।। ইরফান মাসুদ ।।
এককেন্দ্রিক উন্নয়নের ফলে শিল্পায়নের সভ্যতার আঁচটা শুধু ঢাকা আর তার আশে পাশের এলাকা গুলোতেই লেগেছিল। এর ফলে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে হাজার হাজার শিল্প কারখানা আর গার্মেন্টস। এর ফলে দেশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে লাখ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের আশায় এসব এলাকায় আসে। কিন্তু করোনা এসে বুঝিয়েছে, এতদিন গ্রামকে অবহেলা করে আসা আর ঢাকামুখী এককেন্দ্রিক শিল্পায়ন কতোটা আত্মঘাতী ছিল।
ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে Reverse Migration. যার বাংলা অর্থ বিপরীত পরিযান। অর্থাৎ গ্রাম থেকে শহর বা শিল্পাঞ্চলে কাজের জন্য যাওয়া মানুষকে বোঝায়। এমনটা হয়ে চলেছে বাংলাদেশে শিল্প কারখানা ভিত্তিক সভ্যতা গড়ে ওঠার উষা লগ্ন থেকে। সারা দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এলাকাগুলোতে যায় কর্মসংস্থানের জন্য। বেশির ভাগ শ্রমিকের উদ্দেশ্য থাকে গার্মেন্টসে কাজ করা। কারণ এসব এলাকা গার্মেন্টস অধ্যুষিত। শুধু গার্মেন্টসই নয় যে কোনো চাকরি লাভের সহজ উপায় ঢাকামুখী হওয়া। ফলে ঢাকা এবং এর আশেপাশের এলাকা গুলোতে এতোবেশি চাপ পড়েছে যে, এখানে বসবাস করা নাগরিকদের কাছে ন্যূনতম মৌলিক অধিকার গুলোও ঠিক মতো পৌঁছায় না। ঘিঞ্জি বস্তিগুলোতে তারা এতোটাই মানবেতর জীবন যাপন করে যা অবর্ণনীয়।
জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী ঢাকা, সাভার, গাজীপুরের একাংশ ও নারায়ণগঞ্জে প্রায় ১.৫০ কোটি মানুষের বাস। যার ফলে ঢাকাকে ঘোষণা করা হয় পৃথিবীর ১১ তম মেগাসিটি হিসেবে। পৃথিবীর ৩য় দুষিত শহরও এই ঢাকা। মানবেতর শহরের তালিকাতেও ঢাকা ১০ এর মধ্যেই রয়েছে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের বস্তিগুলোতে শ্রমিকেরা এতোটাই ভয়াবহ জীবন যাপন করে যে সেখানে একবার করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কারো হাতে থাকবে না। সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং মেইনটেইন করার মতো ন্যূনতম অবস্থাও নেই সেখানে।
যার ফলে জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ মানুষ গ্রামে ফিরতে শুরু করে।বছরের পর বছর থেকে চলে আসা স্বাভাবিক রীতি থমকে গেছে এই করোনাকালে। কিন্তু গার্মেন্টস মালিকদের চাপে অনেককেই আবার ঢাকায় ফেরত আসতে হয়। এখনো একটা বিপুল সংখ্যার মানুষ ঢাকায় ফেরেনি। আবার অনেকেই কর্মী ছাঁটাইয়ের শিকারও হয়েছে। তাই গ্রামে থাকা শ্রমিক গুলো এখন বেকার হয়ে পড়েছে।বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ ও বরিশাল অঞ্চলের উপর একটা বিরূপ প্রভাব পড়তে চলেছে। কারণ উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর রংপুর, বৃহত্তর দিনাজপুর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনা ও বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের মানুষ সরাসরি ঢাকার উপর নির্ভরশীল। এসব অঞ্চলে শিল্পায়ন গড়ে না উঠায় এবং দেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবকাঠামোর জন্য তৈরি হয়নি কোনো উদ্যোক্তা।ফলে কর্মসংস্থানের জন্য তাদের ঢাকামুখী হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। ফলে এসব এলাকায় দারিদ্রতার হার হু হু করে বেড়ে চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই এসব এলাকায় মঙ্গা বা দুর্ভিক্ষের সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু শহরে না ফিরে যদি ছোট মাঝারি নানা কাজে এসব লোকদের লাগানো যায়, যদি তারা গ্রামে বসেই রোজগার করতে পারে তাহলে তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতেও পড়বে না আর দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও থাকবে না।
আর এজন্য এগিয়ে আসতে হবে ক্ষুদ্র ঋণ বা মাইক্রোফাইনেন্সিং সংস্থা গুলোকে। তারা যদি ভ্যাঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড তৈরি করে তাহলে গ্রামেই সম্ভব উদ্যোক্তা তৈরি করা। এতে তৈরি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। Venture capital fund প্রতিশ্রুতিপূর্ণ নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে পুঁজির টাকা যোগায়, বিনিময়ে ওই প্রতিষ্ঠানের অংশীদারত্বের মালিক হয় Venture fund.অধিকাংশ শেয়ারের মালিকানা মুল প্রতিষ্ঠানেরই থাকে। কিছু ব্যতিক্রমও আছে। যে ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হবে, তা সফল হবে কিনা সেগুলো ভালভাবে খতিয়ে দেখা হয়।
গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ে তোলাই ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা গুলোর মুল লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাই সরকারের পাশাপাশি এসব ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা গুলোর গুরুত্ব অপরিহার্য।গ্রামকে শহরের লেজুড় না ভেবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলা উচিত। গ্রামীণ অর্থনীতি এমনভাবে গড়ে তোলা উচিত যেনো বিনিয়োগ গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তাই ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা গুলো থেকে সহজে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত।
ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা গুলো থেকে ঋণ নেওয়ার আগ্রহ থাকে অনেক মানুষের। কিন্তু অনেক সময় তা শোধ হয় না। টাকা নেওয়ার লোক থাকলেও ক্ষুদ্র ঋণে টাকা জমাবার লোক অনেক সময় কম থাকে। এর মুল কারণ ক্ষুদ্র ঋণে অনিশ্চয়তা।সামান্য ঘটনাতেই আমানতকারীরা টাকা ফেরত চায়। সেই সংকট ছড়িয়ে পড়ে মাইক্রোফাইনেন্স সংস্থা থেকে যেসব ব্যবসায় টাকা ঢালা হয়েছে সেসবেও। এজন্য অনেক সংস্থা ঋণ দিতে অনাগ্রহ দেখায়। কিন্তু করোনাকালে সবরকম অনিশ্চয়তা কাটিয়ে মানুষকে শহরমুখী করা থেকে অনুৎসাহী করা উচিত।
ঘিঞ্জি বস্তি এলাকাতে করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই কারণে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মিরপুর এলাকাগুলোকে করোনার হটস্পট ঘোষণা করা হয়। এছাড়া সারাদেশে করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার মুল কারণও এসব হটস্পট এলাকা থেকে শত শত শ্রমিক স্ব স্ব এলাকায় ফিরে যাওয়া। শুধু করোনা মহামারি নয় অতীতে যেকোনো মহামারি আগে ঘিঞ্জি পরিবেশেই হানা দিয়েছে। তাই আমাদের সভ্যতা নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে হবে। এভাবে ঘিঞ্জি পরিবেশে যদি শ্রমিকদের রাখা হয় তাহলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে লাখ লাখ মানুষ। ভেঙে যেতে পারে অর্থনীতির অবকাঠামো। ধ্বংস হয়ে যেতে পারে পুরো একটি সভ্যতা। ঢাকা, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের মতো এলাকাগুলোতে এতোটা জায়গাও নেই যে লাখ লাখ শ্রমিককে স্বাস্থ্য সম্মত ভাবে বাড়ি বানিয়ে রাখা যাবে।
তাই ক্ষুদ্র ঋণের অনিশ্চয়তা কাটিয়ে সহজে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এজন্য মাইক্রোফাইনেন্সিং সংস্থাগুলোর পাশাপাশি সরকারের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। এতে গ্রামেই তৈরি হবে উদ্যোক্তা। এতে গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষির পাশাপাশি গ্রামে বহুমুখী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠবে। গ্রামের মানুষ গ্রামেই থাকুক। গ্রামেই তৈরি হোক বহুমুখী কর্মসংস্থান।
শুধু স্মার্ট শহর বানালেই চলবে না। গ্রাম আমাদের শেকড়। তাই আগে স্মার্ট গ্রাম তৈরি করতে হবে। শহরের সকল সুবিধা গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে।তবেই মিলবে অর্থনৈতিক মুক্তি। করোনাকালে দেশের অর্থনীতি যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তা…অনেকাংশে লাঘব করা সম্ভব হতো যদি অতীতে গ্রামগুলোকে অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলা যেতো।
তাই এখনি সময়,ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গ্রামগুলোকে অর্থনীতির মুল চালিকা শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা। স্মার্ট শহরের আগে আমাদের চাই স্মার্ট গ্রাম তৈরি করা।
লেখক: শিক্ষার্থী, এআইবিএ, সিলেট।