কমিউনিটি নিউজ ডেস্ক: লিবিয়া থেকে নতুন করে ১৩৯ জন অনিয়মিত বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত মোট এক হাজার ২৪৫ নাগরিককে আইওএম এর সহায়তায় লিবিয়া থেকে দেশে ফিরিয়েছে বাংলাদেশ। এই সংখ্যা তার আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি।
লিবিয়া থেকে বাংলাদেশিদের ফিরে আসার সংখ্যা বাড়ছে। ত্রিপোলিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ‘পর্যায়ক্রমে লিবিয়ায় বিপদগ্রস্ত ও আটক বাংলাদেশি নাগরিকদের দেশে প্রত্যাবাসনের অংশ হিসাবে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এর সহযোগিতায় বেনগাজি থেকে ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে ১৩৯ জনকে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে।’
লিবিয়ার বুরাক এয়ারের একটি ফ্লাইটে ১ ফেব্রুয়ারি ভোরে তারা ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন।
দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ‘লিবিয়ার বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে আটকসহ বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিরাপদে দেশে প্রত্যাবাসনের জন্য দূতাবাস স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং আইওএম এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে দূতাবাস নিয়মিত লিবিয়ার বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টার পরিদর্শন করে আটক বাংলাদেশিদের প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা করছে।’
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছানোর আশায় অনেক বাংলাদেশি বিভিন্ন উপায়ে লিবিয়াতে আসেন। অনেককে আটক করে মানবপাচারকারীরা মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে। অনেকে বন্দি হন।
এমন আটক ও বিপদে পড়াদের দেশে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তার অংশ হিসেবে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন ফ্লাইটে এক হাজার ২৪৫ জনকে ফেরত আনা হয়েছে বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এই সংখ্যা ২০২২ সালের সারা বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। আইওএম-এর স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন কর্মসূচির অধীনে সে বছর ফেরত এসেছিলেন এক হাজার ১০২ জন। আর ২০২১ সালে এসেছেন ৮১৫ জন।
দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ জানুয়ারি ত্রিপোলির তারিক মাতার ডিটেনশন সেন্টারে আটক ১৩১ জনকে ফেরানো হয়। ২১ ডিসেম্বর লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল থেকে ফিরেছেন আরও ১৪০ জন। তাদের মধ্যে ২৭ জন বেনগাজির গানফুদা ডিটেনশন সেন্টারে আটক ছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর ফেরত আসা ১৩৬ জনের মধ্যেও ৩৩ জন এই আটক কেন্দ্রটিতে ছিলেন। বেনগাজিতে আটক আরও ১৪৫ জনকে একটি ফ্লাইটে ফেরত পাঠানো হয়েছে ৫ ডিসেম্বর। এছাড়া নভেম্বরের ২৭ ও ৩০ তারিখে দুইটি ফ্লাইটে ত্রিপোলিতে বন্দি থাকা ২৫৩ জন ফেরত এসেছেন।
বেনগাজির গানফুদা ডিটেনশন সেন্টারে আটকসহ লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে বিপদগ্রস্ত ১৫১ জন বাংলাদেশি নাগরিককে ৪ সেপ্টেম্বর দেশে পাঠানো হয়। ত্রিপোলির ডিটেনশন সেন্টারে আটক ১৩১ জন মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে ফেরেন ৩১ জুলাই।
দূতাবাস জানিয়েছে, তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়ের পর ত্রিপোলি ও বেনগাজির বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে আটক বাংলাদেশিদের সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ইস্যু করেন। পরে তাদের আইওএম-এর কাছে নিবন্ধনের মাধ্যমে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে দেশে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
লিবিয়ায় কত বাংলাদেশি
বাংলাদেশের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত লিবিয়ায় কাজ নিয়ে যাওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল ৬৮৫ জন। এর মধ্যে গত দুই বছরে গেছেন ৬৪৩ জন।
তাদের হিসাবে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিতে যাওয়া বাংলাদেশির মোট সংখ্যা ১২ হাজার ৪৭৬ জন। কিন্তু আইওএম-এর জরিপ বলছে, ২০২৩ সালে লিবিয়ায় অবস্থান করা বাংলাদেশি ২৩ হাজার ৫৬৩ জন।
আইওএম এর আরেক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে আসা বাংলাদেশিদের এক তৃতীয়াংশ তুরস্ক থেকে প্রবেশ করেছেন। এছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশর হয়ে এসেছেন অনেকে। এজন্য চার হাজার ১৩৬ ডলার বা প্রায় চার লাখ টাকা পর্যন্ত তারা খরচ করেছেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম গত ডিসেম্বরে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে ইমিগ্রেশন পেরোনো পর্যন্ত হয়ত তারা আইন ঠিকমতো অনুসরণ করেই যাচ্ছেন। পরে সমস্যা হয়ে যাচ্ছে ট্রানজিট পয়েন্ট বা ল্যান্ডিং পয়েন্ট, যেটাই থাকুক না কেন ওখানে পৌঁছানোর পর তারা যে কোনোভাবেই হোক ভিক্টিম হয়ে যাচ্ছেন।’
লিবিয়ায় আসা এসব অভিবাসীর মূল লক্ষ্য থাকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইতালি পৌঁছানো। আইওএম-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে ইতালিগামীদের ১৪ শতাংশের বেশি ছিল বাংলাদেশি, যা দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ৷ দেশটি থেকে ভূমধ্যসাগর পার হতে গিয়ে অনেকে মৃত্যুবরণও করেন। অনেককে সমুদ্র থেকে বাধা দিয়ে ফিরিয়ে আনে লিবিয়ার উপকূলরক্ষী বাহিনী। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল চার হাজার ৪৪৮ জন, যা দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ২০ শতাংশ প্রায়। সে বছর বিভিন্ন আটককেন্দ্রে বন্দি ছিলেন দুই হাজারের বেশি বাংলাদেশি।
বিভিন্ন গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী মানবপাচারের শিকার হয়ে লিবিয়ায় আসা অভিবাসীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হন। বিভিন্ন সময়ে মানবপাচারকারীরা তাদের আটক করে নির্যাতন করার পাশাপাশি দেশে থাকা পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে। এছাড়াও দেশটির বিভিন্ন আটককেন্দ্রেও অমানবিক পরিবেশে তাদের থাকতে হয়।