কমিউনিটি ডেস্ক রিপোর্ট: সিলেট কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্য প্রবাসীর জায়গা দখলের অভিযোগ উঠেছে। গত জুলাই মাসে সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নগরীর সোবহানীঘাটে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের বেদখল হওয়া যে ২৪ শতাংশ জায়গা উদ্ধার করেছেন বলে তখন জানা গেছে, সেই জায়গা দখলের অভিযোগে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা গত ১৮ই অক্টোবর সোমবার পূর্ব লন্ডনের একটি রেষ্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। সংবাদ সন্মেলনে যুক্তরাজ্য প্রবাসী ভুক্তভোগী আনিসুল হক সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে সিলেট কর্পোরেশনের দখলীকৃত জায়গাটিকে তার পিতার ক্রয় সূত্রে পাওয়া বলে দাবি করেন এবং সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী তা অন্যায়ভাবে দখল করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।
যুক্তরাজ্য সংবাদ সন্মেলনে প্রবাসী ভুক্তভোগী আনিসুল হক তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, আমি আনিসুল হক। বাংলাদেশের সিলেট নগরের বাসিন্দা। দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে ইংল্যান্ডে বসবাস করছি। প্রবাসে থাকলেও বাংলাদেশের প্রতি নাড়ির টান অনুভব করি। সকল প্রবাসীর মতো আমিও দেশে রেমিটেন্স পাঠানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার চেষ্টা করি। দেশের নানা কল্যাণমূলক কাজেও যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করি। তবু দেশে প্রায়ই অনাকাঙ্খিত ঘটনার মুখে পড়তে হয় আমাদের। বিশেষত দেশে থাকা আমাদের ভূসম্পত্তি নিয়ে হেনস্তা ও ভোগান্তির শিকার হতে হয়। আপনারা যারা দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে আছেন তাদের অনেকেরই হয়তো এ ধরণের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। এরকম একটি বিষয়ে গণমাধ্যমের সহযোগিতার মাধ্যমে ন্যায় বিচারের আশায় আজ আপনাদের দ্বারস্থ হয়েছি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, দেশে আমাদের পারিবারিক ভূ-সম্পদ জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছে রাষ্ট্রেরই এক প্রতিষ্ঠান। আমরা যারা প্রবাসে থেকে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি তাদের জন্য এর চেয়ে মর্মবেদনা আর কি হতে পারে! সিলেট নগরীর সোবহানীঘাট এলাকায় আমাদের পরিবারের ২৪ শতক জমি রয়েছে। ১৯৮২ সাল থেকে ক্রয় সূত্রে আমরা এই জমি ভোগদখল করে আসছি। জমির মূল মালিক ছিলেন নরেশ দত্ত সেনাপতি। কাষ্টঘর এলাকার রজনী ভূষণ চৌধুরী ও রসময় চৌধুরী এই জমি ক্রয় করে ভিটা নির্মাণ করে তাতে বসবাস করেন। পরবর্তীতে রসময় চৌধুরী তার অংশ রজনী চৌধুরীর নিকট বিক্রি করে দেন। রজনী চৌধুরীর মৃত্যুর পর পুরো জমির মালিক হন রনধীর চৌধুরী। ১৯৫৬ ইংরেজির ভূমি জরিপে ভুলবশত এই জমিটি সিলেট পৌরসভার নামে রেকর্ডভূক্ত হয়ে পড়ে। কিন্ত জমিটিতে ভোগদখল থাকা অবস্থায় হঠাৎ করে লোকমুখে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারেন রনধীর চৌধুরী। এরপর তিনি সিলেট সদর মুনসেফি ১ম আদালতে ১৯৬৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পৌরসভার বিরুদ্ধে স্বত্ত মামলা দায়ের করেন। পৌরসভা এ বিষয়ে লিখিত জবাব দিয়ে জমিটি নিজেদের বলে দাবি করলেও প্রমাণের অভাবে মামলাতে হেরে যায়। মামলায় বাদী রনধীর চৌধুরী বিবাদী পৌরসভার বিরুদ্ধে খরচসহ ডিক্রি লাভ করেন। এরপর রনধীর চৌধুরী এই জমির মধ্যে ১২ শতক গুল মো. এবং আরও ১২ শতক আব্দুর রহিমের কাছে বিক্রি করেন। ১৯৮২ সালে এই দুজনের কাছ থেকে তাদের মালিকানাধীন ২৪ শতক ভূমি ক্রয় করেন আমার বাবা আরকান আলী। জমি ক্রয় করে আমার পরিবার যথানিয়মে ভোগদখল করতে থাকেন। মালিকানার কাগজপত্র দিয়ে পৌরসভার অনুমতিক্রমেই এই জমিতে দোকানকোঠা নির্মাণ করা হয়। দোকান কোঠায় বিদ্যুৎ সংযোগও নেওয়া হয়। আমাদের মালিক মেনেই ২০২০ সালের ২৭ জুলাই সিলেট সিটি কর্পোরেশন থেকে হোল্ডিং বিবরণী (হোল্ডিং নং ২৩১০/২) প্রেরণের জন্য মেয়র স্বাক্ষরিত নোটিশ প্রদান করা হয়। আমরা যথাযথ নিয়মে হোল্ডি ট্যাক্স প্রদান করি। সপরিবারে প্রবাসে থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমরা সবসময় জমির খোঁজখবর রাখতে পারি না। এ কারণে সর্বশেষ নামজারিকালে এই জমিটি আমাদের নামে নামজারি হয়নি। নামজারি না হওয়ায় ২০০২ সালে আমাদের পরিবারের পক্ষে হাসনা বেগম বাদী হয়ে ২০০২ সালে সিলেট জজ কোর্টে একটি মামলা করেন। যা এখনো আদালতে বিচারাধীন আছে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে আদালতে বিচারাধীন ও আমরা ভোগদখলে থাকা অবস্থয় কোনো ধরনের নোটিশ প্রদান ছাড়াই গত ১৫ আগস্ট সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা এসে জোরপূর্বক আমাদের জমি দখল করে নেন। ফিল্মি স্টাইলে অভিযান চালিয়ে মেয়র আমাদের ঘরবাড়িসহ সকল স্থাপনা ভেঙে ফেলেন। ফোনে তাকে আদালতে মামলা চলমান থাকার কথা জানানো হলেও মাননীয় মেয়র কোনো কথা না শুনেই আমাদের স্থাপনা ভেঙে দিয়ে জমিটি দখল করে নেন। আদালতের রায়ের মাধ্যমে তিনি জমির দখল নিয়েছেন বলে দাবি করলেও এর পক্ষে কোন কাগজপত্র প্রদর্শন করেননি। মেয়র জানান, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন তাই কাগজপত্র দেওয়া যাবে না। তথ্য অধিকার আইনে আমরা মেয়রের কাছে কাগজপত্র দাবি করলেও তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন। আমাদের প্রশ্ন হলো, আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় কাগজ সরবরাহ করতে না পারলেও কোন যুক্তিতে তিনি বিচারাধীন জমির জোরদখল নেন? কেবল জমি দখল করেই ক্ষান্ত হননি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সেদিন তিনি রেমিটেন্সযোদ্ধা প্রবাসী পরিবারকে ‘দখলকারী’ বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মন্তব্যও করেন। আমার পরিবারের সামাজিক সুনামহানির বিষয়টিও তিনি খেয়াল করেননি। জমির কাগজপত্র যাচাই না করে, আদালতের রায়কে উপেক্ষা করে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় গায়ের জোরে এই জমিটি দখলে করে তিনি কী প্রমাণ করতে চাইলেন তা বোধগম্য নয়। যা শুধু নাগরিক অধিকার হরণই নয়, আদালত অবমাননারও শামিল। নগরকর্তার এহেন আচরণ কতটা শোভন তা আপনারাই বিবেচনা করবেন। নাগরিকদের সেবা নিশ্চিত করাই সিটি করপোরেশনের কাজ। সেই সিটি করপোরেশনই যখন দখলদার হয়ে উঠে, একজন নির্বাচিত মেয়র যখন জমি দখলে নেতৃত্ব দেন তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষের আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। জমি ফিরে পেতে আদালতে আমাদের মামলা চলমান আছে। আশা করছি আদালতে ন্যায় বিচার পাবো। আদালতের সিদ্ধান্তের আগে কোনো ধরনের হয়রানি, নির্যাতন ও উচ্ছেদের শিকার না হওয়া ছিলো আমাদের নাগরিক অধিকার। প্রবাসী পরিবার হিসেবে আমরা আপনাদের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিষয়টির তদন্ত দাবি করছি। আপনারা সহযোগিতা করলে সঠিক তদন্তে ন্যায় বিচার পাবো বলে প্রত্যাশা করি। এ সময় আনিসুল হকের যুক্তরাজ্য প্রবাসী বোন আবিদা সুলতানা, তাঁর স্বামী সাইফ আহমদ ও আনিসুল হকের দুই খালাতো ভাই শামসুর রহমান মাতাব এবং সাঈদুর রহমান সাঈদ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে পূর্ব লন্ডনে জায়গার মালিক দাবিদার যুক্তরাজ্যে প্রবাসী আনিসুল হকের সংবাদ সম্মেলনের খবর শোনে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জবাব দিতে পরদিন ১৯শে অক্টোবর মঙ্গলবার নগরভবনে পাল্টা এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন।

সংবাদ সম্মেলনে সিলেট সিটি কর্পোরেশন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, সরকারের বিচারবিভাগের আওতায় আদালত এবং জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসের নিষ্পত্তিকৃত ও চলমান মামলা বিষয়ে দেশের বাইরে (যুক্তরাজ্যে) বসে আনিসুল হক যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন সেটি দেশদ্রোহীতার শামিল। সিলেট সিটি করপোরেশন বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। আনিসুল হক ভিনদেশে বসে সংবাদ সম্মেলনের অর্থ হচ্ছে-তিনি গণমাধ্যম এবং অনলাইন গণমাধ্যম ব্যবহার করে দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। মেয়র আরিফ বলেন, লন্ডনের সংবাদ সম্মেলনকারী দাবি করেছেন-তার ঘরবাড়িসহ সব স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয় এবং আদালতের রায়ের বা ডিক্রির কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি সিলেট সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু ওইদিন সিসিকের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিট্রেটের কাছে কেউ কাগজপত্র প্রদর্শনের জন্য আসেননি। সংবাদ সম্মেলনকারী সিলেট সিটি কর্পোরেশনকে দখলদার ও সিসিক মেয়র হিসেবে আমাকে জমি দখলকারী উল্লেখ করে শুধু আমার বা সিসিকের নয়, সিলেট মহানগরীর সর্বস্তরের জনসাধারণের মানহানি করেছেন। তিনি আরও বলেন, সর্বাবস্থায় আদালতে সিদ্ধান্তক্রমেই বর্ণিত ভূমির উন্নয়নকাজ অব্যাহত রাখা হয়েছে এবং এ পর্যন্ত কাউকে নির্যাতন বা হয়রানি করার কোনো প্রমাণ আমি পাইনি। সংবাদ সম্মেলনকারী বারবার তার বক্তব্যে ‘সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী’ অর্থাৎ-আমাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জমি দখলকারী, জমি দখলে নেতৃত্বদানকারী, ফিল্মি স্টাইলে অভিযানকারী, নাগরিকদের অধিকার হরণকারী ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করে আমার মানহানি তথা সিলেট মহানগরবাসীর মানহানি করেছেন। মেয়র আরিফ বলেন, জনগণের রায়ে নির্বাচিত হয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলর হিসেবে নাগরিকদের সেবা প্রদানই আমাদের দায়িত্ব এবং আমরা আমাদের সাধ্যমত সে চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি। আপনাদের নিশ্চিত করতে চাই, শুধু প্রবাসী নয়, সিলেট মহানগরীর কোনো নাগরিকের কোনো রকম ক্ষয়ক্ষতি হোক-এমন কোনো কাজ করব না। লন্ডনে বসে উদ্দেশ্যমূলক এমন সংবাদ সম্মেলন করায় আমি মেয়র ও আমার পরিষদের সকল কাউন্সিলরসহ সিসিকের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কার্মচারীগণ তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। কারণ মামলা চলাকালীন সময়ে সাব-জুডিস বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করা আইনের পরিপন্থী।