উপকূলীয় জনপদ বরগুনার বেতাগীতে বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় ঐতিহ্য হারাতে বসেছে এ শিল্প। আধুনিক সভ্যতার দাপটে জীবনধারায় বিপুল পরিমান প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহারে এ এলাকার মানুষ গৃহস্থালির কাজে বাঁশ ও বেতর তৈরিকৃত নান্দনিক উপকরণে আগ্রহ হারাচ্ছে। প্লাস্টিকের পন্য ব্যবহারের ফলে এবং বাঁশ-বেত শিল্পের সহজলভ্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল না থাকায় এ পেশার কারিগররা জীবিকার তাগিদে বেঁছে নিচ্ছেন অন্য পেশা।
সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপচারিতায় জানা গেছে, এ উপজেলায় একটি পৌরসভাসহ ৭ টি ইউনিয়নে দেড় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এক যুগ আগেও ৮ শতাধিকের উপরে পরিবার এ পেশায় সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু অনেকেই এ পেশা ছেড়ে কৃষি, কাঠমিস্ত্রীর কাজ ও ব্যবসাসহ অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। বর্তমানে এ পেশায় মাত্র দেড়শ পরিবার যুক্ত রয়েছে।
পুরুষদের পাশাপাশি সংসারের কাজ শেষ করে নারী কারিগররাই বাঁশ দিয়ে এই সব পণ্য বেশি তৈরি করে থাকেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাঁশ ও বেত দ্বারা এই সব পণ্য তৈরি করে থাকেন। বর্তমানে বেত তেমন সহজলভ্য না হওয়ায় বাঁশ দিয়েই বেশি এই সব চিরচেনা পণ্য তৈরি করছেন এই কারিগররা।
বাঁশ ও বেত থেকে তৈরি সামগ্রী শিশুদের দোলনা, র্যাগ, পাখা, ঝাড়ু, টোপা, ডালীর এখন আর দেখা মেলে না গ্রামে। সাজি, ওরা, কুলা, মোরা, পুরা, দাড়িপাল্লা, ঝাঁপি, ফুলদানি, ফুলের ডালি, খাবার ঘরের ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, টেবিল, সোফা সেট, খাট, মাছ ধরার পোলো,চাই, বুচনাসহ বিভিন্ন প্রকার আসবাবপত্র গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র নান্দনিক ব্যবহার ছিলো এক সময়। গ্রাম বাংলার কৃষকরা তাঁদের ধান চাল গোলায় রাখার বাঁশের চাটাই, মোরা, ডোলা ব্যবহার করতো।
আকার আকৃতি অনুযায়ী একটি বাঁশ ১৫০ থেকে ৩০০ টাকায় কিনে নিচ্ছেন। বাঁশের ধরণ অনুযায়ী একটি বাঁশ থেকে দুইজন কারিগরে ২ দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে ৫ থেকে ৭ টি সাজি তৈরি করা সম্ভব এবং যার বর্তমান মূল্য ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা।
বেতাগী পৌরসভার ভবরঞ্জন ঢালী জানায়, ‘ বর্ষা মৌসুমের মাছ ধরার বুচনা তৈরি করতে দুইদিন সময় লাগে এবং এতে ১৫০ টাকার মূল্যের বাঁশ ও ১০০ টাকার মূল্যের বেত লাগে। একটি বুচনার মূল্যে ১০০০ টাকা থেকে ১৩০০ টাকা হয়ে থাকে।
বেতাগী সদর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসন্ডা গ্রামের কারিগর কালু হাওলাদার বলেন, ‘ এ বাঁশ-বেত পেশা ধরে রাখতে ধার-দেনা ও বিভিন্ন এনজিও থেকে টাকা ঋণ নিয়ে কাজ করছি। তবে বেশি লাভ পাচ্ছি না কারণ এর চেয়ে কম দামে মানুষ প্লাস্টিকের পন্য কিনতে পারে।’
এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত একাধিক ব্যক্তি জানান,’আমাদের এই শিল্পটির উন্নতির জন্য সরকারিভাবে অল্প লাভে ঋণ দেয়া হয় তাহলে এই শিল্পটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
আধুনিক সভ্যতার প্লাস্টিক সামগ্রীর দাপটে বরগুনার বেতাগী উপজেলা ও পৌর শহরের বাসিন্দারা হারাতে বসেছে বাঁশ ও বেত শিল্পের ব্যবহার। বাঁশ আর বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় ভালো নেই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগররা। তবুও বাপ-দাদার এই পেশাকে এখনও জীবিকার প্রধান বাহক হিসাবে আঁকড়ে রেখেছে উপজেলার কিছু সংখ্যক পরিবার।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল হোসেন মজুমদার বলেন, ‘বাঁশ ও বেত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে কৃষকদের সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া প্রয়োজন। এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত কৃষক ও কারিকরদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং অনুপ্রেরণা হিসেবে যথাযথ প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা দরকার।’
এ বিষয় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. সন্তোষ কুমার বসু বলেন, ‘বাঁশ ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। এ জাতীয় উদ্ভিদ বাড়ির আঙ্গিনাসহ একটু উঁচু জমিতে জন্মানো সম্ভব। বর্তমান সভ্যতায় এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসা দরকার।’
এ বিষয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সুহৃদ সালেহীন বলেন, গ্রামীণ ঐতিহ্য ও এসব ক্ষুদ্র পেশাজীবীদের পুর্নবহালের জন্য আগ্রহীদের মাঝে সহজশর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।