।। তুহিন ওয়াদুদ ।।
বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ। স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরও এ দেশের উন্নয়ন ভয়াবহ বৈষম্যমূলক। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ অকাতরে জীবন দিয়েছেন যে কারণে, তার অন্যতম এই বৈষম্য দূরীকরণ। সারা দেশে যখন দারিদ্র্য কমেছে, তখন রংপুর বিভাগে দারিদ্র্য বেড়েছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে গড় দারিদ্র্য ছিল ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ। দেড় যুগ পর সেটা দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ রংপুর বিভাগের দারিদ্র্য ৪৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। সমতাভিত্তিক উন্নয়নের কথা আমাদের সংবিধানে বলা থাকলেও কার্যকারিতা নেই।
২২ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভর্ন্যান্স কাউন্সিলের প্রথম সভায় অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়নের কথা বলেছেন। ২৩ মে প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি খবরের শিরোনাম, ‘অঞ্চলভিত্তিক যথাযথ উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের নির্দেশ’। এই সংবাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্ধৃত একটি অংশ এমন, ‘বাংলাদেশের একেক এলাকা একেক রকম, এটাও মাথায় রাখতে হবে। যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশকে আরও ভালো করে চিনতে হবে, জানতে হবে।’ দেশের কোন অঞ্চল কেন পিছিয়ে আছে, কোন অঞ্চলের জন্য কী রকম পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন, এই সমীক্ষা হয়েছে কি না জানা নেই। যেমন রংপুরের দারিদ্র্য কমাতে হলে নদীর বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যার মাধ্যমে ভাঙন ও বন্যা রোধ করতে হবে। বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে জনশক্তি প্রেরণ করতে হবে। কৃষিনির্ভর শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে প্রণোদনার বিকল্প নেই। চিলমারী অথবা গাইবান্ধা থেকে ব্রহ্মপুত্রের ওপর সড়ক-রেলসেতু উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে আরও ভালো করে চিনতে হবে, জানতে হবে।’ এই বক্তব্য আশাজাগানিয়া। বক্তব্যে বোঝা যায় ছোট্ট একটি বাংলাদেশকে এখনো পরিকল্পনা গ্রহণকারীরা ভালো করে চেনেন না, জানেন না। যেমন গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীরা রংপুর বিভাগে কেউ আসেননি বললেই চলে। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্বোধন করতে এসেছিলেন। তিনি মঙ্গা শব্দের অর্থ জানতেন না। সদ্য প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে কখনো পিছিয়ে পড়া উত্তরের এই জনপদ দেখতে আসেননি। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রংপুরকে বিভাগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। তাই প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, তা পরিকল্পনা গ্রহণকারীদের জন্য লজ্জার হলেও অবশ্য মেনে চলা উচিত বলে মনে করি।
বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার বরাদ্দও রংপুর বিভাগের জন্য সীমাহীন বৈষম্যমূলক। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রংপুর বিভাগে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল দশমিক ৯৮ শতাংশ টাকা মাত্র। এই বরাদ্দ মেগা প্রকল্পের বরাদ্দ ছাড়াই। ২০১১ সালের আদমশুমারির সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিবেচনায় নিলে এ বিভাগে এখন জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। সারা দেশে জনগণের প্রায় আট ভাগের এক ভাগ এই বিভাগে। যদি সংবিধানে বিশেষ সুবিধার কথা বাদও দিই, তবু রংপুর বিভাগে বরাদ্দ পাওয়ার কথা মোট বরাদ্দের ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রতিবছর উন্নয়ন খাতে বৈষম্যমূলক বরাদ্দও রংপুর বিভাগকে পিছিয়ে রেখেছে।
