কারণে বোর্হেসকে তিনি কখনোই ক্ষমা করবো না। (টাইলার কোয়েন, মার্জিনাল রেভল্যুশন, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৪)
আমাদের দেশে প্রতিবছর সাহিত্যে নোবেল নিয়ে যে জল্পনা-কল্পনা চলে, তার পেছনে সম্ভাব্য বিজয়ীদের সাহিত্যকর্মের সাথে বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখা সাহিত্যামোদীদের কারো কারো অল্পবিস্তর পরিচিতির উপাদান থাকে বটে, তবে লন্ডনভিত্তিক জুয়ার প্রতিষ্ঠান ল্যাডব্রোকস-এর বাজীর পূর্বাভাস থেকে ধারণা নিয়ে উইকিপিডিয়ার সাহায্যে সম্ভাব্য বিজয়ীদের জীবন, সাহিত্য ও সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করা এখন সহজতর। আদিতে ঘোড়ার রেসের বাজী ধরার জন্য ১৮৮৬ সালে চালু হয়েছিল ল্যাডব্রোকস। দীর্ঘ চলার পথে ব্যবসায়িক লোকসান ও মন্দার প্রেক্ষিতে ১৯৬৩ সালে তারা ঘোড়দৌড় ও ফুটবলের বাইরে জাতীয় নির্বাচন এবং আরো বিভিন্ন ভবিষ্যত ঘটনার ওপর বাজী ধরার সুযোগ চালু করে।
বাজী ধরার এই ইতিহাস যে উনিশ শতকের শেষে ব্রিটেনেই চালু হয়েছিল তা নয়, আরো প্রায় তিনশ বছর আগে রোমে পোপ নির্বাচনের বিষয়েও বাজী ধরার রীতি চালু ছিল। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এরকম আরেকটি প্রতিষ্ঠান ছিল, উইলিয়াম হিল। ১৯৬৪ সালে ডেভিড থ্রেলফল নামের এক যুবক সেই দশকের মধ্যেই চাঁদে মানুষ নামবে, এই সম্ভাবনার ওপর উইলিয়াম হিল কোম্পানির সাথে ১০ পাউন্ড বাজী ধরে জিতে নিয়েছিল দশ হাজার পাউন্ড। বাজীর বিষয়টা এতই অবিশ্বাস্য ছিল প্রথমে এই বাজীর দর ছিল ১০০০/১, অর্থাৎ এক পাউন্ডের বিপরীতে এক হাজার। ডেভিডের এই বাজী ধরার কাহিনী চাউর হয়ে যায়, ফলে দলে দলে জুয়াড়িরা চন্দ্রাভিযানের ওপর বাজী ধরে উইলিয়াম হিল কোম্পানিতে। পরের বছরগুলোতে মহাশুন্যাভিযানে আমেরিকা ও রাশিয়া বিশেষ সফলতা অর্জন করলে বাজির হার ১৫০/১ থেকে ১০০/১ হয়ে শেষপর্যন্ত এক অংকে নেমে আসে। অবশেষে ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো ১১ সফলভাবে চাঁদে নামার পর উইলিয়াম হিল কোম্পানিকে ডেভিডের বাজীর ১০ হাজার ১০ পাউন্ড (বর্তমানের হিসেবে যা প্রায় এক লক্ষ পাউন্ডেরও বেশি) পরিশোধ করতে হয়েছিল। বাজীর দর কমে এলেও সেবছর সফল চন্দ্রাভিযানের কারণে এই কোম্পানিকে বেশ ভারি লোকসানের বোঝা বইতে হয়েছিল। তাই উইলিয়াম হিল কোম্পানির কাছে প্রতিভাত হয়, ঘোড়দৌড় আর ফুটবলের বাজীর বাইরে এসে ব্যবসা করা সমীচীন হয়নি। অবশ্য পরবর্তী সময়ে এজাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভাব্য প্রায় সব বিষয়ের ওপর জুয়ার ব্যবসা ছড়িয়ে পূর্বাভাস বিশ্লেষণের কাজে নানান বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দিয়ে বাজীতে জেতার সম্ভাবনাকে আরো বিজ্ঞানস্মত করার চেষ্টা করে। এবিষয়ে ল্যাডব্রোকসই সবচেয়ে এগিয়ে।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের মতো বিষয়ের সাথে জুয়াড়িদের জড়িত হওয়াটা খুব বিসদৃশ মনে হতে পারে। ল্যাডব্রোকস এই পুরস্কারের জন্য বাজী ধরার ব্যবস্থা চালু করেছে খুব বেশি দিন হয়নি, বছর বিশেকেরও কম। তার পর থেকে চলে আসছে এই জুুয়াকেন্দ্রিক নোবেল পূর্বাভাস।
ল্যাডব্রোকসের হিসাব-নিকাশ এবং ভবিষ্যদ্বাণী যে কেবল বাজী ধরা জুয়াড়িদের আকর্ষণ করে তা নয়, নোবেল পুরস্কার নিয়ে আগ্রহী সাহিত্যবোদ্ধাদেরও প্রভাবিত করে। সেকারণেই আমাদের দেশে নোবেল পুরস্কারের পূর্বাভাস নিয়ে সম্ভাব্য ভিনদেশি নোবেল বিজয়ীদের নিয়ে গুরুগম্ভীর লেখা প্রকাশিত হয়, যাঁদের লেখা পড়া দূরে থাক, তাঁদের নামও শোনা যায়নি কখনো। জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্বাভাস নোবেল কমিটির সদস্যদের বিচারকর্মেও প্রভাব বিস্তার করে কি না, সে সন্দেহ একবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও এখানে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম প্রধান এক লেখকের জুয়ায় মারাত্মক আসক্তির কথা উল্লেখ করা যায়, তিনি হচ্ছেন ফিওদর দস্তয়ভস্কি। তাঁর বয়স যখন ৪২ বছর, জুয়ায় মারাত্মকরকম আসক্ত হয়ে একসময় সর্বস্বান্ত অবস্থায় ঋণের বোঝায় তলিয়ে যাওয়া থেকে উঠে আসার জন্য অর্থের প্রয়োজনে প্রকাশকের সাথে একটা উপন্যাস লেখার চুক্তি করেছিলেন তিনি। চুক্তির শর্ত এমন ছিল যে, তিনি যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উপন্যাসটা শেষ করতে না পারেন, তাহলে আগামি নয় বছরে লেখা দস্তয়ভস্কির সব উপন্যাস প্রকাশের অধিকার অর্জন করবে প্রকাশক। মুচলেকার মতো এই চুক্তির বদৌলতেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লেখা হয়েছিল রুলেৎ খেলায় হারতে হারতে অধঃপাতে যাওয়া এক রুশ যুবক আলেক্সিস ইভানোভিচের জীবনকাহিনী নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস জুয়াড়ি।
ল্যাডব্রোকসের মতো প্রতিষ্ঠান সাহিত্যে সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ীদের কীভাবে মূল্যায়ন করে, সে বিষয়ে মানুষের কৌতূহল থাকতে পারে। যিনি বা যাঁরা সম্ভাব্য লেখকদের হ্রস্ব তালিকা তৈরি করেন এবং তাঁদের পুরস্কারপ্রাপ্তির সম্ভাবনার সাথে মিলিয়ে বাজীর দর ঠিক করেন, তাঁরা কতখানি সাহিত্য বোদ্ধা, কিংবা অন্ততপক্ষে আদৌ পাঠক কি না– সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবু আমরা বিশ্বাস করতে চাই, তাঁদের কেউ হয়তো ব্যক্তিগত আগ্রহে বিশ্ব সাহিত্য সম্পর্কে কিঞ্চিত খোঁজখবর রাখেন, এমনকি কেউ বা হতে পারেন সখের লেখক বা কবি, যদিও এই গুন থাকা তাঁদের দায়িত্বের পূর্বশর্ত নয়, বাধ্যতামূলকও নয়। বরং নোবেল পাওয়ার যোগ্য সম্ভাব্য লেখকদের তালিকা করার জন্য ল্যাডব্রোকসের বুকিরা সেইসব লেখকদের বইপত্র পড়েন, এমন ভাবনা একবারেই অমূলক। তাঁদের হিসাবনিকাশের ভিত্তি হচ্ছে বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্য, নানান অনলাইন ফোরাম এবং ইন্টারনেট চষে পাওয়া সবধরনের ভাষ্য, মূল্যায়ন ও গ্রন্থ আলোচনা, বিভিন্ন সামাজিক ও সংবাদ মাধ্যমের চলমান মন্তব্য ও বিশ্লেষণ, লেখকের পাওয়া পুরস্কারের ইতিহাস ইত্যাদি। কেবল তা-ই যথেষ্ট নয়, তাঁদের মাথায় রাখতে হয় নানান হিসাব ও সমীকরণ। লেখকের শক্তিমত্তা, গুণাবলী এবং তাঁদের রচনার গুণগত মান বিচারের চেয়েও তাঁরা বেশি প্রয়োগ করেন বিভিন্ন গল্পগুজব, আগের কয়েক বছরগুলোর পুরস্কারের প্রবণতা, লেখকের জাতীয়তা ও বর্ণ, বাজী ধরা মানুষের মনোভাব ও প্রবণতাÑ ইত্যাদি নানান ধরণের গাণিতিক হিসাব। যেমন ২০১১ সালের সম্ভাব্য পুরস্কারের তালিকায় নগুগি থাকলেও খুব ওপরের দিকে ছিলেন না, ল্যাডব্রোকসের হিসেব অনুযায়ী সে বছর আফ্রিকার কাউকে দেওয়া হবে না। ওদের হিসাব ঠিকই ছিল, সেবার পেয়েছিলেন সুইডিশ কবি ট্রান্সটোমার, যদিও ল্যাডব্রোকসের পূর্বাভাষ ছিল সিরিয়ার কবি এদোনিস। কিংবা ২০১৭ সালে নগুগি, মুরাকামি, এদোনিস, জয়েস ক্যারল ওটস ছিলেন অগ্রগামী, কিন্তু সব পূর্বাভাষ মিথ্যে করে দিয়ে সেবার পুরস্কার পেয়েছিলেন জাপানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ইশিগুরো।
আবার অন্যভাবে দেখলে ল্যাডব্রোকসের পূর্বাভাষ যে সবসময় ঠিক হয় না, তার নজিরও আছে। ২০০৪ থেকে ২০১২ পর্যন্ত একমাত্র ২০০৬ সালে তুরস্কের ওরহান পামুকের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী ছাড়া আর কোনোটিই মেলেনি। এখানে ল্যাডব্রোকস কিংবা অন্য কোম্পানির ব্যবসার একটা সহজ গোমর বুঝতে হবে। কোনো বিশেষ লেখকের ওপর বাজী ধরা মানুষের সংখ্যা বেশি হলে, খাটানো টাকা এবং তার বিপরীতে জেতা টাকার পার্থক্য (জুয়ার ভাষায় ইংরেজিতে যাকে ‘অডস’ বলা হয়) কম রাখা হয়। আবার কম সম্ভাবনা থাকলে তাদের জন্য প্রলোভনটা বেশি দেখানো থাকে। যেমন ২০২০ সালে স্টেফান কিংয়ের জন্য ৫০/১, কিংবা একটিমাত্র উপন্যাসের লেখক রিচার্ড ওসমান নামের একজনের জন্য ছিল ১০০/১। বেশি মানুষের বাজী ধরা লেখক পুরস্কার পেয়ে গেলে কোম্পানির লাভ কমে যাবে, তাই সম্ভাবনা আছে এমন লেখকদের বেলায় বাজীর হার বা ‘অডস’ কমিয়ে দেওয়া হয়। এটা সহজবোধ্য একটা ব্যবসায়িক হিসাব। সুতরাং ল্যাডব্রোকসের ভবিষ্যদ্বাণী এবং বাজীর প্রতিশ্রুত অংকের সাথে নোবেল পুরস্কার পাওয়া লেখকের যোগ্যতা ও ক্ষমতার বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই।
