- সারাদেশে ব্ল্যাক আউট।
- কারফিউ, সেনা মোতায়েন।
- দেখামাত্রই গুলির নির্দেশ।
- জাতীয় নেতৃবৃন্দের গণগ্রেফতার।
- তিন শতাধিক নিহত, সহস্রাধিক আহত।
- পৃথিবী থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন।
- সকল লেনদেন, যোগাযোগ বন্ধ।
- সারাদেশে কমপ্লিট শাট ডাউন।
- ছাত্র জনতার আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ।
লণ্ডন, ২২ জুলাই: অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ২০২৪। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আজ যেভাবে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে বাংলাদেশের মানুষকে যেভাবে জিম্মি করে রেখেছেন, আজ থেকে ৫৩ বছর আগে ১৯৭১ সালে ঠিক এভাবেই দেশকে অবরুদ্ধ করে, দেশের মানুষকে জিম্মি করে রেখেছিলেন তৎকালীন স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ প্রথম অবরুদ্ধ হয় ঢাকা শহর। প্রথম এক সপ্তাহ, প্রতিদিন রাতে দেখা যেত লেলিহান আগুনের শিখা আর শোনা যেত গুলির শব্দ। সকালে দেখা যেত ভস্মীভূত ঘরবাড়ি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশ। কারফিউ তো বলবত্ ছিলই, কিন্তু যখনই একটু শিথিল হতো, তখনই দেখা যেত রাজপথ ভরে উঠছে মানুষে। হাজার হাজার মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। খোঁজ করছে আত্মীয়স্বজনের। আবার কারফিউ, আগুন, গুলি। ৫৩ বছর পর সেই ভয়াবহ দিন শেখ হাসিনা আবার বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনেছেন। রেব,পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হামলায় সারাদেশে ৩ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। নিহতদের মাঝে নারী, শিশু, কিশোর, বৃদ্ধও রয়েছেন। সরকারি বাহিনী শুধু গুলি করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, মৃতদেহের মাথা গাড়ি চাপা দিয়ে থেতলে দিচ্ছেন।
সারাদেশে সরকারি বাহিনীর পৈশাচিক হামলায় এ পর্যন্ত তিন শতাধিক ছাত্র জনতা নিহত ও সহস্রাধিক আহত হয়েছেন বলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে। হামলায় নিহতদের স্মরণে সোমবার বাদ জোহর সারাদেশে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানেও রেব পুলিশ হামলা করেছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ঘরে ঘরে সরকারি বাহিনীর চিরুনি অভিযান চলছে৷ আটককৃতদের পুলিশ ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোটা বিরোধী আন্দোলনরত ছাত্ররাও তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। আদালতের রায়কে তাঁরা প্রত্যাখান করেছেন।
আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার পর সংগঠনটির ৫৯ জন সমন্বয়ক ও সহসমন্বয়ক এক যৌথ বিবৃতিতে রবিবার বলেন, কমপ্লিট শাট্ডাউন অব্যাহত থাকবে। আদালতের এই রায় পক্ষপাতদুষ্ট। পরবর্তীতে সরকার এই রায়কে যথেচ্ছা ব্যবহার করতে পারবে।
সমন্বয়ক আবদুল কাদের স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে ৯ দফা উল্লেখ করে বলা হয়েছে সরকারকে এই দাবীগুলো মেনে নিতে হবে অবিলম্বে। এতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সব হত্যার দায় নিয়ে প্রকাশ্যে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান, সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করতে। দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। বিভিন্ন স্থানে হামলা ও হত্যার দায়ে ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের বরখাস্ত করতে হবে। অবিলম্বে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হল খুলে দিতে হবে। ঢাবি, জাবি রাবির উপাচার্য ও প্রক্টরদের পদত্যাগ করতে হবে। ছাত্র জনতার উপর হামলা করে হত্যার সঙ্গে জড়িত পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ কর্মীদের আটক করে হত্যা মামলা দায়ের করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার করতে হবে। শহীদ ও আহতদের পরিবারকে ক্ষতিপুরণ প্রদান করতে হবে। ঢাবি, জাবি, রাবি ও চবিতে ছাত্রলীগে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতে কোনো ধরনের হয়নারি করা যাবে না। দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র সমাজ পিছু হটবে না বলে তারা মন্তব্য করেন।
শেখ হাসিনার অনৈতিক সরকার গুম, খুন করে দেশে আবারো এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ জুলাই মধ্যরাতে কারফিউ ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার৷ বেসামরিক বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা হয়েছে৷ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নানা সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে এ পর্যন্ত তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা, সোচ্চার – টর্চার ওয়াচডগ বাংলাদেশ, চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের বিস্তারিত তথ্য সহকারে নথি প্রস্তুত করছে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশ প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের আহবানে সাড়া দিয়ে বিরোধী দলগুলো মাঠে নেমেছে। ফলে হাসিনা পতনের এক দফা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এ আন্দোলন চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছে। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান ও মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।।