রংপুর বিভাগে যে অর্থনৈতিক অঞ্চলের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তার অনেকগুলো কাগজেই শোভা পাচ্ছে। করোনাকালে বন্ধ হয়ে যাওয়া পার্বতীপুর থেকে চিলমারী যাওয়ার ট্রেনটি বন্ধ হয়ে গেছে। রংপুর থেকে ডুয়েল গেজ লাইনের কাজ শুরু করার কথা শুনছি প্রায় এক যুগ থেকে। বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন আমাদের সন্তানদের সন্তানেরা হয়তো দেখতে পারবে! চিলমারী বন্দরের কাজ এখনো অসমাপ্ত।
দেশে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোতে বর্তমানে ব্যয় হচ্ছে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। যদি জনসংখ্যা কিংবা অঞ্চলের বিবেচনায় বলি, তাহলে রংপুরের জন্য বরাদ্দ হওয়ার কথা প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবে রংপুরের জন্য কোনো মেগা প্রকল্প নেই। করোনাকালে সরকারিভাবে দেওয়া সহায়তাও বর্ণনাতীত বৈষম্যমূলক।
২২ মে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ২০১৬ সালের একটি গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ‘পোভার্টি অ্যান্ড আন্ডার নিউট্রিশন ম্যাপস বেজড অন স্মল এরিয়া এস্টিমেশন টেকনিক’ শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিল। সেখানে দেখানো হয়েছে, দেশের সবচেয়ে দরিদ্র উপজেলার নাম কুড়িগ্রামের চর রাজীবপুর। এখানে গরিব মানুষের সংখ্যা ৭৯ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশের সবচেয়ে কম গরিব রাজধানীর গুলশানে, দশমিক ৪ শতাংশ। এলাকাভিত্তিক এই বৈষম্য ১৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রায় ২০০ গুণ।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত ২২ মে ২০২২ আগামী অর্থবছরের (২০২২-২৩) জন্য বিকল্প বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। সেখানে তিনি মাথাপিছু উন্নয়নের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘মাথাপিছু আয় একটি বাজে ধারণা।’ কদিন পরই ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করা হবে। এই বাজেটে কি অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়নের প্রতিফলন থাকবে?
দেশের পিছিয়ে পড়া রংপুর বিভাগের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার বাস্তবায়ন হয় খুব ধীরগতিতে। কখনো কখনো সময়ে চাপা পড়ে সে কাজ আর হয় না। রংপুরে ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিত্তি দেওয়া এবং সংসদ থেকে পাস করা আইনের রংপুর বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদালয়টি আর হয়নি। ঠাকুরগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার পর ঘোষণা দেওয়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও এটা এখনো হয়নি।
কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যায়ে ঘোষণার প্রায় সাত বছর পর কেবল উপাচার্য নিয়োগ হয়েছে। দেশে তুলনামূলক সবচেয়ে কম বরাদ্দ পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। রংপুর বিভাগে যে অর্থনৈতিক অঞ্চলের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তার অনেকগুলো কাগজেই শোভা পাচ্ছে। করোনাকালে বন্ধ হয়ে যাওয়া পার্বতীপুর থেকে চিলমারী যাওয়ার ট্রেনটি বন্ধ হয়ে গেছে। রংপুর থেকে ডুয়েল গেজ লাইনের কাজ শুরু করার কথা শুনছি প্রায় এক যুগ থেকে। বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন আমাদের সন্তানদের সন্তানেরা হয়তো দেখতে পারবে! চিলমারী বন্দরের কাজ এখনো অসমাপ্ত।
বাঙালির ইতিহাসে একজন বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন বলে পাকিস্তানি শোষণ ও বৈষম্য থেকে মুক্তি পেয়েছি। এখন প্রয়োজন দেশের ভেতরে চেপে বসা আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘অঞ্চলভিত্তিক যথাযথ উন্নয়ন পরিকল্পনা’ গ্রহণের যে নির্দেশ দিয়েছেন, তার প্রতি আমরা আস্থা ও আশা রাখতে চাই। এই পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে দেশের সব গরিব জেলা-উপজেলার উন্নয়নবৈষম্য দূর করার প্রক্রিয়া শুরু হবে, সেই প্রত্যাশা রাখছি।
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক।
ইমেইল: wadudtuhin@gmail.com