জাপানের পাশাপাশি আমাদের দেশেও মুরাকামির ব্যাপারে আশাবাদ এখনো একেবারেই তিরোহিত হয়নি। তাঁর সাথে আরো যে কজন সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ীকে নিয়ে জল্পনাকল্পনা আছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন কেনিয়ার নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার মিলান কুন্দেরা। জানা যায় ২০১৬ সালে নগুগির নাম প্রায় নিশ্চিত ছিল। ল্যাডব্রোকসের হিসাবে মুরাকামির নাম ছিল দ্বিতীয় আর সিরিয়ার কবি এদোনিস ছিলেন তৃতীয় স্থানে। কিন্তু সব ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যে প্রমাণ করে সেবার বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো নেমে এসেছিলেন আমেরিকার পপ শিল্পী বব ডিলান। ল্যাডব্রোকসের তালিকায় তাঁর নামও ছিল। প্রথমে তাঁর নামে দান ধরা হয় ১০০/১ হারে। প্রায় অকল্পনীয় বলেই ধরা হয় এই উচ্চহার, তবে পরবর্তী সময়ে এটা নেমে দাঁড়ায় ৫০/১। একজন গীতিকার ও পপশিল্পীর নোবেলপ্রাপ্তিতে সারা বিশ্ব হতবাক হয়ে গিয়েছিল সেবছর। বব ডিলানের এই অভাবনীয় ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে নোবেল বিজয়ী প্রথম আফ্রিকান ওলে সোইনকা ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, “আমার নাটকের জন্য বেশ কিছু গান লিখেছি বলে আমি চাই আমাকেও গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হোক।” উল্লেখ্য টনি মরিসনের পর আরেকজন মার্কিন নাগরিকের এই পুরস্কার পাওয়ার জন্য ২৩ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। নগুগিও হয়তো এতদিনে আশা ছেড়ে দিয়েছেন। বছরের পর বছর তাঁর নামে মনোনয়ন পাঠানো হলেও পুরস্কারটা না পাওয়ার বিষয়ে ২০২০ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “গত পাঁচ বছর ধরে প্রতিবার এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয় আমাকে, সুতরাং এতদিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমি। তবে যা উপভোগ করি সেটার নাম দিয়েছি ‘হৃদয়ের নোবেল’। কেউ একজন আমার বই পড়ে আমাকে এসে বলে, আপনার বই আমাকে এভাবে কিংবা ওভাবে প্রভাবিত করেছে। হৃদয়ের নোবেলের সৌন্দর্য হচ্ছে এটা খুব গণতান্ত্রিক, সব লেখকের জন্যই সুলভ।” (এনপিআর ১২ মার্চ, ২০১৯)
নোবেল পুরস্কার নিয়ে এরকম দুর্ঘটনা, সমালোচনা ও বিতর্ক বিরল নয়। যেমন ১৯৭৪ সালে গ্রাহাম গ্রিন, নবোকভ ও সল বেলোর নাম প্রস্তাব করা হলেও যৌথভাবে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছিল ঔপন্যাসিক ও গল্পকার এইভিনড জনসন (১৯০০-১৯৭৬) এবং কবি হ্যারি মার্টিনসনকে (১৯০৪-১৯৭৮)। কাকতালীয়ভাবে দুজনই সুইডেনের নাগরিক এবং আরো বিস্ময়কর হচ্ছে দুজনই নোবেল পুরস্কারের জন্য গঠিত সুইডিশ একাডেমির কমিটির ১৮ সদস্যের দুজন। তাঁদের মনোনয়নের বৃত্তান্ত জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ২০২৪ কিংবা ২৫ সাল পর্যন্ত। তবে নোবেল কমিটির এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্কের ঝড় ওঠে। এই ঘটনার পর প্রায় নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন মার্টিনসন, চারপাশের এত ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ও সমালোচনা বইতে পারছিলেন না তিনি। পুরস্কার পাওয়ার চার বছর পর স্টকহোমের এক মানসিক হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় কাঁচি দিয়ে নিজের পেট চিরে হারিকিরির কায়দায় আত্মহত্যা করেছিলেন আশৈশব অনাথ ও দুঃখের জীবনসংগ্রামী এই কবি। স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রায় ৪৩ বছর আগে এক প্রকাশক ও বন্ধুর কাছে তিনি লিখেছিলেন, “ভেতরে ভেতরে আমি দুরারোগ্যভাবে বিষণ্ণ, স্মৃতি থেকে ক্রমপলায়নপর অতিস্পর্শকাতর নিয়তিচালিত এক মানুষ। … আমার পরিবারের নির্মম পরিণতি এবং আমার ভগ্ন শৈশব অস্থিরতার যে পটভূমি তৈরি করেছে, কোনো একদিন সেটাই খুন করবে আমাকে।” (ডেভিড টাইটেলম্যান: দ্য সাইকোঅ্যানালাইটক কোয়ার্টারলি, সংখ্যা ৯০, ২০২১)।
আমেরিকার ঔপন্যাসিক জন স্টাইনবেক (১৯৬২) পুরস্কার পাওয়ার পর সমালোচনার ঝড় উঠেছিল যে তিনি নোবেল পাওয়ার মতো বড় লেখক নন। এমনকি পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তিনি নিজেকে এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করেন কি না। তিনি জবাবে বলেছিলেন, “অকপটে বললে, না।” পঞ্চাশ বছর পর প্রকাশ করা নোবেল কমিটির মহাফেজখানার দলিলপত্র থেকে জানা যায়, সেবছর তাঁকে দেওয়া হয়েছিল নোবেল কমিটির অনিচ্ছা সত্ত্বেও, কারণ, বাকি যাঁদের নাম হ্রস্বতালিকায় ছিল তাঁরা ছিলেন আরো অযোগ্য।
