- সারাদেশে নিন্দার ঝড়।
লণ্ডন, ৩ সেপ্টেম্বর- বাংলাদেশের অবৈধ ও অনৈতিক বর্তমানে পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সরকারের পক্ষে ‘আলো আসবেই’ শিরোনামের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলেছিলেন চিত্রনায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য ফেরদৌস আহমেদ। সেই গ্রুপে সাজু খাদেম, শামীমা তৃষ্টি, রিয়াজ আহমেদ ছিল এডমিন। এ ছড়া সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবিব নাসিম, অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু ও অরুণা বিশ্বাস, সাইমন সাদিক, সুবর্ণা মুস্তাফা, শমী কায়সার, তানভীন সুইটি, জ্যোতিকা জ্যোতি, স্বাগতা’সহ অনেকেই ছিলেন। তাদের প্রধান এজেন্ডা ছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সফল করতে না দেওয়া। যে কোনো ভাবে আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করে তাদের নীল নকশা বাস্তবায়ন করা।
ওই গ্রুপের কথোপকথন এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাসের ‘গরম জল’ ঢেলে দেওয়ার অংশটুকু নেট দুনিয়ায় ভাইরাল। যা নিয়ে চারিদিকে বইছে নিন্দার ঝড়। গত ৫ আগস্ট থেকে গা-ঢাকা দিয়ে আছেন তারা সবাই। কেউ কেউ এরই মধ্যে গোপনে দেশত্যাগ করেছেন। গত ৬ আগস্ট বিকেলে দেশত্যাগ করেছেন অরুণা বিশ্বাস। খবর নেই ফেরদৌস, নিপুণ, রিয়াজ, ফজলুর রহমান বাবু ও তুষ্টিদের। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত সুবিধা নিতেন বলে খবর রয়েছে। পর পর ৬ বার সেন্সার বোর্ডের সদস্য হয়েছেন অরুণা বিশ্বাস। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটিতে জায়গা করে শামীমা তুষ্টি ভাগিয়েছেন অনুদানের সিনেমা।
ফেরদৌসের পর আগামী নির্বাচনে চিত্রনায়ক রিয়াজ আহমেদ সংসদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। বিটিভি থেকে সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য ফজলুর রহমান বাবু, আহসান হাবিব নাসিম, সুইটি আন্দোলন পন্ড করতে বেশ ভূমিকা নিয়েছিল বলে খবর রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থাকার ১৫ বছর তারা দুজন সহ তানভীন সুইটিকে বিটিভির নাটকে বেশি দেখা যায়। তারা ছাড়াও শেখ হাসিনার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে শমী কায়সার, তারিন জাহান, উর্মিলা শ্রাবন্তী কর, খোরশেদ আলম খাসরু সহ আরও অনেকেই ছাত্র-জনতার বিপক্ষে সরব ছিলেন।
‘আলো আসবেই’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এসব নেতা ও শিল্পী আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। মঙ্গলবার দুপুরে গ্রুপের কয়েকটি স্ক্রিনশট প্রকাশ্যে আসার পর সমালোচনার ঝড় উঠেছে। নির্মাতা ইমেল হক একাধিক স্ক্রিনশট ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেছেন, ‘অরুণা বিশ্বাস এবং সোহানা সাবার এখন কথা ফুটছে। অথচ আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন স্বৈরাচারের পক্ষ নিয়ে এরা কী ধরনের আলাপ করত তার দুইটা নমুনা দিলাম।…’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি স্ক্রিনশট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গ্রুপের সদস্যরা আন্দোলনের বিপক্ষে সরব ছিলেন। আন্দোলনকারী ও আন্দোলনের পক্ষে থাকা নির্মাতা ও শিল্পীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিলেন তাঁরা। আন্দোলনকারীদের বিষোদগার করেছেন ‘আলো আসবেই’ গ্রুপের শিল্পীরা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিল্পী ও নির্মাতাদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থীদের পক্ষে রাজপথে ছিলেন। পুলিশের গুলিতে একের পর এক শিক্ষার্থীর নিহতের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন বহু শিল্পী–নির্মাতা। ছাত্র–জনতার ওপর দমন–পীড়ন চলাকালে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে সাফাই গাইতে দেখা গেছে অল্প কয়েকজন শিল্পীকে; মূলত তাঁরাই ‘আলো আসবেই’ গ্রুপের সদস্য ছিলেন।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কথোপকথনে অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতিকে লিখতে দেখা গেছে, ‘বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আগুন। ফায়ার সার্ভিস ও গণমাধ্যমকে ঢুকতে দিচ্ছে না টোকাই জামাত শিবিরের মেধাবী আন্দোলনকারীরা।’ তখন আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস বলেছেন, ‘গরম জল দিলেই হবে।’
