।। মামুন রশীদ ।।
প্রায় দুই সপ্তাহ আগে প্রথম আলোর মতামত পাতায় এক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক নির্বাহীর ‘প্রয়োজনে ঋণখেলাপিদের পাসপোর্ট স্থগিত করতে হবে’ শিরোনামে লেখাটি আমার গোচরীভূত হয়েছে। আমি যেহেতু অনেক দিন লেখকের সঙ্গে দুটি বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকে দেশে-বিদেশে ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, ঋণ সম্প্রসারণ ও ব্যবস্থাপনা, ঋণ আদায় ও নিরীক্ষার কাজে সম্পৃক্ত ছিলাম, সেই অভিজ্ঞতায় কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা করতে চাই।
কলামটির লেখকের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার কিছুটা পার্থক্য হচ্ছে আমার কখনো স্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে পর্ষদ ছাড়া কাজের অভিজ্ঞতা নেই। তবে গণচীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্কসহ বেশ কিছু এশীয় ও আফ্রিকার দেশে ঋণ-সম্পদের নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা এবং অধুনা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্ধিষ্ণু খেলাপি ঋণের সম্ভাব্য কাঠামোগত ও আইনি সমস্যার সমাধান নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আবার এতৎসংশ্লিষ্ট বেশ কিছুটা ঘাটতি পূরণ হয়ে গেছে বলেও মনে হয়।
কোনো সরকারই ভাবল না, আর্থিক খাত হলো দেশের প্রাণ। এটাকে নষ্ট করা মানে নিজেদের দুর্ভোগ ডেকে আনা। জনগণের বাজেটের টাকা দিয়ে ব্যাংকের, এমনকি প্রশ্নবিদ্ধ বেসরকারি ব্যাংককে মূলধন জোগান দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু ব্যাংকিং খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা হচ্ছে না
লেখক বাংলাদেশে ঋণখেলাপির জন্য রাজনৈতিক প্রভাব ও ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতাকে দায়ী করেছেন। এগুলো সত্য। তবে খেলাপির জন্য সবচেয়ে দায়ী আদতে ঋণঝুঁকি পর্যালোচনা এবং আবিষ্কৃত ঝুঁকি নিরাময়ে সঠিক অস্ত্র বা কাঠামো ব্যবহারের দুর্বলতা বা অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। বাংলাদেশে অনেকেই খাতওয়ারি ঝুঁকি নিয়ে ওয়াকিবহাল নন। নিজ নিজ ব্যাংক, এমনকি ব্যাংকিং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোও অর্থায়নের উদীয়মান ঝুঁকি নিয়ে ব্যবস্থাপকদের খুব একটা দীক্ষিত করেন না।
লেখাটি ছাপা হওয়ার পর প্রথম আলোর অনলাইনে ‘খেলাপির জন্য কি ব্যাংকাররাও দায়ী নন’ শিরোনামে একজন ব্যবসায়ীর একটি প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘সরকারি ব্যাংকে রাজনৈতিক চাপ আছে, কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকে তো রাজনৈতিক চাপ নেই। তবে কেন বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক বসাতে হলো?’
তাঁর এ বক্তব্য বোধ হয় ঠিক নয়, কারণ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের বোর্ডের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, তারাও কীভাবে রাজনৈতিক বা সরকারি কর্তাদের দ্বারা প্রভাবিত বা অত্যাচারিত। এমনকি অনেক এমপি, মন্ত্রীর ব্যাংকে ‘ইনসাইডার লেন্ডিং’ অনেক বেশি। অনেক জায়গায় আবার পারস্পরিক পৃষ্ঠ চুলকানির ঘটনাও অনেক।
মন্দ ঋণের জন্য ব্যাংকারদের দায়ী করতে গিয়ে সেই ব্যবসায়ী লিখেছেন, সম্প্রতি তিন ইসলামি ব্যাংক থেকে কীভাবে ঠিকানাবিহীন মজুর-কর্মচারীদের নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে শত শত কোটি টাকা লোপাট হলো? তিনি আরও বলেছেন, যতই রাজনৈতিক চাপ থাকুক, হল-মার্ক কিংবা অ্যাননটেক্সের ঋণ ব্যাংকাররা শাখার ঋণ প্রস্তাবের মাধ্যমে পাস করেছেন, বেসিক ব্যাংকের মতো শাখার ঋণ প্রস্তাব ছাড়া ঋণ পাস হওয়ার কথা এখনো শোনা যায়নি। এটি হয়তো ঠিক, তবে আরও ঠিক হচ্ছে ওপরের, সরকার নিয়োজিত বোর্ডের সদস্যদের অদৃশ্য প্রভাব বা চাপ। এমনকি অনেক সময় উচ্চপর্যায়ে অর্থেরও লেনদেন।
ব্যবসায়ী বন্ধু কিংবা মন্তব্যকারী হয়তো যথার্থই বলেছেন, জনতা ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের দুই এমডির প্রস্থানের পর দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে, কিন্তু কোনো এমডি তো রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ঋণ পাসে অপারগতা প্রকাশ করে পদত্যাগ করেননি। তাঁর মতে, ভালো ব্যাংকার হলে সৎ সাহস দেখাতে হয়।
শুধু তা-ই নয়, অনেক ব্যাংকারের বিরুদ্ধে কম মূল্যের জামানত বেশি মূল্যে দেখানো, বৈশ্বিক বিপদ-আপদে ব্যবসায়ীকে প্রয়োজনীয় পরিচালনা মূলধন না দিয়ে ব্যবসাকে কঠিন করে তোলা, অনেক ক্ষেত্রে ঘুষ দাবি করা ইত্যাদি অভিযোগ রয়েছে। অনেকটা সত্য, তবে তার চেয়ে নির্জলা সত্য হচ্ছে কোনো ব্যর্থতা বা অপরাধে সঠিক দায় নির্ণয়ের সমস্যা। সেই সঙ্গে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকের উচ্চ নির্বাহীদের ওপর চেয়ারম্যান বা প্রভাবশালী পরিচালকদের চাপ, এমনকি তাদের সঙ্গে অন্যায্য সমঝোতা। সোজা কথায় বলতে গেলে, পারস্পরিক সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা।
ব্যবসায়ী বন্ধু অবশ্য যথার্থই বলেছেন, কোনো সরকারই ভাবল না, আর্থিক খাত হলো দেশের প্রাণ। এটাকে নষ্ট করা মানে নিজেদের দুর্ভোগ ডেকে আনা। জনগণের বাজেটের টাকা দিয়ে ব্যাংকের, এমনকি প্রশ্নবিদ্ধ বেসরকারি ব্যাংককে মূলধন জোগান দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু ব্যাংকিং খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের একটু-আধটু চাপে কখনো কখনো এ খাতে কিছু সংস্কার দেখা গেলেও স্থায়ী কোনো সংস্কার এ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। তবু তিনি আশায় আছেন, সরকার কোনো না কোনো সময় ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে সংসদে আইন পাস করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
আমি বলি, ঋণখেলাপি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সরকারের শক্ত অবস্থান সব সমস্যার সমাধান করবে না। প্রয়োজন ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় আরও প্রযুক্তির ব্যবহার, সামগ্রিক ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও নিরপেক্ষতার আশ্রয় নেওয়ার ব্যবস্থা করা, নতুন নতুন ঋণপণ্যের প্রচলন এবং শক্তিশালী ঋণ-সম্পদ নজরদারির ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে আমাদের একটি দেউলিয়া আইনও প্রয়োজন।
মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক