আসাম নিউজ ডেস্ক: অবশেষে দুশ্চিন্তা কাটতে চলেছে আসামের বাঙালিদের। ভারতের শীর্ষ আদালত এ বিষয়ে এক যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। এ রায়ের কারণে ১১ লাখ বাঙালি অনেকটাই নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। মূলত এর আগে দেখা গিয়েছিল জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) মাধ্যমে আসামে বসবাসরত হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালিদের এক প্রকার বিদেশি আখ্যা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) রায়ে বলা হয়েছে, ভারতের নাগরিকত্ব আইনের ৬এ ধারা সম্পূর্ণভাবে বৈধ। আর সেই ধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আসামের ২৯ শতাংশ বাঙালির ভবিষ্যৎ। সুপ্রিম কোর্টের এ রায়ে বলা হয়েছে, যারা ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারির আগে এবং ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারির পর থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত যেসব বাংলাদেশি আসামে প্রবেশ করেছিলেন তারা ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী।
স্বাভাবিকভাবে শীর্ষ আদালতের এ রায়কে স্বাগত জানিয়ে রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য এতদিন কথায় কথায় বাংলাদেশি তকমা দিয়ে আসামের বাঙালিদের যে হয়রানি করা হচ্ছিল তা এবার বন্ধ হবে। যদিও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর যারা আসামে এসেছেন তাদের অবশ্য বিদেশি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করা হবে।
৮০-র দশকে প্রথম দিকে বাঙালিদের অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে আসাম থেকে বাঙালি তাড়ানোর উদ্দেশে ‘আসু’ ও ‘অগপ’র মতো দলগুলো আসামজুড়ে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন শুরু করে। পাশাপাশি আলফার নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম আসাম গঠনের দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সবুজ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা বাঙালি রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অস্থির পরিস্থিতিতে বহু বাঙালি ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। তাদের অনেকে আসামে চলে যান। সেসব শরণার্থীকে ভালো চোখে দেখেনি আসামীয়রা। ‘আসু’, ‘অগপ’ ও আলফার মতো সশস্ত্র দলগুলোর নেতারা মনে করেছিলেন, বাঙালি শরণার্থীদের কারণে আসামের ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস হবে। সেই আশঙ্কা থেকে বাঙালি তাড়াও অভিযান শুরু করেছিলেন তারা।
এরপর ১৯৮৫ সালে মানবিকতার খাতিরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ও আসুর তৎকালীন প্রধান তথা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল কুমার মহন্তর সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা আসাম চুক্তি নামে পরিচিত। সেই চুক্তিতে আইনি বৈধতা দিতে ওই বছরই নাগরিকত্ব আইনে ৬এ ধারাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, এ বিষয়ে জেনে রাখা ভালো ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে ৬এ ধারাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল ১৯৮৫ সালে।
আসাম চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারির আগে যারা ভারতে প্রবেশ করেছিলেন তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। আর যারা ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত ভারতে এসেছিলেন তারা ১০ বছর পর ভারতীয় নাগরিক হিসেবে নিজেদের নাম রেজিস্টার্ড করতে আবেদন করতে পারবেন। আর সেই চুক্তিকে আইনি স্বীকৃতি দিতেই নাগরিকত্ব আইনে ৬এ ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর এ নিয়ে মামলা হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচুড়, বিচারপতি সূর্য কান্ত, বিচারপতি এম এম সুন্দরেশ, বিচারপতি জেবি পারদিওয়াল ও বিচারপতি মনোজ মিশ্রকে নিয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যের এ বেঞ্চ জানিয়ে দেন ৬এ ধারা সাংবাদিকভাবে বৈধ।
যদিও স্থানীয় জনজাতি ও আদি বাসিন্দারা নিজেদের ভূখণ্ডের সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে এবং এ বাঙালির অনুপ্রবেশে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ভাষা ধ্বংস হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিল। সে সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছেন, অনুপ্রবেশের সমস্যা মেটানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমাধান সূত্র হলো আসাম চুক্তি। কেন্দ্রীয় সরকার এ আইন অন্যান্য এলাকায় প্রসারিত করতে পারতো, কিন্তু তা করা হয়নি। কারণ এ ধারা আসামের জন্য অনবদ্য ছিল।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ থেকে আসামে বসবাস করা বাঙালিরা আসন চুক্তি অনুযায়ী তাদের নাগরিকত্ব বৈধ। এ দাবি নিয়ে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টের শুনানি চলছিল। ৬এ ধারা বিরোধিতা করে ‘অল আসাম অহম অ্যাসোসিয়েশন’, ‘আসাম সম্মিলিত মহাসংঘ’ প্রভৃত সংগঠনগুলো। এছাড়া প্রণব মজুমদার নামে এক ব্যক্তি এ ধারার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন।
আবেদনকারীদের অভিযোগ ছিল নাগরিকত্ব আইনের ৬ এর ধারা অনুযায়ী ৫০ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালিদের আসামে নাগরিকত্ব দেওয়ার ফলে আসামের জনবিন্যাসের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আসামে স্থায়ী জনজাতি ও আদি বাসিন্দারা নিজেদের ভূখণ্ডে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। তাদের কর্মস্থানে সুযোগ-সংস্কৃতি অস্তিত্ব এবং তাদের ভাষাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। যার জেরে সংবিধানের ২৯ (১) লঙ্ঘন হয়েছে।
মামলার দুপক্ষের বাদানুবাদ শুনে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ৬ ধারা সাংবিধানিকভাবে বৈধ। অর্থাৎ আসাম চুক্তি বৈধ। এ ঐতিহাসিক রায়ের জেরে নিশ্চিন্ত হতে পারবেন আসামের বাঙালিরা।
উল্লেখ্য, ৬এ ধারা অর্থাৎ আসাম চুক্তির পক্ষে জোরালো দাবি করেছিলেন কপিল সিব্বাল, সালমান খুরশিদ, ইন্দিরা জয় সিং, তুষার মেহতার মতো সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা।