বাংলা কবিতায় কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর আবির্ভাব ৬০ দশকের শেষার্ধে। যদিও তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। প্রথম গ্রন্থ থেকেই তিনি স্বাতন্ত্র্য নিয়ে হাজির হয়েছেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কবিতার জগতে। সামগ্রিক কাব্যকর্মে পরীক্ষানিরীক্ষা, ভাষিক স্বাতন্ত্র্য, শিল্পকুশলতা আর বিষয়ের বৈচিত্র্য হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে ষাটের প্রধান কবিদের অন্যতম করে তুলেছে। কিন্তু নির্জন স্বাক্ষরসুলভ স্বভাবের কোলাহলহীনতা তাকে মোহিনী আড়ালে রেখেছে দীর্ঘদিন। হাবীবুল্লাহ সিরাজী এখন ক্রমশই উন্মোচিত হচ্ছেন তার কবিতার সামগ্রিক গুরুত্বসহ। ইতিমধ্যে তার কবিতা ইউরোপিয় ও এশিয়ার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজীর জন্ম ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৩২টি। এ ছাড়া তিনি তিনি ২টি উপন্যাস, ২টি প্রবন্ধ, ১টি স্মৃতিকথা এবং ১০টির মতো ছড়াগ্রন্থ রচনা করেছেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি ২০১৬ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। ২০১৮ সালে ২০ ডিসেম্বর থেকে তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে নিযুক্ত আছেন।
কবি হাবীবুল্রাহ সিরাজীর কার্যালয়ে এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন কবি রাজু আলাউদ্দিন। সাক্ষাৎকারটি শ্রুতি থেকে লিপিরূপ দিয়েছেন তরুণ কথাসাহিত্যিক সাব্বির জাদিদ।
রাজু আলাউদ্দিন: মানে কখনোই সাংঘর্ষিক মনে হয় নাই?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: তা হয়েছে কখনো কখনো! এজন্য অনেকের অবহেলা, সামাজিক অনাচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। অনাচারটা কী? অনেকে ভেবেছেন, আরে একে কেনো এখানে জায়গা দেব! এ তো বিজ্ঞানের ছাত্র। ও এইটা কেনো লিখবে! এইসব আর কি!
রাজু আলাউদ্দিন: এটা একেবারেই উপরি কাঠামোর ব্যাপার। এটা জানার পরেও আমার কিন্তু একটা কৌতূহল থাকে, আপনার প্রথম বই, সেই বই শুধু নামের কারণেই না…
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: প্রথম বইয়ের আপনি প্রথম কবিতাটা দেখেন ‘সেও এক বিস্ময়’… আধুনিক মনষ্কতার একদম বিপরীতমুখী শব্দ ‘বিস্ময়’। কোনো আধুনিক মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করতে দ্বিধা করে। কোনোকিছুই তার কাছে বিস্ময়কর না। সে দেখবে, ধারন করবে, কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করবে না। কিন্তু আমি এখানে বিস্ময় দিয়ে, প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে শুরু করেছি। এন্টিপার্টি হিসেবে আমি চিন্তা করেছি। কিংবা এন্টিলজিক হিসাবে চিন্তা করেছি। লেখাটি গাছ– কিন্তু লেখাটি পড়লে আপনি এর ভেতর একটি বিজ্ঞান পাবেন।
রাজু আলাউদ্দিন: সরাসরি বৈজ্ঞানিক শব্দও আছে, ক্লোরোফরম যেমন। কিন্তু তারপরে আমার যেটা মনে হয়, প্রথম বইয়ের মূল চেতনা হলো প্রকৃতি ও বাস্তবতাকে মরমি চেতনার সুতোয় বুনে নিয়েছেন। এখানে দুটো দিকই আছে–প্রকৃতিমগ্নতা আছে, আবার বাস্তবের সাথে প্রকৃতিকে মিলিয়ে নেবার বিষয়ও আছে। মাঝখানে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে মরমি চেতনা।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আপনি এই ভাবনার প্রেক্ষিতে সঠিক। কিন্তু এই বইয়ে সবচেয়ে দুর্বল যেটা মনে হয়েছে, সেটা হলো ভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে আমি নিজস্ব কোনো ভাষা পাইনি। তার পরিপ্রেক্ষিতে আমার দ্বিতীয় বই মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতির ভাষা কিন্তু একদম ভিন্ন। ভাষার চরিত্র, কাঠামো, রূপ–সবক্ষেত্রেই ভিন্ন।
রাজু আলাউদ্দিন: তবে সিরাজী ভাই, এখানে আপনার সঙ্গে আমি মৃদু তর্ক করব– ভাষা নিয়ে অসম্ভব রকমের গুরুত্ব দেওয়া হয় শুধুমাত্র আমাদের এখানে। অনেকেই বলেন তার কোনো পোয়েটিক ডিকশন তৈরি হয়নি ইত্যাদি। আমি মনে করি ভাষাটা এমনিতেই তৈরি হয়ে যায়। যখন কোনো কবির নতুন চেতনাবোধ তৈরি হয়, তখন ভাষা আলাদা হবেই। প্রথম বইয়ে হয়তো ভাষা তীব্রভাবে আসেনি যেটা দ্বিতীয় বইয়ে এসেছে। কিন্তু এই বইয়ের আলাদা একটা চরিত্র আছে। সেই চরিত্র বিষয়গত দিক থেকে আরকি! এই কারণে প্রথম বইটাকে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। এখানে ভাষার দিকে হয়তো আপনি অতটা মনোযোগ দেননি।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: না, মনোযোগ আমি দিয়েছি। কখনো কোনো সিরিয়াস লেখক যদি মনোযোগ না দেন, তাহলে তিনি নিজের ক্ষতি করেন। মনোযোগ আমি দিয়েছি। হয়তো প্রকাশ করতে পারিনি।
রাজু আলাউদ্দিন: সেটা হতে পারে। তারপরেও এই বইয়ের মূল্য আমি মনে করি ভালো রকমেরই আছে। আমার এই কবিতাটা ভালো লাগছে–‘আঙুরবালা: নজরুল’।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: ‘আঙুরবালা নজরুল’-এর ভেতরে সত্যিকারার্থে একটা মিলমিশ করার চেষ্টা করেছি।
রাজু আলাউদ্দিন: এরপর মানুষ ও পাখি…আপনার প্রকৃতিমগ্নতা, আপনি মানুষকে পাখি থেকে আলাদা করে দেখতে পাচ্ছেন না। আলাদা মনেই হয়নি।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: এখানে আমি ফরিদুদ্দীন আত্তারের নাম বলব। ফারসি কবি। পারিন্দা বা পাখি নিয়ে তাঁর চমৎকার চিন্তাভাবনা আছে। আজকে আধুনিক উপায়ে আমরা ইকারুস নিয়ে কথাবার্তা বলি, সে মোমের পাখা লাগিয়ে উড়তে গিয়েছিল, এই যে পারিন্দার অন্তরীক্ষের রূপ মানুষের সঙ্গে যায়, এইটার কাছাকাছি যাওয়ার জন্য আমি…
রাজু আলাউদ্দিন: যেমন কনফারেন্স অব দ্য বার্ড–মান্তেক আল তাইর। পাখিগুলো দেখল যে ওরা যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তারা নিজেরা প্রত্যেকেই আসলে অনুসন্ধানের অংশ। এখন তো ধরেন আমাদের পরিবেশচেতনা এই সময়ে এসে অনেক তীব্র হয়েছে। আপনি যখন লিখলেন ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’– সেই সময় কিন্তু এই বিষয়গুলো অত তীব্র আকারে আসেনি।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আসেনি। কিন্তু প্রকৃতির কাছে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল। এরপর আমাদের অনেক বিখ্যাত কবি পরিবেশ ও প্রকৃতির কবিতা নাম করে করে লিখেছেন। আমি নাম করে লিখিনি। কিন্তু আমি ভেতর থেকে উঠে আসতে চেয়েছিলাম।
রাজু আলাউদ্দিন: নাম করে লিখেছেন, যখন এইসব নিয়ে আন্দোলন তৈরি হয়েছে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আন্দোলন তৈরি হয়েছে, খবরের কাগজে এইসব পড়েছেন, তারপর লিখেছেন। কিন্তু আমার ভেতরবোধ থেকে বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রকৃতিকে যুক্ত করে এই বইটির লেখাগুলোর কথা চিন্তা করেছিলাম।
রাজু আলাউদ্দিন: এক্সাটলি। এটা নিয়ে যে কখনো আন্দোলন হবে, সেই ভাবনা থেকে তো আপনি লেখেননি। কবি হিসেবে আপনি অনুভব করেছেন, লিখেছেন। এটিই হচ্ছে মূল কথা। আপনার দ্বিতীয় গ্রন্থ সম্ভবত বছর দুয়েক পরে প্রকাশিত হল?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হ্যাঁ, দুই বছর পর বেরিয়েছে।
রাজু আলাউদ্দিন: তবে দ্বিতীয় বইয়ের থেকে তৃতীয় বই আমাকে বেশি টেনেছে। যদিও দ্বিতীয় বইয়ের ভাষার ব্যাপারে…..
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: প্রথম এবং দ্বিতীয় গ্রন্থের মধ্যে আমার ইন্টারমিডিয়েট গ্রন্থ হলো মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি। ভাষার রূপটা বদল করতে পারি কিনা, আমি যে মেসেজটা দেব বা যা বলতে চাই সেটাকে অন্যভাবে বলতে পারি কিনা এসব নিয়ে ভেবেছি। আমি তখন সময়কে ধরতে পারছি কিনা এই সংশয়ে ভুগছিলাম। তৃতীয় বই মধ্যরাতে দুলে ওঠে গ্লাশ-এ আমি অনেক খোলা। এখানে কোনো সংহত রূপ নাই। কিন্তু মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতিতে দেখবেন আটোসাটো একটা ব্যাপার আছে। আমি ওটা থেকে বেরিয়ে আসি এবং দেখি যে মধ্যরাতে দুলে ওঠে গ্লাশ লিখতে পারি কিনা।
রাজু আলাউদ্দিন: আমার ভালো লাগছে তৃতীয় গ্রন্থটি।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: তৃতীয় গ্রন্থটিই মধ্যরাতে দুলে ওঠে গ্লাশ। এখানে পোয়েটিক ডিকশন বলে যে কথাটা বললেন, গুরু হিসাবে যাকে আমি এখনো মানি, সেই ডিলান টমাসকে আপনি এখানে পাবেন।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনার তৃতীয় গ্রন্থে আমি দেখলাম যে, শব্দ নিয়েও অনেক রকমের নাড়াচাড়া আছে। যেমন, ‘চারুকার্য’ এটা বোধহয় আপনিই প্রথম ব্যবহার করেছেন। সবাই বলে কারুকার্য, আপনি বললেন চারুকার্য। আচ্ছা, এই ‘নারঙ্গি’ কি আপনি কমলা অর্থে ব্যবহার করেছেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: কমলা অর্থে।
রাজু আলাউদ্দিন: আমার মনে হল যে ফররুখ আহমদের পরে সম্ভবত আপনিই প্রথম ব্যবহার করলেন। এই নারঙ্গি শব্দটা দ্বিতীয়বার আপনার এখানে পেলাম। আর ‘সুখ’ কবিতার মধ্যে একটা ইমেজ আছে যেটা আমার ভীষণ ভাল্লাগছে– ‘সোনার রঙে রঙ লাগানো অ্যাশট্রেতে গুপ্তচরা’। ‘অ্যাশট্রেতে গুপ্তচরা’ মানে কি অ্যাশট্রের মাঝখানের তলাটা?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হ্যাঁ।
রাজু আলাউদ্দিন: তাহলে ঠিকই ধরেছি। এটা একেবারেই ইনসিগনিফিকেন্ট একটা ব্যাপার। কিন্তু ওটাকে চরের সাথে মিলিয়ে দেখানো–এটা আমার ভালো লাগছে। আপনার প্রথম গ্রন্থের একটা কবিতা আমার খুবই পছন্দের, সেটা হলো–‘ওফেলিয়া প্রভাতে গমন’। আমরা তো জানি ইংরেজি কবিতায় ওফেলিয়া খুবই সেলিব্রেটি ক্যারেক্টর। আপনি যখন এই কবিতাটি লিখলেন, তখন কি ওইটা আপনার মাথায় ছিল?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: মাথায় ছিল। এবং আমার সিমিলিটা হ’ল, আমার প্রথম কন্যা, তার নাম ওফেলিয়া, সে মারা যায়, আমি তো শেক্সপিয়র হতে পারব না, ও মারা গেলে তখন আমি মনে করলাম এটা জাস্ট আমার ওফেলিয়া।
রাজু আলাউদ্দিন: কবিতাটা খুবই ভালো লাগছে। ওইখানেও আমি রিলেট করে দেখার চেষ্টা করলাম–অসামান্য কবিতা। শামসুর রাহমান ভাইয়ের সঙ্গে যখন আমার কথা হলো একটা ইন্টারভিউতে, গ্রিক মিথের একটা চরিত্র বারাবার তাঁর কবিতার মধ্যে এসেছে, আমি তাঁকে বললাম, এটা কি আপনার সন্তান মতিন যে পানিতে ডুবে মারা গেছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। এটা আর কেউ আগে কখনো বলেনি।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আইডেন্টিফাই করেনি।
রাজু আলাউদ্দিন: আইডেন্টিফাই করতে পারেনি কেনো এই গ্রিক মিথ তাঁর মধ্যে বারাবার আসছে। পরে বললেন যে, তুমিই ব্যাপারটা ধরতে পেরেছ। এটা আমাকে কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। আমিও কাউকে বলিনি। এই প্রথম তোমাকে বললাম। এই ওফেলিয়া পড়তে গিয়ে আমার আবার ওইটার কথা মনে পড়ল। কিন্তু আপনি ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’ নামের এই কবিতাকে আপনার দ্বিতীয় বইতে নিয়েছেন। এটার কারণটা আপনি বলবেন কি? কেন কবিতাটা প্রথম বইয়ে রাখেননি?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: এই কবিতাটা ওখানে রাখিনি এই কারণে, এটার ভেতর নিজের প্রতি নিজের ক্ষোভ বলি আর দুর্বলতা বলি–আমিও দাও বৃক্ষ দাও দিন নামে একটি বই লিখছিলাম এবং এই নামে আমার একটি কবিতা আছে। সবাই তো গ্রন্থভুক্ত যে কোনো একটা কবিতার নাম দিয়ে বই করে, আমি একটু উল্টা পথে হাঁটলাম, দ্বিতীয় বইতে এসে পাঠককে মনে করালাম যে দাও বৃক্ষ দাও দিন নামে আমার একটা বই আছে।
“কিন্তু ওইটাকে আমি না বলে সোনার মুকুট হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অধিষ্ঠানকে বললাম যে উনি আমাদের সোনার মুকুট। সঙ্গে গেল হিরের আঙটি, লাল নাকফুল, টিপ…”
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু কবিতাটা প্রথম বইয়ের সময়েই লেখা?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হ্যাঁ, ওই সময়েই লেখা। ইচ্ছা করে প্রথম গ্রন্থে রাখিনি।
রাজু আলাউদ্দিন: আচ্ছা। এটা নিয়ে আমার একটা রহস্য ছিল আর কি! তৃতীয় গ্রন্থের বছর খানেক পরেই বেরোল আপনার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ হাওয়া কলে জোড়া গাড়ি। এই গ্রন্থের কবিতাগুলোর কোনো শিরোনাম নেই। যেমন ছিল না শঙ্খ ঘোষের দিনগুলি রাতগুলি গ্রন্থে। ওখানে যদিও সরাসরি বলেননি, তবে মনে হচ্ছে, ‘আট কোটি মানুষের সাহসী সঞ্চয়’ বলতে আপনি বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে চেয়েছেন। এটার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে যদি বলেন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: এইটার প্রেক্ষাপট–‘ জোছনাময় মধ্যরাতে চুরি গেল সোনার মুকুট’– আপনি দেখবেন কয়েক দিন আগেই তাঁর বড় ছেলের বিয়ে হয়েছে এবং বিয়ের উপহার হিসেবে উনি সোনার মুকুট পেয়েছিলেন। ওইটা মাথায় এসেছিল; কিন্তু ওইটাকে আমি না বলে সোনার মুকুট হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অধিষ্ঠানকে বললাম যে উনি আমাদের সোনার মুকুট। সঙ্গে গেল হিরের আঙটি, লাল নাকফুল, টিপ…
রাজু আলাউদ্দিন: এগুলোকে তাঁর সন্তান বোঝাচ্ছেন। এই অনুষঙ্গগুলো জীবিত মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করছে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। ‘রক্তে ভেজা একখণ্ড সবুজ কাপড় উড়তে উড়তে…’এটা হচ্ছে বাংলাদেশ।
রাজু আলাউদ্দিন: অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লেখেন, দেশাত্মবোধক কবিতা লেখেন, হয়তো সেগুলো আবেগ দিয়ে লেখেন; কিন্তু কেনো জানি সেগুলো এক ধরনের কৃত্রিমতায় কিংবা এক ধরনের স্লোগানধর্মিতায় গিয়ে শেষ হয়।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ব্যাপারটা এইভাবে আপনি উন্মোচন করেছেন।
রাজু আলাউদ্দিন: ‘চুরি গেল পালানের গাই, মাঠের ফসল…’
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: এবার বাংলাদেশ চলে আসছে। ‘চুরি গেল পালানের গাই, মাঠের ফসল, লেকের ফুটন্ত পদ্ম, অরণ্যের বাঘ, পোষা পাখি, বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়ি, ইলিশের ঝোল।’
রাজু আলাউদ্দিন: ইলিশের ঝোল বললে আসলে বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রধান অনুষঙ্গ বোঝায়।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হ্যাঁ। আর এই হলো চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইলের আকাশ বাতাস। সব চুরি হয়ে গেল। চুরি গেল..
রাজু আলাউদ্দিন: ‘চুরি গেল হাত বাকসে জমা রাখা একটি হৃদয়।’
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: বাঙালি হাত বাকসে জমা রাখছিল এই হৃদয়টা।
রাজু আলাউদ্দিন: আমার মনে হচ্ছে এই কবিতাটা লিখতে গিয়ে আপনি বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণকেই দেখছেন না, বঙ্গবন্ধুর সাথে সাথে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা অনুষঙ্গ চলে আসছে। ইট ইজ বিউটিফুল। আরেকটা জিনিস আমি বলতে চাচ্ছিলাম, কবিতাগুলোর কোনো শিরোনাম দেননি, এটা কি শঙ্খ ঘোষ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: না না। আমি ভেবেছিলাম, আমি যে ঢেউয়ের ভেতর যাচ্ছি, শিরোনাম দিলে ওটা ভেঙে যাবে। অতএব এই ঢেউটা থাকুক। ঢেউটা শেষ অবধি থাকুক। আপনি প্রথম কবিতাটা পড়ুন, পড়লে ঢেউটা ধরতে পারবেন।
রাজু আলাউদ্দিন: ‘যে নারী শস্যের সখী আমি তার প্রথম প্রেমিক। যে নারী শ্রমের সঙ্গী, আমি তার ভালোবাসা চাই। যে নারী স্বপ্নের পক্ষে, আমি তার চোখ খুলে নেব। যে নারী নুনের বন্দী আমি তার প্রধান পুরুষ। পুরুষেরা বড় বেশি প্রবঞ্চক, সীমারেখাহীন। পুরুষেরা সামান্য সঞ্চয়ী হলে মাতামাতি করে। পুরুষেরা ভেড়া ও ঘোড়ার ন্যায় উভয় পক্ষের। পুরুষেরা দিনহীন রাত্রিহীন নৌকার গলুই। নারী ও পুরুষ যেন ভাদ্র মাসে পদ্মার ইলিশ। ঝোল ঝাল উপচে পড়া আমিষ ও সব্জির নিরমিষ।’
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: এই হলো আমার বাংলাদেশ। এই হলো আমার নারী পুরুষের ধারণা। নারী ও পুরুষ যেন ভাদ্র মাসে পদ্মার ইলিশ। ঝোল ঝাল উপচে পড়া আমিষ ও সব্জির নিরমিষ। মানে আমিষ ও সব্জি মিলে নারী পুরুষ। এই মিলেই মানব সৃষ্টি। এবং এই মিলেই সবকিছু। এই সাইক্যাডেলিক ওয়েতে আপনি বঙ্গবন্ধুকে পেলেন। এইভাবে শেষ কবিতায় পৌঁছাতে হবে।
রাজু আলাউদ্দিন: ‘কবিও বাজার করে। নায়, খায়, দুপুরে ঘুমায়, মলমূত্র ত্যাগ থেকে যৌনক্রিয়া সন্তান-পালনে ব্যস্ত থাকে। বাণিজ্যে বিনয়ী হয়। পরচর্চা করে। মাঠের রাখাল হয় কর্মকাণ্ডে নেতা ও জনতার। কবি কি মাতাল হয়? শুয়োরের মতো কাদা ঘেঁটে অলিতেগলিতে ঘোরে, কাঁদে হাসে, জন্মমৃত্যু দেখে, ফসলের ভাষা জানে? সমুদ্রের ডাক শোনে একা। স্মৃতির ভেতর থেকে নড়ে ওঠে পুঁজির পাহাড়। মানুষের পক্ষে যায় কবির সংসার লেখালেখি। কবির স্বপক্ষে শুধু মহাশূন্য, আর সব মেকি।’
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: এই তো শেষ করলাম।
রাজু আলাউদ্দিন: এই টোনের মধ্যে সম্মোহনী উচ্চারণ আছে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: এই পথযাত্রায় বঙ্গবন্ধু এসেছেন। আরো অনেকেই এসেছেন। সে জন্য আমি আর শিরোনাম দেয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। শিরোনাম না দিলেও চলে।
রাজু আলাউদ্দিন: প্রথম কবিতার তৃতীয় লাইনে আপনি বলেছেন: ‘নারী স্বপ্নের পক্ষে, আমি তার চোখ খুলে নেব।’
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: এটা হলো এন্টি-পোয়েট্রি। এখানে ‘স্বপ্ন’ মানে কী? স্বপ্ন কিন্তু সব সময়ই অবাস্তব। আমরা তারপরেও বলি অবাস্তব স্বপ্ন। এখন নারী প্রতিরূপে স্বপ্নকে যখন আমি গ্লোরিফাই করি, তখন স্বপ্ন সবসময় আশার কথা বলে। যে নারী আশার কথা না বলে অবাস্তব স্বপ্নের কথা বলে, তার বিপক্ষে আমি। এখানে যে কেউ দু’লাইন পড়ার পরেই চমকে উঠতে পারেন। ধাক্কাটা এখানেই।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি ইচ্ছা করেই ধাক্কা দিয়েছেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: অবশ্যই। আমি সব সময় ‘সু’ আর ‘কু’ পাশাপাশি নিয়ে চলি। কখনো সু-কে একান্ন থেকে নিরানব্বইতে তুলি, সু-কে একে নামিয়ে আনি; আবার কখনো কু-কে উনপঞ্চাশ পর্যন্ত নিই; কু-কে কখনো পঞ্চাশের উপর তুলতে দিই না। সু-কে পঞ্চাশের উপরে রাখি। আমার পোয়েট্রি এন্টি-পোয়েট্রি; নায়ক-প্রতিনায়ক সব কবিতায় পাশাপাশি চলে।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনার কৃষ্ণ কৃপাণ ও অন্যান্য কবিতা–এইখানে আপনি টানা গদ্যে কবিতা লিখেছেন। এই প্রসঙ্গটা আসছে এই জন্য যে, কাব্যগ্রন্থ শুরুর আগেই আপনি ভাষা নিয়ে নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছেন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আপনি খুবই ভালো জানেন যে, বাইবেলিক ভার্স নিয়ে বাংলা ভাষায় নানাজন নানা চিন্তা করেছেন। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত থেকে শুরু করে অনেকেই চমৎকার চমৎকার সব কাজ করেছেন। আমার একটা কথা ছিল যে..
রাজু আলাউদ্দিন: অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ওগুলো পরের দিকে করেছেন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: পরের দিকে করেছেন, প্রথম দিকে নাই। আমি এখনকার প্রেক্ষিতে বলছি, উনি কাজ করেছেন। আমি যখন করতে গেলাম, তখন আমার সাহসটা সঞ্চয় করতে পারিনি। আমি যদি ১৯৬৯-৭০ সনে বাইবেলিক ভার্স লিখতাম, তখন হইত সময় উপযোগী যথার্থ লেখা। কিন্তু আমি সাহস পাই নাই। সেই লেখাটা প্রকাশের জন্য আমি ফিরে আসলাম আশিরও পরে। এবং আমাকে সাধু ভাষা বেছে নিতে হলো। এবং ওকে জাস্টিফাই করার জন্য ওই গ্রন্থের প্রারম্ভের কিছু কবিতা সাধু ভাষায় লিখতে হলো, যে, ওকে এই টানে নিয়ে যাব। ওই যে, সামনে যে গুন টেনে যায়, সে হঠাৎ করে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়ে থাকে। নৌকা আপনিই চইলা আসে। এটা হলো যে, ওই টানটা দিলাম। ওইটুকুন দেখি আপনিই যায় কি না। নাকি স্রোত এসে তাকে আটকায়ে রাখে। সে জন্য আপনি প্রথম একটি কবিতা যদি পড়েন…
রাজু আলাউদ্দিন: ‘তাহারা উড়াল দিল…’
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: ‘তাহারা উড়াল দিল, দুলিয়া ভুলিয়া গেল নাকোর পাড়ায়, তাহাদের অঙ্গে আর পায়ের গোড়ায় লাগিল ময়লা ধুলো, রাজপথ তাহাদের দিল হাতছানি। হাতছানি দিল ওই মেঘমালা, চন্দ্রলোকে কৃষ্ণ রানী। জোছনায় ভাসিয়া গেল পল্লীর শুকর আর মাতালের মাথা। তাহাদের চোখে চোখে স্বপ্ন ভাসে, ভাসে বুঝি নারীদের যাঁতা। রাজহাঁস উড়িয়া ঘুরিয়া আসে, হাসে মেয়ে, রাজপথ হাসে, বালক বালিকা যায়, সঙ্গে যায় আমোদে উল্লাসে। চলাচল বন্ধ প্রায় যাবতীয় শকট যান, একে একে তুলিল রাস্তা ভুলিল রাস্তার গতি অতিশয় বৃদ্ধ যে কামান, সেও দেখে তাহাদের চলাচল প্রীতি ও প্রণয়। গরুর রাখাল দেখে, বাসের চালক ভাবে এই তো সময়। চুমুক দিলেই যদি দুলিতে খুলিতে থাকে আকাশের তারা, রাস্তায় পড়িয়া থাক গাড়ি গরু, কেহ নাই তাহার পাহারা। রাতভর হাসিয়া খেলিয়া যায়, ভগ্ন ভাণ্ড ধুলায় গড়ায়, তাহাদের দেখাদেখি গরু ও গোপাল কিছু ময়লা ছিটায়। গায়ক থামিয়া যায়, নায়ক ভুলিয়া যায়, লেখক চলিয়া যায় উজান হাওয়ায়। রাজপথে রাজহাঁস প্রাতঃকালে একা একা যায়।’ এই যে রাজপথে রাজহাঁস একা একা যায়, এই আমি শুরু করলাম। এই যে শুরু করলাম, একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র বোঝানোর জন্য। ‘গতরে ঘামের গন্ধ হস্তে পদ্মফুল। গণ্ডে বক্ষে লণ্ঠন, খোঁপায় বকুল। দ্বারপ্রান্তে প্রতীক্ষায়, সঙ্গে সহচরী, কারে তুমি ঘরে নিবা সন্ধ্যার সুন্দরী? দুইপাশে বনছায়া নাব্য জলপথ, রাতের শরীর ভাঙে দিনের শপথ। যাত্রা শেষে মোহনায় আনত মাস্তুল, গতরে ঘামের গন্ধ হস্তে পদ্মফুল।’
রাজু আলাউদ্দিন: বাহ! চমৎকার! এটা ওয়ান অব দ্য বেস্ট ইরোটিক পোয়েম। আপনাকে আমি একটা কবিতার কথা বলি, কবিতাটার ইংরেজি অনুবাদ মনে হয় নেই। স্পেনিশটা হলো… অক্তাবিও পাস কিন্তু প্রচুর ইরোটিক কবিতা লিখেছেন এবং সরাসরি ইরোটিক কবিতা না লিখলেও ইরোটিক ইমেজ কাজ করেছে তার মধ্যে। এটা তাঁর অসাধারণ কাজ, কবিতাটা হচ্ছে ‘Entre tus piernas hay un pozo de agua dormida’। এর মানে হলো– ‘তোমার উরুর মাঝে আছে এক কুয়ো, ঘুমন্ত জলের।’ ঘুমন্ত জলের কুয়ো।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: বাহ!
রাজু আলাউদ্দিন: অসামান্য কবিতা। এইটা পড়তে গিয়ে…আপনি সরাসরি শরীরের কোনো বর্ণনা দিচ্ছেন না, তা না দিয়ে একেবারে ইরোটিক কবিতা তৈরি করছেন। দিস ইজ বিউটিফুল। আমি একটা দুটো কবিতা অমন করেছিলাম। যেমন, খেলার পুরো অনুষঙ্গ নিয়ে ইরোটিসাইজ করা। আবার ইরোটিক অনুষঙ্গ দিয়ে খেলাকে দেখানো।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমারও এ রকম আছে। ফুটবল নিয়ে আছে।
রাজু আলাউদ্দিন: আমি মনে করি, কাঠামোটা ভেঙে দিয়ে এটা করা উচিত।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি সরাসরি কোনো লেখা লিখি না। বঙ্গবন্ধুর কবিতাটা আপনি পড়লেন। এই যে মাতালটি মেথর পট্টি থেকে মদ খেয়ে সকাল করল, এরপর সন্ধ্যার বর্ণনা দিয়ে … এটা হচ্ছে রাজপথের আঁধার, এটা হচ্ছে মোহনায় মহোৎসব।
রাজু আলাউদ্দিন: শিরোনাম খুব চমৎকার।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: এইবার আপনার জায়গায় আসি। এখানে আমি চেষ্টা করলাম।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনার ‘মোহনায় মহোৎসব’ কি পাঠকেরা বুঝতে পারছেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: বোঝা তো উচিত। না বুঝলে আমার কিছু করার নেই। এই যে শুরু করছিলাম এখানে, শুরু করার পরে এর তো একটা শেষ করতে হবে। শেষ কিন্তু আমি প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল করেছি। এই শেষটা দেখেন : ‘অহো রহো অহো রহো প্রেম কহো প্রেম কহো। সুধারসে মাখামাখি গৃহবাসী পশুপাখি প্রেম কহো প্রেম কহো। দিবানিশি সযতনে প্রেম ধরো ছায়াবনে নিরালস্যে অঙ্গে অঙ্গে বায়ু জলে সুর রঙ্গে প্রেম কহো প্রেম কহো। অহো রহো অহো রহো প্রেম করো রূপ ভালে, দুঃখ সুখে মায়াজালে শুদ্ধ জামে সত্য কামে প্রেম কহো প্রেম কহো। অহো রহো অহো রহো প্রেম কহো প্রেম কহো।’
রাজু আলাউদ্দিন: একেবারে সরল স্বচ্ছ জলে ধুয়ে দেয়া।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: ধুয়ে দিলাম। এবার আমি পাঠককে বলছি। ‘কৃষ্ণকৃপাণ, তাহারা কাঁচা আমলকি সদৃশ্য।’ তাহার কী এখানে আমি বলতেছি না। ‘দুই মাড়ির মধ্যবর্তী স্থলে পাচক রস সংগ্রহে সর্বদা ব্যস্ত। যেন-বা লবঙ্গ দারুচিনি মুখগহ্বরে অবিরাম সুগন্ধ বিতরণ করিতেছে। হয়তো-বা লবণের দানা ওষ্ঠে স্পর্শ করিতে করিতেই সমুদ্রের জলে পরিণত হইয়া যাইবে। তাহারা এক প্রকার আতশবাজি। মুহূর্তে রঙিন আলোকমালায় ভরিয়া ওঠে চতুর্দিক। অথবা সমস্ত আলো ছায়ারূপ মিলাইয়া যায়।’– এই তাহার হলো নারী।
রাজু আলাউদ্দিন: হাহাহা।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আরেকটি লেখা দেখাই। ‘কে হায় হায় বলে? কে হাহাকার করে? কে বিলাপ করে? কে বিবাদ করে? কে অকারণ আঘাত পায়? কাহার চক্ষু লাল হয়? যাহারা দ্রাক্ষারসের নিকট বহুকাল থাকে, যাহারা সুরার সন্ধানে যায়। দ্রাক্ষরসের প্রতি দৃষ্টি করিও না। যদিও উহা রক্তবর্ণ। যদিও উহা পাত্রে চকচক করে। যদিও উহা সহজে গলায় নামিয়া দংশন করে। দ্রাক্ষারস নিন্দুক। সুরা কলহকারিনী। যে তাহাতে ভ্রান্ত হয় সে জ্ঞানবান নয়। হীতোপদেশ শ্রবণ কিংবা পাঠ করিবার মতো ধৈর্য থাকিলে মহাপুরুষে রূপান্তরিত হইবার সম্ভাবনা থাকে।’ এই হলো মধ্যভাবে আইসা উপলব্ধি। একদম অন্তিমের উপলব্ধি হইলো : ‘ঋসরাং মকরশম্মী শ্রোতশম্মী যাহান যার হবি। মৎসাদির মধ্যে আমি মকর আর নদীসমূহের মধ্যে আমি গঙ্গা। সরোবরের প্রস্ফুটিত পদ্ম নহে, রজনীর প্রথম প্রহরের কমুদি নহে। তৃণ ভূমিতে শিশির পতনের নিস্তব্ধতা নহে। মরালগামিনীর চম্পক অঙ্গুলি নহে। তুষার শৃঙ্গের রৌদ্র কিরণের তীক্ষ্ণ তরবারি নহে। তবে কি বাণিজ্য তরী শস্য ভাণ্ডারে লুকায়িত মুষিক। ফুসফুসের অভ্যন্তরে তাম্র ধুম্রের গাঢ় স্তর। প্রতাপের নিম্ন ভাগে অবস্থিত কৌলিন্যের প্রস্তর। শব্দহীনতার সহিত দূর পাল্লার অশ্বদৌড়। কোন কিছুই নয়। আবার সর্ব প্রকারের সর্ব আকারের সর্বভূতে বিরাজমান। নশ্বর কিংবা অবিনশ্বর।’ আমাকে স্থাপন কইরা এই পর্ব শেষ করলাম।
রাজু আলাউদ্দিন: এই গ্রন্থের প্রথম কবিতাটি, যেটি আমরা পড়লাম, সেটি কিন্তু আপনি সাধু ভাষায় লিখলেন। কিন্তু এই সাধু ভাষায় পাঠক একটুও বাধাগ্রস্ত বোধ করে না। কারণ এটিকে আপনি ছন্দ-স্পন্দনের মধ্যে ধরে রেখেছেন, ফলে সাধু ভাষার পক্ষে-বিপক্ষে থেকে আমি বলছি না–এই যে কবিতাগুলো, এগুলো একজন সাধারণ পাঠক পড়তে গেলে কি বাধাগ্রস্ত বোধ করবে না?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: করতে পারে।
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু এইগুলোর যে ভাবব্যঞ্জনা, যে ভাব-ঐশ্বর্য, সেইদিক দিয়ে এগুলো উতরে যায়। কিন্তু যদি এর ভাষা টানা গদ্যে লিখে যান, আপনি তো আর এরপরে আর টানা গদ্যে লেখেননি….
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: টানা গদ্যে যে লিখিনি এমনটা না। কিছু আছে। কিন্তু সেই লেখা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এইভাবে একসঙ্গে গ্রন্থিত করিনি।
রাজু আলাউদ্দিন: আমি জানতে চাচ্ছি টানা গদ্যে সাধু ভাষায় পাঠককে আকৃষ্ট করে ধরে রাখার ক্ষমতা কতটুকু থাকবে যে-সাধু ভাষা ইতোমধ্যে প্রয়াত, যে-সাধু ভাষা থেকে ইতোমধ্যে আমরা বহুদূর চলে এসেছি? আবার ওর পেছনে যাওয়া আমাদের জন্য কতটুকু সঙ্গত?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: সঙ্গত অসঙ্গতর ব্যাপারটি আমি এইভাবে দেখি যে, যখন আমি সাধু ভাষায় লিখতে আসলাম, তখন আমার মনে হলো, আমি যেরূপটি বলতে চাই এটা মনে হয় চলিত রীতিতে বলতে পারব না। বা ব্যঞ্জনার অংশটুকু আনতে পারব না। কৃষ্ণকৃপাণের প্রথমাংশে আপনি যে কবিতাগুলো দেখলেন, এর ভেতর অক্ষরবৃত্তের কবিতা আছে। সাধু ভাষায় এই রূপটি গ্রহণীয় নয়; কিন্তু আমার নিজের ভেতরে ম্যাজিক রিয়েলিজম বা এক ধরনের আশ্রয় তৈরি করার জন্য লিখলাম। এই কারণে আপনি দ্বিতীয় কবিতাটি ‘মোহনায় মহোৎসব’ পড়ে আপ্লুত হলেন। এখানে এসে আমি গদ্যের ভেতর দিয়ে চেষ্টা করে দেখতে চাইলাম সাধু ভাষায় আর কতটুকু আগাতে পারি। এটা করার পরে আমি দেখলাম, না, আমার পক্ষে আর আগানো সম্ভব না।
রাজু আলাউদ্দিন: আমি মনে করি এই এক্সপেরিমেন্টের আবার দরকার আছে। আমাদের বোঝা দরকার যে ভাষা কতদূর যেতে পারে। সে কী কী করতে পারে। যে কারণে এগুলো একটা দ্বীপ হিসেবে থাকবে, যেখানে আমরা মাঝে মাঝে পিকনিক করতে যাব।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: এটাকে আমি কবিতা বলছি না। আবার সাধুরূপ যেটা সেটা আমি পুরোপুরি স্বীকার করছি না আবার অস্বীকারও করছি না। এটাকে কবিতা না বলে পড়েন গদ্য, আর সাধুরূপকে পড়েন চলতি। আপনাকে পড়ে শোনাই: ‘ভাতের দেমাগ ফুরাতে না ফুরাতে মদের দেমাগ দেখায়; আর তারপর মাগির দেমাগের সঙ্গে বাজায় সোনার সিন্দুক। ফোটায় শিশের গুলি। এ বড় সুসময়ের কথা। বড়ই আনন্দের বার্তা। একাত্তরে ফেনের গন্ধে মুখ পাতা ছিল দায়। একানব্বইয়ে বাসমতী ছাড়া গলা দিয়ে নামে না। আর এগারোতে এসে, ও ভাত নো ডিয়ার, ওতে সুগার! ক্লাবের পাটাতনে এক স্লাইস প্রাইম বিফ একটু হাসি খেলা করল তো পাঁচতারা হোটেলের ক্যাভিয়ার জিহ্বার ঢালে মৃদু চুমু খেল। দিন ও রাতের ফারাক যে বিস্তর।’ এই বইয়ে এই উত্তরের অংশ গদ্যে।
রাজু আলাউদ্দিন: এটা তো আমরা লক্ষ্য করছি, ভাষায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টা সব সময়ই আপনার ভেতর প্রবহমান থেকে গেছে। এমন না যে ওখান থেকে মনোযোগ সরিয়ে আপনি অন্যদিকে এগোতে থাকলেন। ভাষা আপনার মেইন কনসার্ন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: ভাষা আমার প্রধান বিবেচনার বিষয়। তবে মেসেজও আমি দিতে পারব জানতাম। কিন্তু ভেবেছি পুরনো মেসেজও যদি ভাষারূপে নতুনভাবে উপস্থাপন না করতে পারি, তাহলে ওই মেসেজের কোনো গুরুত্ব থাকবে না। সেই কারণে আমি চেষ্টা করেছি ভাষার ভেতর দিয়ে, যেমন কখনো শব্দজোড়, কখনো শব্দবন্ধ, কখনো বাক্যরূপ, কখনো ক্রিয়াপদের ব্যবহারের নানারকম কাজ করে এসেছি। এগুলো করার পেছনে, আমি স্বীকার করছি, সবগুলোকে মনে করেছি দুর্বল প্রয়াস। এখন সত্তর বছর পার করার পর মনে হয়, যদি আর দশ বছর আয়ু পাই, তাহলে হয়তো একটি ভালো বই লিখতে পারব। এটা আমার বিনয় না, নিজের বোধ। যে লেখাটি লেখা দরকার, সবারই আক্ষেপ থাকে, সেই লেখাটি হয় না। তারপরও সবাই নানাভাবে নানা দরজায় ঘা দেয়।
রাজু আলাউদ্দিন: শিল্পী মানেই তো টেনটেলাসের মতো।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: মনে করেন আমি চিৎকার করছি কিছু খাব–মিষ্টি পোলাও; কিংবা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাব, তার আগে ভাবলাম যে একটু করোল্লা ভাজি খেয়ে নিই। দেখি কেমন লাগে। একটু সব্জি খেয়ে নিই। তারপর একটা মাছের ঝোল খাব। আবার দৈনিক ওই মাছের ঝোল খেতেও জিহ্বাতে সরে না। এই কারণে দুর্বল কবিদের যা হয়, তারা সব সময় চেষ্টা করে, সবল হওয়ার জন্য ছিদ্রকে কতটুকু বড় করা যায়। এগুলো হলো বড় করার প্রেক্ষিত। এবং আমার কোনো ধোঁয়াশা নেই। কী লিখেছি, কী করেছি আমি জানি। অনেকেই তো লিখছেন, তাদের কাছ থেকে সরে এসে অনেকেই আমার লেখা পছন্দ করেন বা পড়েন, এটাই-বা কম কী! এই সামান্য অহমটুকুও তো কম কথা নয়।
রাজু আলাউদ্দিন: এই অহম থাকার মধ্যে আমি মনে করি যথেষ্ট যুক্তি আছে। মুখোমুখি নামে আপনার একটি কাব্যগ্রন্থ আছে। এই কাব্যগ্রন্থের প্রকরণ অনেকটা সংলাপধর্মী।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: একটা প্রশ্ন আর একটা উত্তর।
রাজু আলাউদ্দিন: এই ফর্মের ভাবনা আপনার মাথায় কীভাবে এলো?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি স্বীকার করি, পুর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন-এর পরে মনে হলো আমিও নিজেকে একটু যাচাই করি–কাচ ভেঙেছি কাচের টুকরো দিয়ে।
রাজু আলাউদ্দিন: পুর্ণেন্দু পত্রী ব্যবহার করেছেন বলেই যে সেটা আর কোনদিন ব্যবহার করা যাবে না, কেউ করতে পারবে না, এমনও কোনো কথা নেই।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি আপনাকে বিনয়ের সঙ্গে বলি, পুর্ণেন্দু পত্রী যা লিখেছেন, ওটা যদি সুপাঠ্য না হতো, সু-আবৃত্তি না হতো এবং উনি যদি পুর্ণেন্দু পত্রী না হতেন; ওই লেখাটির ভেতর-মহল ফাঁপা।
রাজু আলাউদ্দিন: একদম সত্যি কথা। এবং ওইটা খুবই আবেগনির্ভর লেখা।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আর সেই আবেগটি খুবই কাঁচা আবেগ। সাধারণ আবেগ।
রাজু আলাউদ্দিন: অনেকটা মনে হয় বাংলা সিনেমার মতো কাঁচা আবেগ। আচ্ছা, আপনার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের একটা জিনিস আমি মিস করে গেছি। ‘অলিখিত পদ্ম’ নামে আপনার একটি কবিতা আছে। বইটি বেরিয়েছিল ১৯৮১ সালে। তার মানে বোঝাই যায়, ৭৫ পরবর্তী সামরিক শাসকদের হাতে যে বাংলাদেশ কব্জা হয়ে গেছে, ওখানে আপনি অনেক স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক কবিতা লেখার দিকে গেলেন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: রাজনৈতিক কবিতা বলতে, আমি চাইলাম দৃশ্যপটটা বর্ণনা করতে পারি কি-না দেখি। তাছাড়া আমার নিজের কাছে নিজের দায়বদ্ধতা আছে। আমি তো ভেতরে ভেতরে অনেক আগে থেকেই লিখছি। কিন্তু আরেকটু পরিষ্কার করে অবস্থানটি বর্ণনা করতে পারি কি-না দেখি। এর ভেতরেও অনেক অলিখিত ব্যাপার আছে।
রাজু আলাউদ্দিন: মানে রাজনৈতিক কবিতা হওয়া সত্ত্বেও এটা স্লোগান হয়ে দাঁড়ায়নি। আমরা প্রথম কয়েকটা লাইন পড়ি : ‘দক্ষ সৈনিকের ভাষা তার চকচকে বেয়নেটে। বুলেটের উল্টোপিঠে পোশাকের সুচতুর ভাঁজে তার হাসি তিন ইঞ্চি মর্টারের নিখুঁত নিরিখে অনায়াসে তছনছ করে দেয় শিশুর মুখের গ্রাস, বুকের পাঁজর। সে জানে শক্তির কথা উপযুক্ত ব্যবহারে ফল।’ ঠিক একইভাবে আপনি যখন অনেক দিন পরে আরেকটি বই লিখলেন, বহু বছরের ব্যবধানে, প্রায় বিশ বছর পর, ইতিহাস বদমাশ হলে মানুষ বড় কষ্ট পায়, সেখানেও এরকম রাজনৈতিক কবিতা আছে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমার রাজনৈতিক বিষয়ে অনেক কবিতা আছে। কিন্তু সরাসরি নয়।
রাজু আলাউদ্দিন: সরাসরি না। আর সরাসরি হলেও সেগুলো স্লোগান হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েনি। যেমন: ‘কে রান্না করছে কে রান্না করছে তাই-ই বিষয়। কিছু যে একটা হচ্ছে তার তাপ বোঝা যায়। নাকের ডগায় ঘাম। ঝাপে ঝাপে ঘ্রাণ। কোথাও একটা বড়সড় কিছু হচ্ছে। রান্না চলছে। গণতন্ত্রের তুষ ঠেলে রান্না হচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন মাপের ডেকচি উতলানোর আগেই ফু দিচ্ছে বাবুর্চি। এই, নামাও নামাও; যেন বেশি না ফোটে। থালা পেতে বসে আছে কোটি কোটি হাত। নাকি আরো করিডর দ্বীপবাসী!’ রাজনৈতিক কবিতা লেখার ঝুঁকির কথা আমরা জানি। আবার সাফল্যের কথাও জানি। নেরুদার মতো কবিও রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন কিন্তু কখনো সেটা স্লোগান হয়ে ওঠেনি।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: কিংবা ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের, অথবা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের।
রাজু আলাউদ্দিন: বা আমাদের সুকান্তের কথা বলা যায়।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: অবশ্যই।
“আমি যে আড়াল করেছি বা উপরে একটা আবরণ দেয়ার চেষ্টা করেছি– এটা হয়তো আমাকে বাঁচাবে। আবার এটা ভুল বোঝাবুঝিও তৈরি করতে পারে, পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে যায় অনেক সময়। এরকম একবার ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল আমার ‘হর্ষবর্ধনের হাতি’ কবিতাটি নিয়ে। এটা অহেতুকভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য পক্ষকে বিপক্ষে টেনে নেয়া যায়।”
রাজু আলাউদ্দিন: তাঁর বেশিরভাগ কবিতাই রাজনৈতিক কবিতা। আবার অনেকে রাজনৈতিক কবিতা লিখতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে গেছেন। এবং এই পড়ে যাওয়াদের সংখ্যাই বেশি। এইসব ঝুঁকির কথা আপনি কখনো ভাবেননি?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমার ভাবনাটা আসেনি। কারণ, আমি যে আড়াল করেছি বা উপরে একটা আবরণ দেয়ার চেষ্টা করেছি– এটা হয়তো আমাকে বাঁচাবে। আবার এটা ভুল বোঝাবুঝিও তৈরি করতে পারে, পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে যায় অনেক সময়। এরকম একবার ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল আমার ‘হর্ষবর্ধনের হাতি’ কবিতাটি নিয়ে। এটা অহেতুকভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য পক্ষকে বিপক্ষে টেনে নেয়া যায়। যেমন কিছু মানুষ আছে, যারা কখনো বলে না গ্লাসটা অর্ধেক ভরা। তারা সব সময় বলে গ্লাসটা অর্ধেক খালি।
রাজু আলাউদ্দিন: যারা নেতিবাচক তারা খালি বলবে, আর যারা ইতিবাচক তারা গ্লাসটা ভরা পাবে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: রাজনৈতিক কবিতা ওই রকম দোদুল্যমান অবস্থার ভেতর থাকে; সেটা নির্ভর করে যিনি লিখছেন তার মতাদর্শের উপর…
রাজু আলাউদ্দিন: একটা ঘটনা আপনাকে বলি। মেক্সিকোর প্রথম সারির একজন ঔপন্যাসিক হলেন মারিয়ানো আসুয়েলা। মেক্সিকোতে বিপ্লব হয়েছিল রুশ বিপ্লবেরও আগে। ১৯০৭ সালের দিকে। উনি নিজে ওই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছেন। পেশায় ছিলেন ডাক্তার। তিনি একটি উপন্যাস লিখেছেন ‘দ্য আন্ডার ডগ’। নিচের মহল। সেটা ছিল বিপ্লবকে নিয়ে। যারা বিপ্লবী ছিল, তারা বলছে এটা প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষের উপন্যাস। আবার যারা প্রতিক্রিয়াশীল, তারা বলছে এটা বিপ্লবীদের পক্ষের উপন্যাস। এইভাবে দীর্ঘদিন বিতর্ক চলেছে। পরে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উনি বলতে বাধ্য হয়েছেন যে এটা কী ধরনের উপন্যাস। তো এই রকম কিন্তু ঘটে। আপনি যদি রাজনৈতিক কবিতা লেখেন আর সেটা সরাসরি স্লোগানধর্মী না করে শিল্পসম্মত আবরণ দিয়ে করতে চান; আর শিল্পী তো আসলে সরাসরি কথা বলেন না, উনি সব সময় একটি শৈল্পিক আড়াল ব্যবহার করেন….
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: শিল্পের ধর্মই তো সেটা।
রাজু আলাউদ্দিন: তার মধ্যে সাদা কালো পাশাপাশি প্রবহমান থাকে, ফলে এটাকে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকতেই পারে। কিন্তু আমি মনে করি, শেষ পর্যন্ত বোদ্ধা পাঠক যিনি, তিনি আসল মর্ম বের করে আনেন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: কারণ বোদ্ধা পাঠক যিনি, তিনি যখন এই ধরনের কবিতা পড়েন আর দোলাচলে যান। এই যে কিছুক্ষণ আগে আপনি নেরুদার কথা বললেন, নেরুদার এই দোলাচলে যাওয়ার আগে তার মটিভেশন টুয়ার্ডস পিপল, এটা কিন্তু আমরা জানছি। মটিভেশন টুয়ার্ডস লাভ কিংবা মটিভেশন টুয়ার্ডস ওয়ার্ল্ড–এগুলো আমরা জানছি। এটা জানলেই ভেতরের যে শব্দগুলা আছে, সেগুলো সোনার না তামার ওটাকে সহজেই খুলে ফেলা যায়। এই যে প্রিপারেশন, এটা একজন ঋদ্ধ পাঠকের জন্য বড় ইসের জায়গা যে সে খুলে ফেলতে পারে। নারীকে উলঙ্গ তো অনেকেই করতে পারে। কিন্তু সেই উলঙ্গেরও তো নানা ভাষা থাকে। সেই খোলার ব্যাপারটি পাঠকের হাতে। উদোম সে কীভাবে করবে কবিতাটিকে, সেটা তার উপর নির্ভর করে। সে বিশ্লেষণ করবে এটা শিল্পীত নারী বা এটা নগ্ন নারী। আমার প্রচুর কবিতা আছে রাজনৈতিক। কিন্তু কখনো কোনো পাঠক এইভাবে চিহ্নিত করেনি বা বিশ্লেষণ করেনি। আমার শেষের দিকে প্রতিটা কবিতায় কিছু না কিছু একটা পাথর ছুঁড়ে দেয়া আছে। কারণ, সমাজ বা সময়কে এড়িয়ে আমি কোনোকিছু করিনি।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনার বৈচিত্র্য অনেক। আপনি নানান বিষয়ে কবিতা লিখেছেন। এমনকি ইরোটিক কবিতা, সেগুলো তো শুধুমাত্র ইরোটিকই না; সেগুলো নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা, রাজনৈতিক কবিতা কিংবা ক্লিশে ভাষায় প্রকৃতির কবিতাও যদি বলি; আপনার সূচনাই হয়েছে এসব দিয়ে। ফলে সেই বৈচিত্র্যটা আপনার মাঝে প্রবলভাবে আছে। সিরাজী ভাই, আমি জানি যে আপনার কবিতা নিয়ে আরো বহু কথাই বলতে পারব আমরা। আমি একটা জিনিস জানতে চাচ্ছি, আপনি যখন লিখতে শুরু করলেন, আপনার আগের যারা কবি ছিলেন, পঞ্চাশের দশক, চল্লিশের দশকের কবিদেরকেও আপনি তখন পেয়েছেন..
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আহসান হাবীবকে পেয়েছি, ফররুখ আহমদ, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ কবিকে পেয়েছি।
রাজু আলাউদ্দিন: এঁদের মধ্যে কোন ব্যক্তিত্বকে আপনার আকর্ষণীয় মনে হয়েছে?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: যেভাবে ফররুখ আহমদ এসছিলেন, সে সাত সাগরের মাঝিই হোক, হাতেম তাঈ-ই হোক, নওফেল ও হাতেমই হোক, যেভাবে এসছিলেন, যে ভাষা ও ব্যাপ্তি নিয়ে এসছিলেন তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। ওই যে কিছুক্ষণ আগে আমরা রাজনৈতিক কবিতার কথা আলোচনা করতে এসে ডিকশনটা কীভাবে প্রবাহিত হয়েছে দেখতে চাইলাম; কিন্তু উনি নিজেই ওই ডিকশনটাকে এইভাবে ছেদরেখা দিলেন যে মনে হলো একটা মরুভূমির ভেতরে একটা দাগ দিয়ে দিলেন, নদী প্রবাহিত হয়ে গেল, এপাশে থাকো আর ওপাশে থাকো। যিনি এপাশে ছিলেন, তিনি মরুভূমির একটা সবুজ প্রান্তরে ছিলেন; তারা বলল যে, না, এটা তো সবুজ প্রান্তর। কিন্তু ওপাশে যে খাঁখাঁ মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে সেটার খবর করে নাই। তারা ওটা নিয়ে মাতেনি। আমরা যখন পড়তে শুরু করি ফররুখ আহমদকে, তিনি তখন ভীষণ অগ্রসর। গোলাম কুদ্দুস, ফররুখ আহমদ তখন অসম্ভব অগ্রসর কবি। এবং একজন বাঙালি মুসলমান কবি এতখানি প্রগ্রেসিভ কবিতা লেখে, সেটা আমাদের জন্য একটা আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল। ভাষাও চমৎকার।
রাজু আলাউদ্দিন: মাদকতাময় ভাষা।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: পাশাপাশি আসেন সৈয়দ আলী আহসানের কবিতায়। সৈয়দ আলী আহসানকে বুঝতে হলে আবার সেই পাঠের অংশটুকু স্মরণ করতে হবে। তবে শব্দ টোকা দিলে যে নানারকম আওয়াজ করে, এবং আঙুলের সঙ্গে সঙ্গে শব্দ ছুটতে থাকে এবং তাকে এক আঙুলে ধরলে একরকম, দুই আঙুলে ধরলে আরেকরকম, মুঠোয় ধরলে আবার আরেকরকম– কে কীভাবে ধরবে সেই জিনিসটি সৈয়দ আলী আহসান অন্তত আমাকে শিখিয়েছেন। আবুল হোসেন সম্পর্কে বলা হয় রবীন্দ্র-বলয়ে ছিলেন এবং খুব ভালো কবিতা লিখতেন। আমি কখনো আবুল হোসেনকে নিয়ে নিজে পরিতৃপ্ত হতে পারিনি। বাকি রইলেন আহসান হাবীব। আহসান হাবীব রাত্রি শেষ থেকে শুরু করে যখন পাঠ করতে যাই, হি ইজ এ ভেরি কনফিউজড পোয়েট বাই হিমসেলফ।
রাজু আলাউদ্দিন: প্রথম দিকে?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: প্রথম দিকে। একটি আচ্ছন্নতা তার শুরুর দিকে ছিল কাজী নজরুল ইসলামে। এবং নজরুল আচ্ছন্নতা তার বিকাশের ক্ষেত্রে যেভাবে সহায়তা করছে, সেভাবে তার পতনের ক্ষেত্রেও সহায়তা করছে। কিন্তু মাঝবয়সে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই মানুষটি একটি নতুন রূপ পেয়ে গেল।
রাজু আলাউদ্দিন: দুই হাতে দুই আদিম পাথর।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হ্যাঁ। নতুন রূপটি পাওয়ার একটি কারণ হলো এই, উনি তখন চিহ্নিত করতে পারলেন উনি কী লিখেছিলেন এবং কী লেখা তাঁর উচিত। ওই বয়সে এসে উনি দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক। তরুণদেরকে সবচেয়ে প্রাধান্য দিলেন। এবং তরুণরা কী লিখছে, আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি, নিজেকে সে মতে জারিত করলেন। এবং উনি বাংলা কবিতার প্রনিধানযোগ্য কবি হয়ে গেলেন। পঞ্চাশের দশকে এসে বাহান্নর উপর ভিত্তি করে তেপ্পান্নতে যে একুশে সংকলন বেরোল, এটা দেখে মনে হলো এটা আমাদের একটা দিকনির্দেশনা দেবে। আমরা ‘কুমড়ো ফুল’( আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র কবিতা) দেখে আপ্লুত হচ্ছি। আমরা ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে’( আলাউদ্দিন আল আজাদের কবিতা) দেখে আপ্লুত হচ্ছি। এই হওয়ার পাশাপাশি টেকসই জায়গায় কোথায় এসে দাঁড় করাল! আমরা তখন ষাটের দশক ছোঁব ছোঁব, এরকম একটা অবস্থার ভেতরে আন্তর্জাতিক একটি রূপ বুদ্ধদেব বসু প্রবল প্রতাপে বাংলাসাহিত্যে অনুবাদকর্ম নিয়ে ঢুকে পড়ছেন। হোল্ডারলিন থেকে শুরু করে বোদলেয়ার, রিলকে নিয়ে উনি ঢুকে পড়ছেন। এবং এই ঢুকে পড়ার পেছনে মর্ম এবং ধর্মের পাশাপাশি বিস্বাদ, বিস্ময় এবং অবক্ষয়কে একদম দলেমুচড়ে এক করে ফেলছেন। রিলকে সেখানে একটা মহান জায়গায় আছেন। এর পাশাপাশি হোল্ডারলিন তার জায়গায় আছেন। তখন আমার জন্য বরিস পাস্তেরনাক একটা বড় জায়গা করে ফেলছিল।
রাজু আলাউদ্দিন: মুক্তি?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: মুক্তি।
রাজু আলাউদ্দিন: কোনটা? ডাক্তার জিভাগো?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: ডাক্তার জিভাগো। এই যে দোলাচল, আমি নিজে তৈরি হচ্ছিলাম আমি কোন দিকে যাব। তারপরে তো আপনাকে বললামই আমি অনুবাদে আসলাম। তবে এঁদের পাশাপাশি একজন শঙ্খ ঘোষ, একজন অলোকরঞ্জন, একজন আলোক সরকার–আমার মনোগঠনে সহযোগিতা করছেন। শেষদিকে এসে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কিংবা শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বা তারাপদ রায় পাঠ করছি। পাঠ করার ভেতর দিয়ে মনে হচ্ছে সব পাতাগুলো ঝরে যাচ্ছে। এবং হলুদ হয়ে যাচ্ছে। আবার যখন রাজপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন সুনীল, তখন মনে হচ্ছে এই পথ তো ফুরাবে না। এই পথের পরেই একটা সাগর। এই পথের শেষে একটি সবুজ শস্যক্ষেত্র। সেখানে সোনালি ফসল হবে। সেখানে সূর্যমুখী ফুটবে। এইসব চিত্র মনের ভেতরে ভাসছে।
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু সিরাজী ভাই, আপনি পঞ্চাশের দশকে এসে শুধুমাত্র পশ্চিমের লেখকদের কথা বললেন, পঞ্চাশের দশকের বাংলাদেশের কারো কি অধিকার ছিল না…
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: না না। শুধু পশ্চিমের কথা বলিনি। পঞ্চাশের দশকে আলাউদ্দীন আল আজাদের কথা আমি বলেছি ইঙ্গিতে। হাসান হাফিজুর রহমানের কথা বলেছি। শামসুর রাহমানের কথা আগেই আমি বলেছি। এর পাশাপাশি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ আছেন। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের এই যে তৈরি, এই তৈরির ভেতরে কিন্তু কলসটি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কলসের ভেতর যে মধুটি আছে, সেটা ষাটের দশকে এসে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি আল মাহমুদ। কালের কলস-এ এসে আমি মধু ভাণ্ডার আবিষ্কার করলাম। অনেকে সোনালি কাবিন’র কথা বলেন; কিন্তু কালের কলস আমার কাছে মাইলফলক। তখন কালের কলস, সৈয়দ আলী আহসানের যতটুকু আমার মনে পড়ে সহসা সচকিত, শামসুর রাহমানের বিধ্বস্ত নিলীমা, শহীদ কাদরীর উত্তরাধিকার— এই চারখানা বইয়ের ভেতর আমাদের কাছে রাবার স্ট্যাম্প হয়ে গেল–শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী। এটা পঞ্চাশের শেষ ভাগ থেকে এসে ষাটের ভেতরে ঢুকছে। কিন্তু আমাদের ষাটের যারা অগ্রগণ্য ছিলেন–আবদুল মান্নান সৈয়দ থেকে শুরু করে রফিক আজাদসহ আরো যাঁরা ছিলেন, একটু পরে আসাদ ভাই–এঁরা আসছেন। এই আসার পাশাপাশি উনসত্তরের গণআন্দোলন এবং তৎপরবর্তী রাজনৈতিক উত্তেজনা ছিল। আজকে এত মানুষ শাসক দল কিংবা প্রশাসনে যারা আছে তাদের সমর্থক, সোজা বাংলায় আওয়ামী লীগের সমর্থক, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আমার দেখা ছেষট্টি সালে কারা সত্যিকারে বাংলাদেশে স্বাধীনতা চেয়েছে এবং কারা চায়নি। অনেকে তখন অখণ্ড পাকিস্তানই চেয়েছিল।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি কি শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনের লেখকদের কথাও বলছেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: লেখকদের কথাই বলছি।
রাজু আলাউদ্দিন: তাদের নামগুলো বলেন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: নাম উচ্চারণ করা ঠিক হবে না। তারা পরবর্তী সময়ে ভুল বুঝেছেন, বুঝতে পেরেছেন মাটিটি আমার। এই আগুন শুধু আমারই। এই নুন আমারই।
রাজু আলাউদ্দিন: ভুল যেহেতু স্বীকার করেছে, তাহলে তো নাম বলতে অসুবিধা নাই সিরাজী ভাই।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: না না। অনেক কিছুই অনেকে ভুলভাবে ধরে নেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ আবার আমাদেরকে একটি সম্মেলনের জায়গায় নিয়ে এসেছে।
রাজু আলাউদ্দিন: পরিষ্কার করে দিয়েছে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: পরিষ্কার করে দিয়েছে এবং সম্মেলনের জায়গায়ও নিয়ে এসেছে। সম্মেলনের জায়গাটা কোথায়! এই বাংলাদেশ, যেটা পূর্ববঙ্গ ছিল, এর কবিতা কেমন হবে, এর সাহিত্য কেমন হবে, তার ভাষারূপ কেমন হবে এবং সাহিত্যের চরিত্র কীভাবে গঠিত হবে সেটা তৈরি হয়ে গেল। বায়ান্নতে আমরা রাজপথে রক্ত দেব ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে কবিতা লিখছি। ‘খুন’ শব্দটা বায়ান্নতে আমাদের ভেতর এসেছিল। পূর্ববাংলার বাঙালি কবিতার ভেতর খুন শব্দটি এসেছিল। এটার উৎপত্তি ছিল নজরুল ইসলামে। এবং এটা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে তার একটা বচসাও ছিল। আমরা কিন্তু বায়ান্নর ২১শে ফেব্রুয়ারি খুনকে স্থাপন করেছি, রক্ত যখন মাটিতে পড়ে গেল তখন সেটা খুন হয়ে গেল। আমরা তখন থেকে একটি ভাষা নির্মাণের ব্যাপারে, আমি অন্তত ব্যক্তিগতভাবে, আমার পাঠের পরিক্রমায় এই শব্দটাকে রাখছি।
রাজু আলাউদ্দিন: ‘খুন’ শব্দের ব্যবহার নাকি রবীন্দ্রনাথেও ছিল। আপনি জানেন যে, ওই ঝগড়াটা লাগাইছিল সজনীকান্ত। রবীন্দ্রনাথ নাকি বলছেন যে, আধুনিক হিন্দু বাঙালি কবিদের মধ্যে খুন শব্দের ব্যবহার এরকম..। কিন্তু রিপোর্টটা যখন বের হইছে পত্রিকায়, তখন হিন্দু বাঙালি কবির জায়গায় ছিল শুধুমাত্র বাঙালি কবি। তারই কিছুদিন আগে নজরুলের খুন শব্দ ব্যবহার করা কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। নজরুল ইসলাম এটা পড়ার পর ধরেই নিয়েছেন যে, গুরুদেব তাঁকেই উদ্দেশ্য করে এটা বলেছেন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: যাইহোক, ভাষা বদলের ক্ষেত্রে আমি যাদেরকে ছুঁয়ে যাচ্ছি বা যাঁদের পদস্পর্শ পাচ্ছি বা যার নাকের নিঃশ্বাস পাচ্ছি তার ভেতর বাঙালি গুরুত্বপূর্ণ কবিরা হলেন– পশ্চিমবঙ্গের শক্তির কথা বললাম, সুনীলের কথা বললাম। শঙ্খবাবু অন্যভাবে এসছেন। শঙ্খবাবু খুব মৃদু পায়ে এসছেন। তিনি এত মৃদু পায়ে এসছেন, যেন, পনিরের টুকরোটি কাটতে গেলে যে ছুরিও টের পাবে না যে তাকে কাটা হচ্ছে; তেমন। কিন্তু আমরা তো পনির কাটা লোক না, আমরা ডাব কাটা লোক। ফলে ছুরি এবং যাকে কাটবে তার ব্যবহার থেকে আমাদের আসতে আসতে এই সময়টুকুর ভেতর আমরা পঞ্চাশ বছর পার করলাম। আমি নিজে বিশ্বাস করি পঞ্চাশ বছর পার করার পরেও শুদ্ধির সেই ক্ষেত্রটিতে আমরা যে অবস্থানে এখন আছি, আমাদের নতুনভাবে ওই ডাব আর দা বলি, পনির আর ছুরি বলি, নতুন উপাত্তে আমরা যাচ্ছি কবিতায়। এবং শক্তিমান কেউ একজন আসবেন সত্যিকারার্থে মেধা নিয়ে।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি কি ভাবছেন না যে আপনাদের ষাটের দশকে..
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: না না। আমাদের এগুলো সবই প্রতিরূপ অথবা প্রতিশব্দ। বাংলা ভাষা যেখানে যাবে, সেই অর্থে; যেহেতু বত্রিশ কোটি বাংলাভাষী মানুষ হয়ে গেছে সারা পৃথিবীতে, বাংলা কবিতা যেখানে যাবে। এবং বাংলা কবিতা কোনদিনই বিচ্ছিন্ন হবে না সাহিত্য থেকে। মানুষের জীবন থেকেও কোনদিন বিচ্ছিন্ন হবে না। কম্পিউটারের সবচেয়ে বড় সফটওয়্যারটি করতে গেলেও কবিতা লাগবে। অতএব বিচ্ছিন্ন হবে না। সেইখানে যাওয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন। এটা আমার অনেক বড় স্বপ্ন। অনেক বড় আকাঙ্ক্ষা। পঞ্চাশ বছরের ভেতর সেটি হবে, এই বাংলাদেশেই। কারণ, মূলটি আমার কাছে আছে। ভুলটি এখন ওর কাছে। মূলটি এখন আমার কাছে। কারণ, হওয়ার জন্য যে পরিমাণ তাপ লাগে, পলিতে যে পরিমাণ সার লাগে তা আমরা পেযেছি। বৃষ্টি যখন আসমানে ছিল, আসমানে থাকা পর্যন্ত বৃষ্টিই ছিল; যেই ভূমি স্পর্শ করে ফেলল, আপনি জল ডাকতে শুরু করলেন, আমি পানি ডাকতে শুরু করলাম। কিন্তু আমার পানি কিন্তু আজ প্রধান। আমার ভাষা লবণের ভাষা। আমার নুনের ভাষা না। আমার পলির ভাষা ভিন্ন। আমি বঙ্গোপসাগরকে চিহ্নিত করতে পারি–এই সাগরের নাম বঙ্গোপসাগর। অতএব ভাষারূপে রাষ্ট্র-চিন্তায় আমি যে অবস্থানে আছি আমার ভেতর দিয়ে বাংলাভাষায় নতুন সাহিত্য হবে।
রাজু আলাউদ্দিন: তাহলে তো পশ্চিমবঙ্গ গৌণ হয়ে যাচ্ছে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: বিষয়টা এভাবেও দেখা যায়–আইরিশ লিটারেচারের পাশাপাশি যখন ইংরেজি রিটারেচার উঠে আসছিল, আপনি দেখবেন মেজর কবিদের অনেকেই আইরিশ। ইংরেজি কবিতার পাশাপাশি যখন আবার আমেরিকান কবিতা জায়গা করে নিতে শুরু করল, পাশাপাশি আবার যখন অস্ট্রেলিয়ান কবিতা চলে আসল, আপনি এই বৃত্তটা ভালো করে দেখেন…
রাজু আলাউদ্দিন: এক লেখক, মেক্সিকান লেখক কার্লোস ফুয়েন্তেস বলছিলেন যে, ইংরেজি কবিতা যখন ঝিমায়ে পড়ে, তখন কোনো এক আইরিশ এসে আবার ওটাকে জাগিয়ে তোলে। আসলেই তাই আর কী! তবে পশ্চিমবঙ্গ তো মনে হয় একরমক ভাষাহীনই হয়ে যাচ্ছে হিন্দির দাপটে, ইংরেজির দাপটে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: ভাষাহীন থাকলেও, যত ভাষাহীনই হোক, এই ভাষাহীনতা আমরা অনুভব করছি শহুরে পটভূমিতে। কিন্তু গ্রামগঞ্জে কিংবা অজপাড়াগাঁয়ে গেলে, যারা সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত, তাদের কিন্তু নিজস্ব একটা ভাষা থেকে যাবে।
রাজু আলাউদ্দিন: সেখানে হিন্দির দাপট নেই।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হিন্দির দাপট যেটুকু আসবে, সেটা বাণিজ্যিকভাবে আসবে। কিন্তু মৌল চরিত্রের আরো পঞ্চাশ বছর ওটা থাকবে। কিছু ছেলেপেলে ওখান থেকে শহরে আসার জন্য হিন্দি পড়বে চাকরির জন্য, কিন্তু ভূমিরূপে ওই জায়গাগুলো এত পেছনে আছে, মুর্শিদাবাদের কিছু অংশ, জঙ্গলবাড়ির কিছু অংশ, জলপাইগুড়ির কিছু অংশ, ওদের ওখানে সূর্য পৌঁছতে পৌঁছতে নিজেরাই আবার নতুন করে জাগবে।
রাজু আলাউদ্দিন: আমরা পশ্চিমবঙ্গ বাদ দিলাম। আমরা অন্য জায়গায় আসি। সেটা হলো যে, আপনার সমসাময়িক কবি সিকদার আমিনুল হক…
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: না, আমার অগ্রজ। বেশ অগ্রজ।
রাজু আলাউদ্দিন: তাহলে তিনি আর্লি সিক্সটিজ, আপনি লেট সিক্সটিজ। তো সিকদার ভাইয়ের কবিতা তো প্রথম থেকেই একেবারেই অন্যরকম। তিন পাপড়ির ফুল, দূরের জানালা।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: দূরের কার্নিশ। প্রথম থেকেই তিনি অন্যরকম ছিলেন বলব না। এক সময় পশ্চিমবাংলার কবিতার দিকে তার একটু ঝোঁক ছিল। যদি আমি ভুল না করি, বিষ্ণু দে-নিষ্ঠ ছিলেন। এইসব আছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি নিজের কবিতা লিখেছেন।
রাজু আলাউদ্দিন: সেটা তো বেশ পরে। তাঁর প্রথম দিককার দু তিনটা বই বেরিয়ে যাওয়ার পরে। তাঁকে এখন যে কারণে আমরা পড়তে বাধ্য হই, ভালো লাগে, সেটা তাঁর প্রথম দিকের বইয়ে ছিল না, তাই না?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: প্রথম বইয়ে তখন আমরা সেটা অনুভব করিনি। একটা জিনিস আমি ভালো জানি, পুব এবং পশ্চিমের মেলবন্ধনে কবিতা লিখতে অনেকেই চেষ্টা করেছেন, পরাবাস্তববাদী কবিতা দিয়ে, অনুবাদ করে আবদুল মান্নান সৈয়দ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পুরোপুরি সফল হতে পারেননি।
রাজু আলাউদ্দিন: অনুবাদ কেন বলছেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: মাতাল মানচিত্র অনুবাদ। আমি বলছি পরাবাস্তববাদী কবিতা দিয়ে, অনুবাদ দিয়ে। মান্নান সেখানে পুরোপুরি আসতে পারেননি। কিন্তু মিশেলের কাজটি অর্থাৎ এই খাবারের সঙ্গে এই সসটি ভালো যাবে বা এই খাবারের সঙ্গে এই ঝোলটি ভালো যাবে–এই যে মিশেলের কাজটি, পুব এবং পশ্চিমের মিশেল, এই যে হাতের পাঁচটি আঙুল দেখছেন, এই হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো ফর্ক, এরচেয়ে ভালো ফর্ক নাই। কিন্তু দুই কাঠি দিয়ে সারা পৃথিবী খেয়ে যাচ্ছে। পুব এবং পশ্চিমের খাদ্যাভ্যাসের যে পার্থক্য এবং মেলবন্ধন–এই কাজটি সিকদার ভাই বাংলা কবিতায় ভালো করেছেন। তিনি জানতেন, আমি যে চিজটি নিয়ে এসছি, এটা আমাকে দশদিন ডিপ ফ্রিজে রেখে দিতে হবে। তারপর সেখান থেকে বের করে আমি কাটব। কাটার পর যা দিয়ে এটি খাব, সেটা দিয়ে মাইক্রো ওভেনে রাখব। চমৎকার একটা তাপমাত্রায় গরম হবে এবং সেটা টেবিলে পরিবেশন করব। তিনি শ্রেষ্ঠ রাধুঁনি।
রাজু আলাউদ্দিন: এই রেসিপিটা উনি জানতেন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি কী বলতে চাচ্ছি, আপনি ধরতে পেরেছেন।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনার জেনারেশনে কার কবিতা আপনার সব থেকে ভালো লাগে?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: নিজের জেনারেশন নিয়ে বলা মুশকিল। সবাই ভালো লেখেন। নির্মল ভালো লেখেন। মহাদেব ভালো লেখেন। মুহাম্মদ নূরুল হুদা ভালো লেখেন। ভালো না লিখলে এত পাঠক কেন পড়ে! আমিও পড়ি। আমি প্রতিটি কবিতা পড়ি।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি তো পড়েন বন্ধু বলে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি প্রতিটি কবিতা পড়ি। ভাবি, এই লেখায় মনে হয় সবকিছু আছে। ওটায় না পেলে পরেরটা পড়ি। ভাবি, এটার ভেতরে আছে। সবকিছু পড়ি। নির্মল আমার প্রিয় কবি, ভালো কবি। তাঁর সব লেখা পড়ি। রফিক ভাই ছিলেন, মান্নান ভাই ছিলেন, আসাদ ভাইয়ের কবিতা পড়ি। আমাদের সময়ে সানাউল হক ভালো কবিতা লেখেন, জাহিদুল হক লেখেন, মুহাম্মদ নূরুল হুদা লেখেন, আলতাফ হোসেন লেখেন– সবাই ভালো কবিতা লেখেন। তবে ভালোমন্দের ব্যাপারটি যার যার মতো দাঁড় করানো। এখানে বোধের প্রশ্নে আমি একটু বিচ্ছিন্ন লোক। বিচ্ছিন্ন কেন? আমি হয়তো কারো পছন্দের। হয়তো আপনার পছন্দের আবার আরেকজনের পছন্দের না। সরাসরি বললে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বললে অন্য অর্থে দাঁড়াবে। সে জন্য সেটা বলা সঙ্গত নয়। তবে আমাদের অনেকে কিন্তু এখন ঝরে পড়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে–প্রকৃত উচ্চারণটি করা দরকার। আমরা সবসময় পাছে লোকে কিছু বলে জন্যে করতে পারছি না। এই যে আমি কোট করতে পারছি না–আমার এই সাহসটি কেন তৈরি হবে না!
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি কি এটা তরুণদের কাছ থেকে আশা করছেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি আশা করি তরুণদের কাছে। আশা করি তরুণরা আমাদের ছিন্নভিন্ন করে ফেলুক।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনার কি মনে হয় তরুণদের ভেতর এমন সাহসী কেউ আছে?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: সাহসী আছে। আমি ব্রাত্যর (ব্রাত্য রাইসু) কথা বলি, সাহসের জায়গাটুকু আছে কিন্তু ভুলভাবে ব্যবহার হচ্ছে।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি লেখক হিসেবে তরুণদের কীভাবে দেখেন? সেটা কবিতার ক্ষেত্রে হোক কিংবা প্রবন্ধের ক্ষেত্রে হোক।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: কবিতার ক্ষেত্রে অসম্ভব অসম্ভব সম্ভাবনা। কিন্তু টোটাল পোয়েট্রি বলে একটা কথা আছে। এই টোটাল পোয়েট্রিটা কোথায় যেন মিস করি। মিস করি বলেই হাহাকার লাগে–এত চমৎকার একটি আয়োজন, মূর্তিটি গড়লাম, কী চমৎকার নাক, কী চমৎকার হাত, কী চমৎকার বক্ষ, কী চমৎকার ঠোঁট; কিন্তু চক্ষু দান করলাম না। এই আক্ষেপটা আমার খুব বড়। আর আমি এমন কোনো ভাষ্যকার না, এমন কোনো বিচারক না–আমি আমার পছন্দ অপছন্দের জায়গাগুলো বললাম। তবে আমি নিজে বিশ্বাস করি, আমার সময়ে যারা জীবিত আছেন, আমি যত স্বনিষ্ঠ পাঠক, এটা আমি বলতে পারি, আমার বয়সী তরুণদের এত স্বনিষ্ঠ পাঠক নেই।
রাজু আলাউদ্দিন: আমি তাহলে একটা জিনিস জানতে চাইব সিরাজী ভাই, সেটা হলো, কবিতা লেখার পাশাপাশি আপনাকে প্রবন্ধ পড়তে হয়েছে। সেই সময়ের অনেক বড় বড় প্রাবন্ধিক, যেমন শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু–আপনি কি মনে করেন, আমাদের এখানে ঠিক ওই রকম উচ্চতার প্রাবন্ধিক আছেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: যে গদ্য ভাষাটি প্রায় তিনশ বছরের পূর্ণতার ফলে, পরিচ্ছন্নতার ফলে এবং পরিশীলিত অনুশীলনের ফলে তৈরি হয়েছে, সেটাকে আমরা আমাদের মতো করে পঞ্চাশ বছরে তা আশা করতে পারি না। আমাদের হাসান আজিজুল হক ভালো গদ্য লেখেন। সনৎকুমার সাহার প্রবন্ধের এক সময় নিষ্ঠ পাঠক ছিলাম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গদ্য ভালো। মাহমুদুল হকের গদ্য ভালো। কিন্তু কথা হলো এই ভালো অংশ কতটুকুন? এই তুলনামূলকের বিচারে আমাদেরকে আরো পঞ্চাশ বছর অপেক্ষা করতে হবে। আরো পঞ্চাশ বছর অপেক্ষা করতে হবে কী জন্য? আমাদের গদ্যটা যদি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুক্ত করতে চান তাহলে সময় লাগবে। গদ্য সাহিত্যে কিংবা গল্প উপন্যাসে ফটফট করে নাম করে ফেলি তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক–এইভাবে নাম করে ফেলতে পারব, যেমন আমরা এক সময় খুব উত্তেজিত হয়ে নাম বলে ফেলতাম হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, মাহমুদুল হক, শওকত ওসমান, এভাবে বলতাম। কিন্তু এখন আমরা বুঝতে শিখেছি, এই প্রান্ত শেষ প্রান্ত নয়। এই প্রান্তটুকু ওইটারই বর্ধিত অংশ। আগে যে নামগুলা বললাম–তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতি–তারই এক্সটেনশান। নতুন কই? নতুন কই যেটা যোগ করবে সাহিত্যকে? সেটা কই? রবীন্দ্রনাথ পড়ে আমি সাহিত্যের সবই পেয়ে গেলাম। তারপরও এখন কেন আমি দেবেশ রায়ও পড়ি? শওকত আলী, শওকত ওসমান পড়লেই তো হয়ে যেত। কিংবা আজকে কেন আমরা নতুনভাবে আমরা শহীদুল জহিরকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করি! এই যে চিন্তাভাবনার অংশটুকু–একজন শহীদুল জহির থেকে আরো দশজন বেরিয়ে আসুক, যে বেরোনোর ভেতর দিয়ে আমাদের গদ্যসাহিত্য আলাদা একটা মানচিত্র তৈরি করবে।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনার গদ্য পণ্ডিতি গদ্য নয়। পণ্ডিতি গদ্য বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে, প্রচুর রেফারেন্স থাকে, দেখলে মনে হয় খুবই পালিশ করা গদ্য–এরমক গদ্য আপনি লেখেন না। আপনার গদ্যের ভঙ্গিটা প্রাকৃত। বলার ভঙ্গিটা প্রাকৃত। কিন্তু বাক্যের মধ্যে অন্বয় যুক্ত করা আছে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: তা আছে।
রাজু আলাউদ্দিন: মানে ইঙ্গিতময়। এই গদ্য নিয়ে আপনার বেশ একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: পরীক্ষা-নিরীক্ষা না আসলে। আমি আপনাকে আগে বলেছি, কবিতা লিখতে লিখতে আমি গদ্য লিখতে গেলাম– দেখি তো পারি কি না। একটা বই বেরোল ১৯৯৩ তে, কৃষ্ণপক্ষ অগ্নিকাণ্ড। কিন্তু এই বইটিতে কোনো লেখাই হয়নি মনে হয়েছিল। এখন আবার নতুন করে দেখি যে ওই বইয়ে কিছু মশলা আছে। আমার দ্বিতীয় গদ্যের বই, তথাকথিত উপন্যাস বলি আর অন্যকিছু বলি, পরাজয় নামে গদ্যের বই আছে। সেটিতেও আমি তৃপ্ত না। আমার একটি গল্পের বই আছে। আমি যখন অনুবাদ করতাম, তখন বেশ কিছু গল্প লিখেছি। শুধু গদ্যভাষা রপ্ত করার জন্য। তারপর গদ্য লিখতে আসলাম। দুই হাতে গল্প লিখেছি। তবে কোনো বই ছিল না আমার। কিন্তু দুই বছর আগে একটি বই করেছি, আয়রে আমার গোলাপজান। এর ভেতরে আমি চেষ্টা করেছি, গল্পের ভেতর অন্য জিনিস দেব। দুটো ছেলেমেয়ে হয়তো প্রেমের কথা বলছে, সামনে দিয়ে একটি পিঁপড়ে যাচ্ছে, পিঁপড়ে দেখে সে একটি ভূগোল চিত্র তৈরি করল–এই পিঁপড়াটি যদি হেঁটে যেত, পৃথিবীর এখান দিয়ে হাঁটত, হাঁটতে হাঁটতে আফ্রিকায় গেল, আফ্রিকায় গিয়ে পিঁপড়া এই খাদ্য খেতে পছন্দ করে–দুই ফোঁটা মধু দেন, তার সঙ্গে তিন ফোঁটা জল দেন, তা একটু গরম করেন, সকালে খেলে আপনার কাশি চলে যাবে। এই ধরনের নন্দনতত্ত্বের গল্প। এরপর আমি আবার পিঁপড়ায় ফিরে গেলাম।
রাজু আলাউদ্দিন: নানা এক্সপেরিমেন্ট আছে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: এই ধরনের পাঞ্চ করতে শুরু করলাম। শেষে একটা গল্প আছে। খুব সম্ভব গল্পটার নাম উত্তর ফাল্গুনী। এখানে ফেসবুকে বিভিন্নজনের প্রোফাইলে গিয়ে ভালোবাসার কথা লেখে। তারিখ দিয়ে দিয়ে, নাম পরিবর্তন করে। এই অংশটুকু পাঞ্চ করতে শুরু করলাম। এটা দেখা যে, গল্পের ভেতর নানা উপাদান ঢোকাতে পারি কি না। হয় কি, আমি আগেই বলেছি, দুর্বল লোক নানা দরজায় ঘা দেয়– যদি একটা দরজা খোলে!
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু আমি তো শুনেছি এটা সবল লেখকেরও চরিত্র।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: সবল লেখক ঘা দেন কেন? একজন রবীন্দ্রনাথ সব দরজায় ঘা দেন কেন? তিনি জানেন এখানে আমি ঢুকতে পারব। দুর্বল সব দরজায়ই বন্ধ দেখতে পায়। যদি কোনোটা খোলে!
রাজু আলাউদ্দিন: বিষয়টা হলো ওটা সবল লেখকেরই চরিত্র। দুর্বল লেখকরা ভয়ে কোথাও যায় না। ভাবে যে আমি যদি আবার প্রভাবিত হয়ে যাই। এই ভয়ে সে বহুজনের কাছে যায় না। মাকড়সার মতো সে নিজের লালা দিয়ে নিজের জাল তৈরি করবে। আর বড় লেখকরা নাকি মৌমাছির মতো। নানান ফুল থেকে মুধ আহরণ করে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: যা কিছুই আপনি বলেন, রাজু আলাউদ্দিন, আপনি বাংলা সাহিত্যের অবস্থান জানেন, বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে ভালো দিক, আমি মনে করি, অনুবাদ। এই যে আপনি স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ করেন, এটি আমাদের জন্য বড় সম্পদ। আমাদের তরুণদের উচিত গোগ্রাসে পড়া। আর সায়েন্স ফিকশনের নামে, কল্পকাহিনির নামে কিছু অনুবাদ কেউ কেউ করছেন, এদের থামানো দরকার। এতে দুটো জিনিস হচ্ছে। এক ধরনের তরুণদের মহাকাশ মহাশূন্যের দিকে আকর্ষণ করছে, ভালো কথা; কিন্তু ভুল ভাষায়। ভুল তথ্যে। তবে সাহিত্যের যে অংশটুকু অনুবাদ হচ্ছে, আপনি সামনে আছেন বলে না, আমি আরো কয়েকজনের নাম বলতে পারি, তারা চমৎকার অনুবাদ করেন। পাশাপাশি আমাদের ক্লাসিক অনুবাদ করার সময় হয়ে গেছে। আজ আটশ বছর পরে এসে রুমীর কবিতা অনেকে অনুবাদ করছেন। রুমী এখনো আমেরিকায় বেস্টসেলার। আমি নিজে প্রভাবিত হয়ে ২০১০ সালে রুমী অনুবাদ করেছি। আমি মনে করি এটা দুর্বল অনুবাদ। আবার অনেকে বলে ভালো অনুবাদ হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, আমার আরো ভেতরে যাওয়ার দরকার ছিল।
রাজু আলাউদ্দিন: রুমীর কবিতা আপনিই বোধহয় সবার আগে অনুবাদ করলেন। মানে এর আগে কি বই আকারে ছিল?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: বই আকারে হয়তো ছিল। না থেকে পারে না। আমি শুধু করছি কি, কিছু মিসটিক কবিতা অনুবাদ করেছি। একটা এন্থোলজি করছিল, ওটা আমি তেহরান এয়ারপোর্টে পেয়েছিলাম। ১১৬ কি ১২০টা কবিতা। আমি প্রথম রসুল হামজাতবের কবিতা অনুবাদ করছি। করছি বললাম এ কারণে এটা ১৯৭৩ সালে শুরু করেছিলাম। বই হয়নি। বই হয়েছে গতবার। গতবার মনে করলাম মরে যাই কবে, আমি আর ফেলে রাখব না। আফ্রিকার কবিতা আমি শুরু করছি ১৯৭৫ সালে, নাইনটিন সিক্সটি ওয়ান যে আফ্রিকান পোয়েট্রি বাই পেনগুইন, এটার এডিশন হতে হতে নাইনটিন সিক্সটি ওয়ানের এডিশনটা আমি কিনছি ১৯৭৩ সালে। অনুবাদ শুরু করছি পঁচাত্তরে। এবং অবিরাম ছাপছি। ছাপার পরে দেখছি যে সবাই আফ্রিকার কবিতার দিকে ঝুঁকেছেন। এরপর করুণাময় গোস্বামীসহ নানাজনে আফ্রিকার কবিতা বের করছে। সেদিন দেখি যে সৈয়দ ভাইও আফ্রিকার কবিতা অনুবাদ করছিলেন।
রাজু আলাউদ্দিন: সৈয়দ হক?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হ্যাঁ। আমি আফ্রিকার কবিতার সেই বই-ও বের করিনি। কিন্তু কবিতাগুলো আছে। দেখি, যদি আর দশ বছর বাঁচি, দেখব। সোলঝেনেৎসিন, আলেকজান্ডার সোলঝেনেৎসিন আমি প্রথম অনুবাদ করি এদেশে। ওই যে বললাম আমার প্রাকটিসিং পোয়েট হচ্ছে কবিতা। এবং ছাপাই স্বাধীনতার পরে। বহু কবিতা। এক নাগাড়ে আট নয় দশ এগারো বারো কবিতা… অনুবাদ ছাপানোর ভেতরেই দেখি সাইয়িদ আতীকুল্লাহ সোলঝেনেৎসিন-এর কবিতার বই করে ফেলেছে। ওটা দেখে নিজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। আমি ধরে নিছি যে সবকিছুই আমার ছিল। আমার মকশো করার বা প্রাকটিস করার সময়ের। অতএব আমার কোনো আক্ষেপ নেই।
রাজু আলাউদ্দিন: কোনো খেদ নেই। হাহা।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: কোনো খেদ নেই। রফিক ভাই। আমার কোনোকিছুতে রিপেনটেন্স নাই। আমি দেখেছি আমার লাইনের পর লাইন খাওয়া আছে। প্যারাগ্রাফ খাওয়া আছে। কিচ্ছু বলি না। করুক। ভাল্লাগছে বলেই তো করছে।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি শেষ পর্যন্ত স্থিত হলেন কিন্তু সেই মরমী লেখকদের মধ্যেই। যেমন আপনি ফরীদউদ্দীন আত্তারের কথা বললেন। রুমীর তো আপনি অনুবাদই করলেন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: মরমী মানে আসলে একটা মরমী ভাব…
রাজু আলাউদ্দিন: মানুষ তো স্পিরিচুয়াল বিয়িং, তাই তো?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: অবশ্যই। একটা জায়গায় এসে মানুষের অসহায়ত্ব প্রকাশ পায়। আর ওই অসহায়ত্বটুকুই হলো মরমী ভাব।
রাজু আলাউদ্দিন: মানে সেই অর্থে আপনি এথিস্ট না।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: না।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি বিশ্বাসী লোক। বিলিভার।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি কীসে বিশ্বাসী? এই জীবনে বিশ্বাসী। এই জীবনের অংশটুকুতে বিশ্বাসী। ওই জীবন সম্পর্কে আমার কোনো চিন্তা নাই।
রাজু আলাউদ্দিন: আস্থা নাই নাকি চিন্তা নাই?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: চিন্তাই নাই। আস্থার কথা তো আরো পরে আসবে।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি খুব ট্রিকি উত্তর দিচ্ছেন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: না, এটা কোনো ট্রিকি উত্তর না। আমার কোনো চিন্তাই নাই।
রাজু আলাউদ্দিন: যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আস্থা আছে কি না?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: যখন চিন্তা নাই, তখন আস্থা নাই বলেই চিন্তা নাই। আস্থা থাকলে তো চিন্তা থাকতোই। এই যে কিছু জিনিস থাকে না ভেতরে, যেটা অবিরাম হয়! যেমন বলি– আল্লাহ, ভালো রেখো। এই বলাটা সহজাত একটা ব্যাপার হয়ে আছে।
রাজু আলাউদ্দিন: এটাকে আমি বলি কালচারাল এক্সপ্রেশন। একটা মানুষ নাস্তিক হওয়ার পরেও সে বলতে পারে.. আসসালামু আলাইকুম। এরমানে হচ্ছে…
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। কোনো দোষের কিছু নাই।
রাজু আলাউদ্দিন: তারপরেও একজন বলতে পারে– হায় আল্লাহ, আমার এটা কী হলো! সে নাস্তিক হয়েও এটা বলতে পারে। কারণ সে যে কালচারের মধ্যে বড় হইছে, এটা তার ওই কালচারাল এক্সপ্রেশন। এটা তার রিলিজিয়াস এক্সপ্রেশন না।
“যার কথা বলছেন, তিনি জীবনানন্দ দাশ। প্রতিটি শব্দের ভেতরে তাঁর আরেকটি শব্দ লুকায়িত আছে। প্রতিটি শব্দই হ্যাঁ, প্রতিটি শব্দই না। এই যে দোলাচল–আমি কিছুক্ষণ আগে আপনাকে বলছিলাম, সু আর কু-এর ভেতর আমার চেষ্টা থাকে সু-কে ওঠানো। জীবনানন্দ এত মাত্রায় আধুনিক, যদিও আধুনিক কিছু আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না,তিনি সময়ের কত আগে এবং বাংলা কবিতার কত আগে, আরো একশ বছর পরও জীবনানন্দ পুরনো হবে না। একশ বছর পর এরচেয়ে বেশি তাজা হবে। জীবনানন্দের বৈজ্ঞানিক অংশটুকু তো এখনো উন্মোচিতই হয়নি।”
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আপনি ঠিক বলেছেন। একশ ভাগ সত্য। এটা হীন অর্থে বা ছোট অর্থে আমরা বলি সে ধর্মপ্রাণ। যদি আমি আভিধানিক অর্থেও বলি, হায় আল্লাহ বলা মানে কি? একজনকে উচ্চারণ করে স্মরণ করা। তিনি ইলাহও হতে পারেন, আল্লাহও হতে পারেন, ইশ্বরও হতে পারেন, ভগবানও হতে পারেন। ছোট একটা বিশ্বাস আশপাশ দিয়ে ঘোরে। জায়গা দিলে অন্তরে ঢোকে। না দিলে ঢোকে না।
রাজু আলাউদ্দিন: জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়তে গিয়ে আপনি নিশ্চয় মনে মনে তুলনা করছেন বা ভাবছেন–জীবনানন্দ কিন্তু এদের মধ্যে সবচেয়ে নিরিশ্বর চেতনার মানুষ। যার কবিতায় পাপ বা পূণ্য এই ধরনের শব্দ প্রায় নেই বললেই চলে। পাপ পূণ্য তার কনসার্নই না। ইশ্বর আছেন বা নেই এগুলো কিন্তু তার কবিতার ভেতর নেই। এটা একটা ইউনিক ব্যাপার, পুরো মহাদেশ যেখানে ধর্মাশ্রয়ী, কিন্তু উনি নিজের কবিতাকে কখনো ধর্মাশ্রয়ী করলেন না। কোনো অনুষঙ্গেই না।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: যার কথা বলছেন, তিনি জীবনানন্দ দাশ। প্রতিটি শব্দের ভেতরে তাঁর আরেকটি শব্দ লুকায়িত আছে। প্রতিটি শব্দই হ্যাঁ, প্রতিটি শব্দই না। এই যে দোলাচল–আমি কিছুক্ষণ আগে আপনাকে বলছিলাম, সু আর কু-এর ভেতর আমার চেষ্টা থাকে সু-কে ওঠানো। জীবনানন্দ এত মাত্রায় আধুনিক, যদিও আধুনিক কিছু আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না,তিনি সময়ের কত আগে এবং বাংলা কবিতার কত আগে, আরো একশ বছর পরও জীবনানন্দ পুরনো হবে না। একশ বছর পর এরচেয়ে বেশি তাজা হবে। জীবনানন্দের বৈজ্ঞানিক অংশটুকু তো এখনো উন্মোচিতই হয়নি।
রাজু আলাউদ্দিন: আমি এই জিনিস বলতে চাচ্ছিলাম। এটা একটা ভালো প্রসঙ্গ। তার একটা কবিতায় আছে: ইলেক্ট্রনেরা নিজ দোষ গুণে বলয়িত হয়ে রবে। আমি তো আশ্চর্য হয়ে যাই, উনার যে পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, উনি কখন বিটোফেন শুনছেন! রবীন্দ্রনাথের সাথে চিঠিতে একটা তর্ক আছে না এটা নিয়ে! বিটোফেন ওমুক সিম্ফনি তো অশান্তির আগুন। এটা না শুনে উনি বুঝলেন কী করে! বিজ্ঞানের কথা বললেন। ইলেক্ট্রনেরা নিজ দোষ গুণে বলয়িত হয়ে রবে–এটা তো স্ট্রাকচার অব এ্যাটম। এটা নিশ্চয় পাঠ করে জানা সম্ভব। উনি হয়তো পাঠ করে জেনেছেন। কিন্তু কখন পড়লেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: পাঠ করার বাইরেও কিন্তু প্রকৃতি একটা জ্ঞান দেয়। জীবনানন্দের জোছনা কি চাঁদের জোছনা, নাকি নক্ষত্রের জোছনা? আমি একটা লেখা লিখছিলাম। অনেকে বলছিল, জোছনা মানেই তো চাঁদের জোছনা। আবার তুমি নক্ষত্র লেখ কেন! আমি বলি, জীবনানন্দের জোছনা কিন্তু চাঁদের জোছনা না। জীবনানন্দের জোছনা নক্ষত্রের জোছনা।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি প্রবন্ধ লিখছিলেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হ্যাঁ।
রাজু আলাউদ্দিন: কোথায় আছে এটা?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আছে কোথাও। মনে নেই। উনার জোছনা নক্ষত্রের জোছনা। কোথাও উনি বলেননি…
রাজু আলাউদ্দিন: এটাও একটা অদ্ভুত ঘটনা। উনি বলেছেন, যে নক্ষত্র মরে গেছে, তারও আলো এসে পড়ে..দ্যাট ইজ ট্রু।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: তাহলে বলেন তাঁর কবিতার বিজ্ঞান-অংশ উন্মেচিত হতে আরো একশ বছর লাগবে।
রাজু আলাউদ্দিন: ওটা আলোচিত হয় না।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হওয়া শুরু হবে। এবং ওখানে গিয়ে দেখবেন যে বাংলা কবিতা কোন জায়গায় যাচ্ছে।। খালি তো ফরম্যাটিক দিক, দার্শনিক দিক নিয়ে বলছি। তৃতীয় শ্রেণির কবিতা নিয়ে আমরা লাফালাফি করি। দেখবেন যে বনলতা সেনকে অতিক্রম করে মহানক্ষত্র অন্য জায়গায় চলে গেছে। অতএব বিজ্ঞান সাহিত্য যা কিছুই আমরা বলি, শেষ কথা হল মানুষের অন্বেষণ।
রাজু আলাউদ্দিন: আমি একটা কথা জানতাম ব্যক্তিগতভাবে, আপনি গানের কেবল সাংঘাতিক রকমের অনুরাগীই না, রীতিমতো গানের জন্য আপনার হৃদয় মথিত হয়। আপনার মুখেই প্রথম শুনেছিলাম আবদুল করীম খাঁর কথা। গানের প্রভাব আপনার কবিতার মধ্যে আছে। প্রভাব মানে পরোক্ষ প্রভাব। গানের এই বিষয়টাকে আপনি কীভাবে কবিতায় মেলালেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: কিছুক্ষণ আগে বিটোফেন নিয়ে কথা বলছিলাম। বিটোফেনের সিম্ফনি নিয়ে বলছিলাম। গানের ব্যাপারটা হলো, ওই যে মরমী একটা কথা বলেছি, পারিন্দার কথা বলেছি, আত্তারের কথা বলেছি, ওখানে আমি একটু দুর্বল হয়ে যাই। কেননা, আমাদের লোকজ অনুষঙ্গে অনেক গান আছে। মরমে আছে। কিন্তু এই মরমীটা আরোপিত মরমী। সবাই মনে করে লালনের গান গেয়ে লালন হয়ে গেলাম। কিংবা হাসন রাজা গেয়ে হাসন রাজা হয়ে গেলাম। আসলে ভেতরে প্রবেশের অংশটুকু থাকে না। রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন যত গান লিখেছেন, প্রেমের গানও পুজোর গান হিসেবে চলছে, পুজোর গানও প্রেমের গান হিসেবে চলছে। রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি শব্দের ভেতরে সমর্পণের যে ভঙ্গিটি আছে, কাকে সমর্পন? সেই নিরাকার ইশ্বরকে নাকি এই ধূলির কাছে মাটির কাছে! জীবনের কাছে সমর্পন। সংগীতের এই অংশটুকু আমাকে সবচেয়ে বেশি যিনি প্রভাবিত করছিলেন, তিনি বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেব। বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেবের সানাই। আমি গানের কিছুই বুঝি না। কিন্তু আমার মনে হয়, এটা শুধু আমাকে মোচড়ই দিচ্ছে না; আমাকে ভাঙছে, আমাকে গড়ছে। তরল যেভাবে কঠিন হয়, আবার তরল হয়ে যায়–তাই করছে। আবদুল করীমও তাই। যারা গানের সমঝদার, তারা এগুলো বলতে পারেন। তারা কাঠামোগত দিক বলতে পারেন। আমার ভালো লাগছে, আমি শুনি। রবীন্দ্রনাথের গান, কিছু কিছু বাণী মনে হয় খালি পড়ি। এখানে আমাদের সংগীতচর্চা অসম্ভব অন্যরকম। আমাদের তরুণ প্রজন্ম সংগীতের দিকে ঝুঁকছে। এই অংশে উচ্চাঙ্গসংগীত বলতে আমরা ভারতীয় মার্গীয় সংগীতের অংশটুকু বুঝি। এটা ছিল সুর প্রধান। বাণী এখানে গৌণ ছিল।
রাজু আলাউদ্দিন: হিন্দুস্তানি?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হ্যাঁ হিন্দুস্তানি মিউজিক যেটাকে আমরা বলতাম। বাণী গৌণ ছিল। বাণীর অংশটুকু সেই অর্থে রাবীন্দ্রনাথ থেকে পেতে শুরু করলাম। এবং বাণী ও সুরের অবকাঠামো মোটা দাগে এসে পেলাম নজরুল ইসলামে। সুরের একটি অংশ উনি আনলেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে, আরেকটি অংশ তুরস্ক থেকে শুরু করে বাল্টিক, কাসপিয়ান থেকে নিয়ে আসলেন। উনার আনাটা এমন–কানকে উনি যেন হাওয়ার সাথে মেলে দিয়েছেন। হাওয়া ওই সুরটা নিয়ে আসছে। উনি তার ভেতর ঢুকে গেছেন। বাণী সেইভাবে তৈরি করছেন। উনি সুরটাকে কানের ভেতর নিয়ে বাণী তৈরি করছেন আর রবীন্দ্রনাথ বাণীটাকে দেয়ার পরে সুরের কাছে আসছেন। দুজনেই বড়। দুজনেই দুজনের জায়গায় বড়। তবে নিজের সুর, নিজের কথা, নিজের মৌলিকত্বে লালনের অবস্থানটুকু আরো নতুনভাবে উন্মোচিত হবে। এই আলেক শাই শব্দটার ভেতর যে মাধুর্য রয়ে গেছে, যে অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য রয়ে গেছে–আরো নতুনভাবে হবে। কারণ আমি লালন এখনো বুঝি না। আমি কিন্তু প্রচুর লালনের গান শুনি। কিন্তু লালন এখনো বুঝি না। মনে হয় যেন শব্দকে ছুঁয়েও ছুঁতে পারছি না। সরে যাচ্ছে। কলিম শরাফী কিংবা আবদুল আহাদ শুনে আমরা যে অভ্যস্ততায় ছিলাম, ফিরোজা বেগম শুনে যে অভ্যস্ততায় ছিলাম, নাম বলব না, আজকে এখানে এসে সেই অভ্যস্ততা যেন মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে আর আমি সুতো পাচ্ছি না, যে সুতো শেষ অবধি যাব। আমার তাই মনে হয়। আমার সন্তানদের জন্য আমি কী রেখে যাচ্ছি–এমন অংশ তো রেখে যাব যেটা পুঁজি করে তারা নতুন কিছু করবে–পুঁজিটা কই? পুঁজিটা তো নাই।
রাজু আলাউদ্দিন: তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন রাজনীতির ক্ষেত্রে যে শূন্যতাগুলো আমরা দেখি এখন…
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: রাজনীতির এই কৃত্রিম শূন্যতা সারা পৃথিবীতেই তৈরি হয়ে থাকবে। হাজার বছরের ইতিহাস তাই বলে। এই রাজ শব্দটার ভেতরে এবং নীতি শব্দটার ভেতরে দুষ্ট রোগ জড়িত আছে। আমি বলতেছি আমার দেশের রাজপথ–এই দেশে কি কোনো রাজপথ আছে? আপনি কেন জনপথ বলতে পারেন না! বলতেছে অমুকের শাসন। অমুকের সেবা কেন বলতে পারে না।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি কি বলতে চাচ্ছেন এটা কলোনিয়াল হ্যাংওভার?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: কলোনি তো দুইশ বছর। এটা হাজার বছরের চারিত্রিক হ্যাংওভার। মোগলদের সময় একটা হ্যাংওভার। তার আগে আফগানদের সময়ে একটা হ্যাংওভার। তার আগে পাঠানদের সময়ের একটা হ্যাংওভার। তার আগে সেনদের সময়ে একটা হ্যাংওভার। তার আগে পালদের সময়ের একটা হ্যাংওভার। এই হ্যাংওভার চলছে। আপনি আর পঞ্চাশ বছর যেতে দেন, এই হ্যাংওভার কেটে যাবে।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি তো বাঙালি নিয়ে ভীষণ আশাবাদি।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: অবশ্যই।
রাজু আলাউদ্দিন: কিছু হতাশার কথাও বলেন শুনি।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: শোনেন, সবকালেই হতাশা থাকে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কালেও হতাশা ছিল। অমুকের কালেও হাতাশা ছিল। লর্ড ক্লাইভের কালেও হতাশা ছিল। হতাশা আকবর বাদশার সময়েও ছিল। হতাশা শের শাহর সময়েও ছিল। এই দেশে পদ্মা আগেও ভাঙছে। এখনো ভাঙে। নতুনরূপে পদ্মা আরো বইবে। পদ্মায় আগে ইলিশমাছ পাওয়া যেত, মাঝখানে পাওয়া যায় নাই, এখন আবার পাওয়া যায়। নানা উপাত্তে প্রকৃতি চলবে। অতএব হতাশার ভেতর দিয়েই ভালোবাসা জাগবে। এটার জন্য ভয়ের কিছু নেই–পদ্মায় পলি পড়ে গেল চিল্লাইছি। লোকজন আগে চিল্লাইত বন্যা হলে ফসল হবে না। দুর্ভিক্ষ হবে। আমরা নতুন পথ বাইর করছি না? আমরা এক বছরের ভেতর তিনবার ফসল করি। আজকে আমার এক হাত গাছ হয় না ধান হয়ে যায়। আগে চোদ্দ হাত গাছ হইত, পানির সঙ্গে সঙ্গে আমন ধান বাড়ত। তাই না? আজকে কীটনাশকে নদীর মাছ মরে গেছে বলে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ করে খাচ্ছি। দুই বছর আগে বাজারের কইমাছ খেতে পারতাম না। ওই স্বাদ মুখ থেকে চলে গেছে। নতুন কইমাছের স্বাদ চলে এসেছে। এটাকে কইমাছ না বলে বইমাছ বলতে পারি। ডাণ্ডা ফেলে দিয়ে বললাম যে, নতুন একটা মাছ এসেছে কইয়ের মতো দেখতে, বই মাছ। আজ বাতাসি মাছ পর্যন্ত চাষ হচ্ছে।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি এগুলোতে শঙ্কিত হন না?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি শঙ্কিত হই না। পৃথিবীর ইতিহাস ধ্বংসের ভেতর দিয়ে তৈরি হয়। ধ্বংস না হলে সভ্যতা হবে না।
রাজু আলাউদ্দিন: আমরা কি সেই ধ্বংসের মুখে আছি?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: মানবজাতি প্রতি মুহূর্তে ধ্বংসের পর্যায়ে আছে। প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টির পর্যায়ে আছে। এটা প্রাণিজগতের নীতি।
রাজু আলাউদ্দিন: তার মানে এটা একটা দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া। হ্যাঁ এবং না-এর দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া।
রাজু আলাউদ্দিন: বেশ।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হ্যাঁ এবং না-এর দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া। কিন্তু হ্যাঁ-এর অংশ সবসময় বেশি থাকবে। এই জন্য পৃথিবী টিকে থাকবে। কোনদিন হ্যাঁ-এর অংশ পঞ্চাশের নিচে উনপঞ্চাশ হবে না। হ্যাঁ-এর অংশ একান্নর উপরেই থাকবে।
“পরকাল বলতে কোনো জিনিস নাই। ইহকালের ভেতরেই একজন প্রকৃতি হয়ে, মহাইশ্বর হয়ে সবকিছু চক্রাকারে ঘুরছে।”
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু হ্যাঁ-এর চেয়ে না-এর অংশ তো..