বিতর্ক ছিল ২০১৯ সালে পুরস্কার পাওয়া অস্ট্রিয়ান ঔপন্যাসিক কবি ও নাট্যকার পিটার হান্ডকে সম্পর্কেও। লেখক ও সাংবাদিক পিটার মাস এক লেখায় জানান মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বসনিয়ার যুদ্ধের ভয়াবহতা অস্বীকার করে হান্ডকে লিখেছেন কমপক্ষে আধা ডজন বই। এমনকি যুদ্ধাপরাধে বিচারাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী সার্বিয়ান নেতা স্লোবোদান মিলোসেভিচের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কেবল উপস্থিতই ছিলেন না হান্ডকে, তাঁর জন্য শোকবার্তাও তৈরি করেছিলেন। এরকম একজন মানুষকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করার জন্য তিরস্কার করে মাস লিখেছেন, এটা হাস্যকর ও নির্মম যে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা পুরস্কার গোপনে নিয়ন্ত্রণ করে সুইডিশদের একটা দল যারা কেবল যৌন হয়রানির সহযোগীই নয়, গণহত্যা অস্বীকার করারও সমর্থক। (দ্য ইন্টারসেপ্ট, ৭ অক্টোবর, ২০২০)
নোবেল কমিটির জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর সময় এসেছিল ২০১৭ সালের শেষে, যখন সুইডিশ অ্যাকাডেমির সদস্য কবি কাতারিনা ফ্রস্টেনসনের স্বামী আলোকচিত্র শিল্পী জাঁ ক্লদ আর্নল্টের বিরুদ্ধে যৌন হযরানির অভিযোগ ওঠে। সুইডেনের প্রভাবশালী পত্রিকা দাগেনস নেইয়েত্তার [ডেইলি নিউজ] সে বছরের নভেম্বর মাসে আর্নল্টের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১৮ জন নারীর অভিযোগ সম্বলিত একটা মারাত্মক রিপোর্ট প্রকাশ করে। আরো প্রকাশ পায় যে তাঁর যৌন হয়রানি থেকে সুইডেনের রাজসিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী রাজকুমারী ভিক্টোরিয়াও রেহাই পাননি। আর্নল্ট ছিলেন সুইডিশ অ্যাকাডেমির অর্থসাহায্যপুষ্ট সংস্কৃতি কেন্দ্রের প্রধান এবং অ্যাকাডেমির প্রভাবশালী একজন, যে কারণে তাঁকে এই প্রতিষ্ঠানের উনিশতম সদস্য নামে অভিহিত করা হতো। তাঁর বিরুদ্ধে কমপক্ষে সাতবার নোবেল বিজয়ীর নাম আগেভাগে প্রকাশ করে দেওয়ার অভিযোগও ছিল। নাম প্রকাশ করার এই অভিযোগের পরোক্ষ সত্যতা প্রমাণিত হয় যখন ল্যাডব্রোকস আমেরিকান পপ শিল্পী বব ডিলানের নামে বাজী ধরে। অসম্ভব এই পূর্বাভাসের সূত্র ছিল নোবেল কমিটির ফাঁস করা গোপন তথ্য। আর্নল্ট দম্পতির বিরুদ্ধে আর্থিক অসদাচরণের অভিযোগ থাকলেও সেসব কখনো আমলে নেওয়া হয়নি। অবশেষে ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে সাত বছর আগের এক ধর্ষণ মামলার রায়ে আর্নল্টের দুই বছরের সাজা হওয়ার পর সুইডিশ অ্যাকাডেমি নড়েচড়ে বসে। সদস্যদের মধ্য থেকে আর্নল্টের স্ত্রী ফ্রন্টেনসনকে বহিষ্কারের দাবি উঠলেও তিনি পদত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। ফলে অন্যান্য সদস্যদের কেউ কেউ পদত্যাগ করেন, বাকিরা অ্যাকাডেমির কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন। প্রায় ধ্বংস হওয়া ভাবমূর্তি নিয়ে অ্যাকাডেমি সেবছরের নোবেল পুরস্কার স্থগিত করে দিয়েছিল। আর্নল্টের বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারি এবং অসদাচরণের এতসব অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সুইডিশ অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার অনীহার কারণে প্রতিষ্ঠানটির ভেতরের সততা এবং সুশাসন মারাত্মক প্রশ্নের মুখে পড়ে। নোবেল কমিটি যে ইউরোপকেন্দ্রিক এবং পুরুষতান্ত্রিক, এই অভিযোগ স্বীকার করে অ্যাকাডেমির সভাপতি বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাতে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি পুরোপুরি উদ্ধার করা যায়নি।
নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে একমাত্র নোবেল বিজয়ী কবি ইয়ারোশ্লাভ সেইফার্ত (১৯৮৪) ছাড়া আর কেউ নেই। কাফকার ভাগ্যে জোটেনি, আরেকজন যোগ্য চেক নাগরিক মিলান কুন্দেরার বয়স এখন বিরানব্বই, তাঁর নোবেলের সম্ভাবনা হয়তো আর নেই। ২০২১ সালের ল্যাডব্রোকসের বাজীতে তাঁর যা অবস্থান ছিল, তাতে বোঝা যায় আরো অনেকের মতো তাঁকেও বঞ্চনা নিয়েই বিদায় নিতে হবে। সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর একদা চেক নাগরিকত্ব হারানো কুন্দেরার গায়ে এখন আর কমিউনিজমের কোনো কলঙ্ক নেই। অথচ স্নায়ুযুদ্ধের সময় রাশিয়ার সরকার বিরোধী লেখক বরিস পাস্তেরনাককে বহু নাটকের পর পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ১৯৫৮ সালে ডক্টর জিভাগো প্রকাশিত হওয়ার পর। শোনা যায় মার্কিন সরকার এবং সিআইএ এই বইটি প্রচারের জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিল, এমনকি রুশ ভাষায় প্রকাশের ব্যবস্থাও করেছিল তারা, যাতে আমেরিকায় পলাতক রুশভাষীদের মধ্যে বইটা বিতরন করা যায়। তবে রাশিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে মার্কিন সরকারের তৎপরতা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না পাস্তেরনাকের। তাঁর ছেলে ইয়েভগেনি পাস্তেরনাকের ভাষ্য অনুযায়ী, মার্কিন তৎপরতা সম্পর্কে জানার পর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তাঁর বাবা। তিনি এমনও বলেছিলেন যে কারো কোনো সমর্থন ছাড়াই এমনিতে ১৯৫৯ সালে পুরস্কারটা পেতেন তাঁর বাবা। তাঁর এই বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হয়, যখন দেখা যায় তাঁর ১৯৪৬ সাল থেকে টানা পাঁচ বছর তাঁর নামে মনোনয়ন পাঠানো হয়েছিল। তারপর সাত বছরের ব্যবধানে আবার তাঁর নাম প্রস্তাব করা হলে সপ্তমবারের পর পুরস্কারটা তাঁকে দেওয়া হয়। তবে সেটা গ্রহণ করতে যাওয়া হয়নি তাঁর, দেশে ফিরতে না পারার অনিশ্চয়তায় এবং সোভিয়েত সরকারের চাপে তিনি এই পুরস্কার গ্রহণে অপারগতা জানান, যা ছিল প্রত্যাখ্যানের নামান্তর। পুরস্কার ঘোষণার দুই বছরের মধ্যে পাস্তেরনাক মারা যান। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে ‘পেরেস্ত্রইকা’ ও ‘গ্লাসনস্ত’-এর জমানা শুরু হলে ত্রিশ বছর পর ডক্টর জিভাগো খোদ রাশিয়া থেকে প্রকাশিত হয়। এসময় ইয়েভগেনি অসলো গিয়ে পিতার পক্ষে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। পুরস্কার ঘোষণার ত্রিশ বছর পর সেই পুরস্কার গ্রহণ করার এমন দৃষ্টান্ত বিরল। তবে সোলঝিনিৎসিনের নোবেল পুরস্কার (১৯৭০) পাওয়াটা যে স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত বিরোধিতার রাজনীতিপ্রসূত সেটা বরং অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। কারণ, মাত্র দ্বিতীয়বারের প্রস্তাবের পরই পুরস্কারটা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। তবে পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য স্টকহোম যাননি তিনি। তিনি চেয়েছিলেন মস্কোর সুইডিশ দূতাবাসে জনসমক্ষে পুরস্কারপ্রদান অনুষ্ঠানটা করা হোক, কিন্তু সুইডেন সরকারের শর্ত ছিল সেটা হতে পারে, তবে জনসমক্ষে নয়। কিন্তু সোলঝিনিৎসিন লোকচক্ষুর আড়ালে প্রায় গোপনভাবে পুরস্কার গ্রহণে অসম্মতি জানান। অবশ্য চার বছর পর সোভিয়েত সরকার তাঁকে নির্বাসিত করলে পুরস্কারটা তিনি গ্রহণ করেছিলেন।
নোবেল কমিটি যদি মনোনয়নপ্রাপ্ত লেখকদের রাজনৈতিক দর্শন ও সামাজিক অঙ্গীকারের বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তাঁদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে, তাহলে মুরাকামির না পাওয়ার বিষয়ে একটা ইঙ্গিত হয়তো পাওয়া যায়। গত কয়েক বছরের পুরস্কারের প্রবণতা বিশ্লেষণ করলে মোটা দাগে একটা বিষয় মনে হতে পারে যে নোবেল কমিটি হয়তো রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং নিম্নবর্গের মানুষ ও সমাজের প্রতি লেখকের দায়বদ্ধতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। যেমন এবছর ঔপনিনেশিকতা ও শরণার্থী বিষয়ে গুরনাহর বিশেষ মনোযোগ ও স্বল্প পরিচিত পূর্ব আফ্রিকাকে তুলে ধরা, কিংবা তার আগে বেলারুশের সেৎলানা আলেক্সিয়েভিচের আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন ও চেরনোবিল বিপর্যয়, নাৎসি অধিকৃত ভূখণ্ডে চরম মানবিক বিপর্যয়ের ওপর মোদিয়ানোর দলিল। এমনকি নগুগির প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা কিংবা মার্গারেট অ্যাটউডের নারীবাদ– এসব গভীর অঙ্গীকারসমৃদ্ধ রচনার বিষয়েও মুরাকামির ঘাটতি আছে বলে মনে করেন জাপানি অধ্যাপক কোইচিরো সুকেগাওয়া (দ্য জাপান টাইমস অক্টোবর ৮, ২০২১)।