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো ‘আলো আসবেই’ গ্রুপের শিল্পীদের কেউ কেউ গা ঢাকা দিয়েছেন। কারও কারও ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ দেশের বাইরে উড়াল দিয়েছেন। অনেকটা নীরবে কানাডা গেছেন অরুণা বিশ্বাস। অভিযোগের বিষয়ে প্রথম আলোর তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলে ‘গরম জল দিলেই হবে’ মন্তব্যটি তাঁর বলে স্বীকার করেছেন তিনি। কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে থাকা নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, আশফান নিপুন, অভিনেতা সিয়াম আহমেদ, অভিনেত্রী নাজিফা তুষি, সাদিয়া আয়মানসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে ক্রোধ প্রকাশ করেছেন ‘আলো আসবেই’ গ্রুপের সদস্যদের কেউ কেউ। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, নাজিফা তুষিদের কেউ এ গ্রুপে ছিলেন না।
আওয়ামী লীগ নেতা ও আওয়ামী লীগপন্থী শিল্পীদের এই গ্রুপে লিমন আহমেদ নামের এক বিনোদন সাংবাদিককেও দেখা গেছে। আন্দোলনের পক্ষে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর একটি ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট ‘আলো আসবেই’ গ্রুপে দেন লিমন। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে প্রকাশের অযোগ্য ভাষায় গালি দিয়েছেন অভিনেত্রী সোহানা সাবা, অরুণা বিশ্বাস, জ্যোতিকা জ্যোতিসহ আরও কয়েকজন। আন্দোলনের পক্ষে যাঁরা প্রোফাইল লাল করেছিলেন তাঁদের চিনে রাখা এবং পরবর্তী সময়ে ‘সাইজ করার’ হুমকির কথাও এসেছে এই গ্রুপে। আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে প্রোফাইল ‘লাল’ করায় এক সংগীতশিল্পীকে নিয়ে অরুণা বিশ্বাস লিখেছেন, ‘বয়স যদি কম থাকত পিটাইতে পিটাইতে বাবা ডাক শিখাইতাম।’ আন্দোলনের পক্ষে ‘এক দফা’ শীর্ষক ছবি কাভারে পোস্ট করেছিলেন তরুণ অভিনেত্রী নাজিফা তুষি। সেই পোস্টের স্ক্রিনশট ‘আলো আসবেই’ গ্রুপে দিয়ে তাঁকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এই গ্রুপ থেকেই সরকারের পক্ষে শিল্পীদের নিয়ে বিটিভি, এফডিসির সামনে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। এই গ্রুপে অ্যাডমিনদের পাশপাশি আন্দোলনের বিরুদ্ধে রোকেয়া প্রাচী, পরিচালক মাসুদ পথিক, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী করসহ আরও অনেকে সরব ছিলেন। এসব স্ক্রিনশট ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেক শিল্পী, নির্মাতা ‘আলো আসবেই’ গ্রুপের শিল্পীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
নির্মাতা আশফাক নিপুন এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘“আলো আসবেই” গ্রুপে আমার যত সহকর্মী ছিলেন সবাইকে বলতে চাই, এখনো সময় আছে “আলোতে আসেন”। খুনি শাসক না, জনগণই সকল আলোর উৎস। আপনাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। এটার স্ক্রিনশট নিয়েও ছড়িয়ে দেন, যদি এখনো আপনাদের কোনো গোপন গ্রুপ থাকে।’
এদিকে আন্দোলনের বেশ কয়েকদিন আগে থেকে দেশের বাইরে ছিলেন আলোচিত অভিনেতা জায়েদ খান। দেশের বাইরে থেকেও সক্রিয় ছিলেন এই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে। তিনি গ্রুপে এক সাংবাদিকের দেয়া মেসেজ ফরোয়ার্ড করে লেখেন। সহমত। সেটি ছিল, ‘কেবল একটু আওয়াজ হলো জয় বাংলা। আজ ফেসবুক পুরাই শান্ত দিঘীর জলের মতো স্বচ্ছ। এক পেশে চিৎকার আর স্বস্তা আবেগে ওরা জাস্ট একটা ট্রমার মধ্যে রেখেছিল দেশটাকে।’ এছাড়া আরও কয়েকটি বিষয়ে কথা বলেছেন এই তারকা। তাকে অনুমান করা যায় নানা দিক নির্দেশনা ও পরামর্শ দিতেন সেই গ্রুপে।
বিষয়টি ইতোমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ঝড় উঠেছে। এই গ্রুপে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে নিয়েও কথা হয়। ফলে ফারুকী বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেননি। এটিকে মানবতাবিরোধী আখ্যা দিয়ে তিনি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সামাজিক মাধ্যমে এর বিচার চেয়েছেন।