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: কোনদিন বাড়বে না। যেদিন না-এর অংশ বেড়ে যাবে, সেদিন প্রলয় হয়ে যাবে। কিচ্ছু থাকবে না।
রাজু আলাউদ্দিন: না বাড়লেও তারাই শাসন করে যে আবার!
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: মনে হয় অমন। আপাত তারা শাসন করে না। আপাতত মনে হয় তারা করছে। কিন্তু করে না। পরকাল বলতে কোনো জিনিস নাই। ইহকালের ভেতরেই একজন প্রকৃতি হয়ে, মহাইশ্বর হয়ে সবকিছু চক্রাকারে ঘুরছে। হ্যাঁ, বলতে পারেন, ও তো ছিল মুটে; আজকে কোটিপতি হয়েছে। এক জনম যাবে, দুই জনম যাবে; তৃতীয় জনমে এসে অর্থাৎ তৃতীয় জেনারেশনে এসে আবার সে ফকির হবে। আকবর বাদশার শেষ প্রজন্ম বাহাদুর শাহ ফকির হয়ে গিয়েছিল। লর্ড ক্লাইভ এতকিছু করছিল, সেও আত্মহত্যা করেছে।
রাজু আলাউদ্দিন: অপনার একটা কবিতা দিয়ে শেষ করি। আপনি নিজেকে বিষয় করেও কবিতা লিখছেন। যেমন শহীদ কাদরী লিখেছিলেন অগ্রজের উত্তর.. আপনার অমন একটা কবিতা আছে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমার অমন একটা কবিতা আছে। আমার একজনই বন্ধু, তার নাম হাবীবুল্লাহ সিরাজী।
রাজু আলাউদ্দিন: আবার আরো একটি কবিতা আছে, যেটা আপনার খুবই পরিচিত এবং বিখ্যাত কবিতা–আমি জেনারেল হাবীবুল্লাহ সিরাজী। সম্ভবত এই কবিতাটি আপনার আরো বেশি পরিচিতি পেয়েছে। এই কবিতাটা লেখার কথা ভাবলেন কীভাবে?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আপনার কাছে আমি কনফেস করব এখন। এই ভাবাটা আমার ঠিক মৌলিক ভাবা না। পোয়েম সামথিং কেউ ছিল। কানাডার ওয়ান্টারিও প্রদেশের লন্ডন নামে একটা শহর আছে। সেখানে আমার মেয়ে লেখাপড়া করছে। পিএইচডি করছে। এখন ওখানে পড়ায়। ওই শহরে ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছর যাই। এক মাস, পঞ্চাশ দিন থাকি। ওই লন্ডন শহরের চেরিহিল নামে একটা জায়গা আছে, সেখানে বড় একটি শপিং মল আছে। ওর ভেতরে একটা লাইব্রেরি আছে। ওই লাইব্রেরিটা ব্যবহার করি বিকেলে। একদিন পড়তে পড়তে এই কবিতার মতো করে একটা জিনিস আমার কানের ভেতর বাজল। আমি সঙ্গে সঙ্গে কবিতাটা কপি করে নিয়ে আসলাম। বাড়িতে পড়লাম। এরপর ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। আবার লাইব্রেরিতে গেলাম। এবার পড়ে দেখি তো কিছু পাই কি না। পড়তে পড়তে আমি জেনারেল শব্দটা কয়েন করলাম। তারপর বাকিটুকু আমি ফেব্রিকেট করছি। ওটা কিন্তু একটা বই এবং এর আরো খণ্ড আছে। এই খণ্ডগুলোতে বাংলাদেশ প্রেক্ষিত এবং অন্যান্য প্রেক্ষিত লেখছি। এবং লেফট অ্যান্ড রাইট–পায়ে যে মার্চ করা, এটা আমাদের রাজনীতিতে আমরা বলি– লেফট রাইট। ভেতরে যদি পড়েন আপনি এই জিনিসটি পাবেন। আপনাকে কবিতাটা না শোনালে হবে না। দুটো জায়গা শোনালে আপনি বুঝবেন।
“আমি জেনারেল হাবীবুল্লাহ সিরাজী। আমার কাছে সংবাদ আছে শস্য প্রাণী ও খনির। পোশাক ও বারুদ ইতিহাস পেতে দিলে মোগল মাথায় তোলে পানিপথ। পাটিগণিত ডানা বাড়িয়ে সবজি পশু ও জলের ফলাফল ডাকে। ব্যাঙের ভাষা জানি। খবর রাখি ঐরাবতের। শিস দিতে পারি। চামড়া তুলে এঁকে দিই পলাশীর প্রান্তর। ভক্তকে রক্ত দিয়ে আড়াল করলে রসায়নে প্রস্তুত করি আমার তারকা। আমিই তো জেনারেল সিরাজী। আমি জেনারেল হাবীবুল্লাহ সিরাজী। বুঝতে পারি দিক, রঙের বর্ণনা। পদ্য-গদ্যের মধ্যে বসিয়ে দিতে পারি একাত্তর। কেন্দ্রীয় কোষাগার খুলে বিতরণ করি পিতা, প্রগতি ও পিস্তল। বুঝতে পারি যে আমি তির ধাক্কায় ক্ষুন্ন হলে নড়ে ওঠে পদার্থ বিজ্ঞান। ধৈর্যও মাটিতে টেকে না। আমি জেনারেল সিরাজী।” এরপর বুকের আওয়াজ পাই… ব্লা ব্লা ব্লা.. শেষে এটার মর্মটা এখানে আছে।
“কালো জেনারেল বলছে পাকলে টকটকা লাল মাকাল। প্রগতির বিষয় কাঙাল মালামাল তোমার কপাল। অতঃপর বেসামাল। সাদা জেনারেল বলছে, জানার পরও খলে বর্বাদের কাছাকাছি বলে, থাকো বা না থাকো ছলে রক্ত চলাচলে ঘটনা তেদা বাড়বেই দলে বন্দুকের পোষা নলে। কালো জেনারেল। প্রোটোকল সাদা স্যালুট। সাদা জেনারেল, ইয়েস কালো, ফায়ার। ব্লাক জেনারেল হোআইট জেনারেল।” এই আমাদের হ্যাঁ এবং না।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি কনফেসের কথা বললেন, এলিয়টই বোধহয় বলেছেন বা উনি না বললেও সেটা এরকম: একটি ভালো কবিতা, এমনকি গৌণ কবিতাও আপনি যখন পড়বেন, তখন আপনার ইমাজিনেশনকে ফায়ার করে অন্য আরেকটি কিছু লেখার জন্য। এটিই স্বাভাবিক। এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কবি নাই, যিনি পাঠ না করে, কোনো না কোনোভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে আবার লিখছেন। এটিই স্বাভাবিক।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: পাঠই আসলে এক স্তর থেকে আমাকে আরেক স্তরে নিয়ে যেতে সহায়তা করে।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, এটাই ঠিক।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি কয়েনিস্টের সূত্রটা বললাম।
রাজু আলাউদ্দিন: অনেকেই বলে না এটা। কিন্তু আমি মনে করি যে এটাই আসলে ঘটে। আপনি বলেন বা না বলেন। ঘটনা তো এটাই।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি যদি জেনারেল শব্দটা ওখান থেকে কয়েন করতে না পারতাম, এই সিরিজটা দূরে থাক, এই বইটাই লেখা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না।
রাজু আলাউদ্দিন: অনেকে এসব বলতে ভয় পায়। সেই ভয় দূর করার জন্যও এসব বলা দরকার। আমি মনে করি আর কি।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: ভয় যদি পায়, তাহলে বোয়াল মাছই টিকে থাকত। ছোট বাতাসি মাছটা টিকে থাকত না। বাতাসি মাছ বাতাসি মাছের মতো সাহস নিয়ে চলে। তার স্বাদগন্ধ তার মতো। বোয়াল মাছ বোয়াল মাছের মতো। দেখতে বড় হলেও সে তার মতো করে চলে। দুইটা ভিন্ন জিনিস। যার যার জায়গায় তার তার স্বাদ। যার যার জায়গায় তার তার বর্ণনা। অতএব এখানে ভয়েরও কিছু নেই। বোয়াল বড় বলে তার স্বাদ বেশি, তা না। আমার কাছে বাতাসির স্বাদ বোয়াল থেকে অনেক বেশি।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি চাইলেই উনাকে অনুকরণ করতে পারবেন না। কারণ ভাষা অন্য। আপনি অন্য মানুষ।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমার টেকচার ভিন্ন। আমার টোনালিটি ভিন্ন। আমার ফ্লেভার ভিন্ন। আমার রান্নার প্রণালী ভিন্ন। কিন্তু চোখের সামনে ঝট করে চলে আসে। যেমন আমি বলছি : ‘বিয়ারের টিন খুলতেই কাছে এসে বসলেন ডিলান টমাস।’ তো এইটা কেন? হাউসবোর্ড-এ যখন ডিলান টমাস ক্যাটলিনকে নিয়ে থাকত, ওই চিত্রটা আমার মনের ভেতরে ভাসছে। সে বন্ধুদের নিয়ে বারে বসে বিয়ার খেত। ও কি বিয়ারের টিন খুলে খেত নাকি বোতলের বিয়ার খুলে খেত, নাকি মগে খেত–আমার কাছে ওই টিন খোলার শব্দটা আছে ওই টিন খোলার ভঙ্গিতে। তাই আমি টিন খুলছি। আপনি যখন ডিলান টমাসের নিজের উচ্চারণে কবিতা শোনেন, ঢেউয়ের শব্দগুলো আপনার কানে লাগে, মনে হবে যে বুকের ভেতর এসে ওই শব্দ লাগছে। কী উদাত্ত কণ্ঠে কবিতা পড়া!
রাজু আলাউদ্দিন: আমি শুনছি এলপিতে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: কী উদাত্ত কণ্ঠে কবিতা পড়া!
রাজু আলাউদ্দিন: মানে তার প্রত্যেকটা শব্দের ভেতর দিয়ে..
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হ্যাঁ! ফেনা বেরোচ্ছে শব্দ দিয়ে। সমুদ্রের নুনের ফেনা, মদের ফেনা। ধরতে পারাটা বড় ব্যাপার। সেই ধরার অংশটুকু কে কতটুকু পারে এবং ধরে কে কতটুকু প্রকাশ করতে পারে, সেটাই হল শিল্পের একটি বড় জায়গা। আমি যতই গান শুনি যতই কবিতা পড়ি, ভাইরে, কোনোকিছুই কিছু না, যদি না সেটা বর্তায় অন্যকিছুতে মঙ্গলের জন্য। এটা হলো মহৎ কথার একটি কথা।
রাজু আলাউদ্দিন: আজকের এই আলাপচারিতায় শেষ কথা কী বলতে চান আপনি?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: শেষ কথা আর কি? ভালোলাগা! ভালোবাসা! প্রেম! শেষ কথা এইটাই। কিন্তু এর ভেতর দিয়েও আমরা যেন শিল্পসাহিত্যের প্রতি বদমায়েশি না করি।
রাজু আলাউদ্দিন: অনেক ধন্যবাদ সিরাজী ভাই। অনেক সময় দিলেন। এত ব্যস্ত থাকেন আপনি! অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: ধন্যবাদ আপনাকেও। অনেক অনেক ধন্যবাদ, কবি, গদ্যকার, অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিন, আপনাকে আমার সালাম।
রাজু আলাউদ্দিন: শুকরিয়া।