মুরাকামির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যখন তিনি জাপানের বিশাল কোম্পানি ইউনিক্লোর মতো প্রতিষ্ঠানের সাথে সহযোগিতা চুক্তি করেন, যার বদৌলতে ইউনিক্লো তাদের টি শার্টের ডিজাইনে মুরাকামির বইয়ের বিভিন্ন বিষয় ও চরিত্রের মোটিফ ব্যবহার করতে পারবে। মূল অভিযোগ ছিল ইউনিক্লোর বিরুদ্ধে। কারণ, তারা তাদের টি শার্টে চিনের জিনজিয়াং প্রদেশের যে উৎকৃষ্টমানের তুলা ব্যবহার করে, সেই তুলা উৎপাদনে সেখানকার সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলমানদের জবরদস্তিমূলকভাবে নিয়োগ করা হয়। একারণে এই কোম্পানির টি-শার্টের একটা চালান আমেরিকান কাস্টমস আটকে দিয়েছিল এবং আরোপ করেছিল ভবিষ্যৎ আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা। যদিও চিন এবং ইউনিক্লো এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। উল্লেখ্য টি-শার্টের প্রতি মুরাকামির রয়েছে দুর্দান্ত আকর্ষণ, যেমন আছে গানের রেকর্ড সংগ্রহের প্রতি। গত ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ সংখ্যা নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে ‘অ্যান অ্যাক্সিডেন্টাল কালেকশান’ শিরোনামে তাঁর সংগ্রহের টি-শার্ট এবং আমেরিকায় নিজের বার্গারআসক্তি নিয়ে হালকা চালের একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এবছরের নভেম্বরে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তাঁর একটা বই মুরাকামি টি: দ্য টিÑশার্ট আই লাভ। বইটির অগ্রিম আলোচনা পড়ে জানা যায়, এটা হচ্ছে তাঁর সংগ্রহের টি-শার্ট থেকে বাছাই করা শতাধিক টি-শার্টের ছবি সহ কিছু লেখা, যেগুলো আগে ছাপা হয়েছিল জাপানের ফ্যাশন ম্যাগাজিন পপিতে।
মুরাকামির বিভিন্ন উপন্যাসে নারী ও যৌনবিষয়গুলো যেভাবে উপস্থাপিত হয় সেটা অনেকটা পর্নোগ্রাফির পর্যায়ে চলে যায় বলে তাঁকে নিয়ে তীব্র বিতর্ক আছে। তাঁর উপন্যাস ওয়ানকিউএইটিফোর-এর যৌনসম্পর্কের বর্ণনাগুলো নোবেল কমিটির বিচারকদের কাছে আপত্তিকর মনে হওয়ায় তাঁকে এই পুরস্কারের অযোগ্য মনে করার সম্ভাবনাটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিষয়টিকে আরো ঘোরালো করে তোলে লন্ডনভিত্তিক দ্য লিটারারি রিভিউ ম্যাগাজিন মুরাকামির এই বইটিকে ২০১১ সালের ‘ব্যাড সেক্স ইন ফিকশন অ্যাওয়ার্ডের’ জন্য মনোনীত হওয়ার ঘটনা।
নোবেল পুরস্কারের মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত হচ্ছে শান্তি পুরস্কার। আমরা জানি ডিনামাইট আবিষ্কারের পর নির্মাণ কাজের বাইরে যুদ্ধবিগ্রহের কাজে সেটি ব্যবহারের আশঙ্কা থেকে পাপমোচন ও কল্যাণের জন্য কল্যাণ, শান্তি রক্ষা ও স্থাপনের উদ্যোগের জন্য উইলের মাধ্যমে নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তন করে গিয়েছিলেন আলফ্রেড নোবেল। ১৮৯৬ সালে তিনি যখন মারা যান, ততদিনে বিশটির বেশি দেশে তাঁর ডিনামাইট কারখানা ছিল, যার মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হতে পেরেছিলেন তিনি। নিজের স্ত্রীপুত্র না থাকলেও তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং কোনো কোনো দেশের বিরোধিতার কারণে এই উইলের বাস্তবায়নে সময় লেগে যায় চার বছরেরও বেশি। মারাত্মক ধ্বংসক্ষম এই পদার্থটি আবিষ্কারের কারণে শান্তিকামী মানুষের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি খুব ভালো ছিল না। এটার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর ভাই মারা লুডভিগ নোবেল মারা যাওয়ার পর। খবরটি প্রকাশ করার সময় এক ফরাসি সংবাদপত্র ভুলবশতঃ লুডভিগকে ডিনামাইটের আবিষ্কারক আলফ্রেড মনে করে শিরোনাম করেছিল, “মৃত্যুর সওদাগরের মৃত্যু।” খবরে মন্তব্য করা হয়েছিল, “আগের চেয়ে দ্রুত বেশি মানুষ মারার পদ্ধতি আবিষ্কার করে তিনি ধনী হয়েছিলেন।” এই নেতিবাচক ভাবমূর্তির কারণেই তিনি উইলটি করে গিয়েছিলেন কি না সেটা নিশ্চিত নয়।
প্রবর্তনের পর থেকে কখনো এমন ব্যক্তিদের শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, যারা কোনোভাবেই শান্তি স্থাপনের কোনো নজির রেখে যেতে পারেননি। যেমন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনুসকে অর্থনীতিতে না দিয়ে শান্তিতে পুরস্কার দেওয়ার গ্রহণযোগ্যতা অনেকের কাছেই বিতর্কিত। দারিদ্র থেকে নিম্নবর্গের মানুষকে উদ্ধার না করলে শান্তি স্থাপন করা সম্ভব নয়Ñ এটিই ছিল নোবেল কমিটির ব্যাখা। আবার শান্তি ও অহিংসার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা গান্ধীকে ১৯৩৭ থেকে ৪৮ পর্যন্ত সময়ে পাঁচবার মনোনয়ন দেওয়া হলেও পুরস্কারটি কখনোই দেওয়া হয়নি। তাঁকে না দেওয়ার পক্ষে নোবেল কমিটির উপদেষ্টা জ্যাকব