বাংলাদেশে সহিংসতায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জাতিসংঘের
বাংলাদেশে চলমান সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ইউএন হিউম্যান রাইটস এর কমিশনার ফলকার ট্যুর্ক৷ এক বিবৃতিতে তিনি এসব ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন৷
বাংলাদেশে চলমান আন্দোলনে মৃত্যু ও আহত হবার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ফলকার ট্যুর্ক বলেন, ‘‘শিক্ষার্থীদের উপর হামলা বিশেষভাবে মর্মান্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য৷ এই হামলাগুলোর নিরপেক্ষ, তাৎক্ষণিক ও পরিপূর্ণ তদন্ত হতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি করতে হবে৷’’
তিনি সবপক্ষকে সংযত হবার আহ্বান জানান৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেন৷ শিক্ষার্থীরা যেন কোনো প্রাণনাশ বা যে কোনো ভয় ছাড়াই শান্তিপূর্ণ মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে সেজন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার দাবি জানান জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার৷ বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার সমালোচনাও করেন ট্যুর্ক৷ তিনি বলেন, এই ঘটনা ‘‘অসমভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে সীমিত করে,’’ বিশেষ করে একটি সংকটময় পরিস্থিতিতে৷ তিনি অবিলম্বে ইন্টারনেট চালু করার দাবি জানিয়েছেন৷
পাঁচ শতাধিক গ্রেপ্তার, কূটনীতিকদের প্রশ্ন
বাংলাদেশে কোটা নিয়ে আন্দোলনে সংঘর্ষে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পর বিরোধী নেতাসহ ৫০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে সোমবার জানিয়েছে পুলিশ৷ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র ফারুক হোসেন বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ”সহিংসতার ঘটনায় অন্তত ৫৩২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷”
আটক হওয়াদের মধ্যে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী আহমেদ রয়েছেন বলেও জানিয়েছেন পুলিশের মুখপাত্র৷ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক এবং বিএনপির আরেক জ্যেষ্ঠ নেতা আমিনুল হককেও আটক করা হয়েছে৷ জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক মিয়া গোলাম পরওয়ারকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
পুলিশের মুখপাত্র জানিয়েছেন, রাজধানীতে অশান্তির সময় অন্তত তিনজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন এবং আরো প্রায় এক হাজার আহত হয়েছেন৷ আহততদের মধ্যে ৬০ জনের অবস্থা গুরুতর৷
কোটা আন্দোলন, বিক্ষোভ, সহিংসতা নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের রোববার ব্রিফ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ এএফপি জানিয়েছে, বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ রাষ্ট্রদূতদের একটি ১৫ মিনিটের ভিডিও দেখান, যেখানে বিক্ষোভকারীদের সহিংসতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে৷
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ কূটনৈতিক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঘটনার একতরফা উপস্থাপন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদকে পিটার হাস বলেছেন, ”আমি আশ্চর্য হয়েছি যে আপনি নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর ফুটেজটি দেখাননি৷”
একই কূটনৈতিক সূত্র উদ্ধৃত করে এএফপি আরো জানিয়েছে, বিক্ষোভ দমন করার জন্য জাতিসংঘের লোগো চিহ্নিত সাঁজোয়া যান এবং হেলিকপ্টার ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে৷ এ নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিনিধির করা প্রশ্নের জবাব দেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ৷
বাংলাদেশে প্রাণহানি ও সহিংসতায় উদ্বিগ্ন ইইউ
কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রাণহানি এবং সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ শুক্রবার এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুখপাত্র৷
আর যেন সহিংসতা না হয় সেদিকে নজর দেয়ার উপর জোর দিয়েছে ২৭ দেশের এই জোট৷ আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার ভিত্তিতে চলমান পরিস্থিতির দ্রুত এবং শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছেন তারা৷