ওয়র্ম ম্যুলারের যুক্তি ছিল যে তাঁর অহিংসা প্রয়াস বেশিমাত্রায় ভারতীয়, সার্বজনীন নয়, এমনকি তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকা মিশনও ছিল সেখানকার ভারতীয়দের জন্য, অথচ তখন সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের অবস্থা ছিল আরো খারাপ। বহু বছর পর নোবেল কমিটির সচিব গের লন্ডেস্টাড বলেছিলেন, গান্ধী নোবেল শান্তি পুরস্কার ছাড়াও চলতে পারবেন, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নোবেল কমিটি তাঁকে ছাড়া চলতে পারবে কি না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ১৯৩৯ সালে এক সুইডিশ সাংসদ শান্তি পুরস্কারের জন্য হিটলারের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। কারো মতে, এটা করা হয়েছিল মশকরা হিসেবে, যদিও ব্যাপক সমালোচনার মুখে তাঁর প্রস্তাব ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। এই ঘটনার চারবছর আগে জার্মান সাংবাদিক ও হিটলারের কড়া সমালোচক কার্ল ভন ওসিয়েৎকিকে শান্তি পুরস্কার দেওয়া হলে হিটলার স্বাভাবিকভাবেই রুষ্ট হয়েছিলেন। পরবর্তী সময় তিনি রসায়ন ও চিকিৎসায় আরো তিনজন জার্মানকে নোবেল দেওয়া হলেও তাঁদেরকে পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ভবিষ্যতে জার্মানদের কোনো ধরনের নোবেল গ্রহণও নিষিদ্ধ করেছিলেন হিটলার। শুধু হিটলার নন, পরবর্তী সময়ে স্তালিনের নামও দুবার প্রস্তাব করা হয়েছিল।
শান্তি পুরস্কারের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বেশিবার প্রস্তাবিত হয়েছিলেন মার্কিন সেক্রেটারি অভ স্টেট কর্ডেল হাল-এর নাম, মোট একত্রিশবারের প্রস্তাবের মধ্যে ছয়বার করেছিল লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের সরকার। অবশেষে ১৯৪৫ সালে পুরস্কারটা দেওয়া হয় তাঁকে। সেবার মনোনয়নপ্রাপ্তদের তালিকায় রুজভেল্ট, চার্চিল এবং স্তালিনের নামও ছিল। অথচ হালের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল হিটলারের নিধনযজ্ঞ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হাজারখানেক দেশত্যাগী ইহুদিকে বহন করা একটা জার্মান জাহাজকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তিনিই রুজভেল্টকে উপদেশ দিয়েছিলেন। ফলে ইওরোপে ফিরে গিয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছিল তাদের।
কম্বোডিয়ায় ধ্বংসাত্মক মার্কিন বোমা হামলার ব্যাপারে মূখ্য ভূমিকার কারণে সমালোচিত হেনরি কিসিঞ্জারকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া ছিল আরেকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী তাঁর কূটনৈতিক কৌশলের কারণে বাংলাদেশে তাঁর নামটি লোকমুখে ষড়যন্ত্রকারী শব্দটির সমার্থক হয়ে গেছে। একই বছর কিসিঞ্জারের সাথে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন ভিয়েতনামী নেতা লি ডাক থো, কিন্তু ভিয়েতনামে তখনও শান্তি স্থাপিত হয়নি– এই কথা বলে পুরস্কারটা তিনি গ্রহণ করেননি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দেশছাড়া করার সামরিক অভিযানের প্রতি নোবেল বিজয়ী বার্মার নেত্রী অং সান সুকির সমর্থন আবারও বিভিন্ন সময়ে শান্তি পুরস্কারবিজয়ীদের যোগ্যতার প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে আসে। রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করতে সুকির পুরস্কারটি ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিও জোরেশোরে উঠেছিল, কিন্তু আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুযায়ী পুরস্কার একবার দেওয়া হলে সেটি ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই।
গাদ্দাফি হত্যা, আফগানিস্তানে বাড়তি সেনা মোতায়েন, বিভিন্ন দেশে ড্রোন হামলাকারী সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলে পরিচিত বারাক ওবামাকেও শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়েছিল। ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদকে শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় ২০১৯ সালে, অথচ তার পরের বছরেই দেশের একাংশে ব্যাপক হত্যাকা-, ধর্ষণ ও জাতিগত নিধনের মতো ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে।
সাহিত্য এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা শেষ হওয়ার নয়। শেষ হবে না সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে জল্পনা কল্পনা, যার উৎস সৃষ্টি করে ল্যডিব্রোকসের মতো জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠানগুলো। এদের বাজীর হারের ওপর ভরসা না করলে বিশ্বের নানান প্রান্তের পুরস্কারযোগ্য লেখকদের শুলুকসন্ধান করা কঠিন হতো। নোবেল কমিটি চরম গোপনীয়তা রক্ষা করে হয়তো ঠিকই, কিন্তু লেখকদের জন্য ল্যাডব্রোকসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি করা জনপ্রিয়তা তথা বাজীর মঞ্চ যে তাঁদের সিদ্ধান্তের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না, সেকথা জোর দিয়ে বলা যায় না। তাই ২০১৮ সালের কেলেঙ্কারির পর বিধ্বস্ত নোবেল কমিটির গঠন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া পরিবর্তনের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক। অতীতের নোবেল বিজয়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লেখক-কবিদের বিচারকমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করে সুইডিশ একাডেমি সাহিত্যের পুরস্কারটি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ওঠা বিতর্ক ও সমালোচনার দায় এড়াতে পারে। ধারনাতীত এবং অপরিচিত কাউকে পুরস্কার দেওয়ার দৃষ্টান্ত যেমন খুব কম নয়, আবার যোগ্যতম কাউকে বহুবার প্রস্তাবের পরও না দেওয়ার নজিরও প্রচুর। দেশ কিংবা জাতীয়তা বিচারে একপেশে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টিতো উপাত্ত দিয়েই প্রমাণ করা যায়। যেমন নোবেল পুরস্কারের ১২০ বছরের ইতিহাসে এযাবত মোট ১১৮ জন সাহিত্যে পুরস্কারটি পেয়েছেন, এঁদের মধ্যে ৮৫ জনই ইউরোপীয়, নারী মাত্র ষোল জন, আফ্রিকা মহাদেশ থেকে পাঁচজন, তাঁদের মধ্যে একজন শ্বেতাঙ্গ (নাডিন গর্ডিমার), আবার কৃষ্ণাঙ্গও পাঁচজন টনি মরিসন, নাগিব মাহফুজ, কোয়েৎজি, ডেরেক ওয়ালকট এবং গুরনাহ। ইউরোপীয়দের মধ্যে আটজন সুইডিশ নাগরিক। স্মর্তব্য সাহিত্যে প্রথম নোবেল বিজয়ী নারীও ছিলেন একজন সুইডিশ, সেলমা আটিলা লাভিসা লাগেলফ (১৮৫৮Ñ১৯৪০)। এতদিন পর নোবেল কমিটি বিষয়টা হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছে, তাই সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে নোবেল কমিটির সভাপতি এনডার্স অলসন স্বীকার করেছেন “বিশ শতকের প্রথমদিক পর্যন্ত পুরস্কারটা বেশ ইউরোপকেন্দ্রিক ছিল এবং খুব কম নারীই পেয়েছেন। … এখন সারা বিশ্ব থেকে আমাদের বিশেষজ্ঞরা আছেন। যেসব ভাষাগত অঞ্চলের ওপর, একাডেমির গভীর পারদর্শিতা নেই, আগামি বছরের [২০২২] জানুয়ারি থেকে এই বিশেষজ্ঞরা সেসব সম্পর্কে আমাদের কাছে রিপোর্ট পেশ করবেন। যেমন এশিয়া ও আফ্রিকান ভাষার ওপর আমাদের দখল নেই, কিন্তু আয়ত্ত্ব করার ইচ্ছে আছে। এটা বেশ ভালো একটা পরিবর্তন আনবে, বিশ্ব সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ও পরিচিতিও বাড়াবে।” (দ্য নিউ রিপাবলিক, ৫ অক্টোবর, ২০২১)
নোবেল কমিটির সভাপতির এই বক্তব্য যদি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়, তাহলে ইঙ্গিত পাওয়া যায় বিশ্বের স্বল্প পরিচিত দেশ ও লেখকদের সম্পর্কে যে রিপোর্ট তাঁদের কাছে পেশ করা হবে, তার মধ্যে বিবেচনাযোগ্য লেখকদের নামের তালিকাও থাকবে। আমরা আগামি বছরের পুরস্কারের দিকে তাকিয়ে থাকব যাতে যোগ্য দাবিদার নির্বাচন ও মনোনয়নের প্রক্রিয়ায় মানুষের প্রত্যাশিত ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং নোবেল কমিটির পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা অনুযায়ী পশ্চাৎপদ বা আড়ালে পড়ে থাকা দেশ থেকে অপরিচিত অথচ মহান লেখকদের পুরস্কার পাওয়ার পথ সুগম হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে তলস্তয়, আন্তন চেখভ, জেমস জয়েস, মার্ক টোয়েন, এমিল জোলা, ভার্জিনিয়া উলফ, বোর্হেস, কাফকা, কের্তাসারসহ অনেক যোগ্য লেখক পুরস্কারটা না পাওয়ার বঞ্চনাবোধ নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু এই অপ্রাপ্তি তাঁদের কীর্তির বিশালতাকে কোনোভাবেই খাটো বা ম্লান করেনি। মিলান কুন্দেরা কিংবা নগুগির মতো বেঁচে থাকা যোগ্য লেখকদের প্রতি আগামি বছরগুলোতে সুবিচার হয় কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।