কলকাতা: সম্প্রতি জল্পনা তৈরি হয়েছিল যে, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার ভাতিজা তথা দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাকি দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মতপার্থক্য নাকি এতটাই হয়েছিল যে, অভিষেক তার সংসদীয় কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবার ছাড়া বিশেষ কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছিলেন না।
এমনকি সম্প্রতি শেষ রাজনৈতিক অনুষ্ঠান মমতার ৪৮ ঘণ্টা ধরনা অবস্থানেও অভিষেককে দেখা যায়নি। ফলে জল্পনা অনেকটাই জোরালো হয়েছিল। অনেক সংবাদমাধ্যম দাবি করছিল, তৃণমূলে আদি এবং নব্য-এখন দুটো দল। একটি মমতার দল, অপরটা অভিষেকের দল। এমনও শোনা যাচ্ছিল যে, ২০২৬ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির জোটে মুখ্যমন্ত্রী হবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
তবে সব জল্পনা অবসান ঘটিয়ে এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, কিছু বিষয় নিয়ে হয়তো তৃণমূল প্রধানের সঙ্গে তার মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু দলের নেত্রী নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে দলে কোনো বিভেদ নেই। দল অটুট এবং ঐক্যবদ্ধ। অভিষেকের কথায়, পদ্ধতিগত পার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু দলে নেত্রী একজনই, তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সত্যিই কি পদ্ধতিগত পার্থক্য আছে? জবাবে অভিষেক বলেছেন,পদ্ধতিগত পার্থক্য থাকতেই পারে। সেটা দলের জন্য স্বাস্থ্যকর। যদি পার্থক্য না থাকে তাহলে তা মিথ্যা বলা হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। আমার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত কোন বিরোধ নেই।
বলা হয়, তৃণমূলের এখন দুটো দল, একটা মমতার দল অপরটা অভিষেকের দল? অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি একদিন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী হবে? জবাবে তিনি বলেছেন, বিজেপির সঙ্গে যারা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে যুক্ত করছে তারা ভুলে যাচ্ছে। আমি তো বারবার বলেছি, এখনো বলছি ,আমার গলা কেটে দিলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ, তৃণমূল কংগ্রেস জিন্দাবাদ, জয় বাংলা স্লোগান বেরোবে। তৃণমূলের দুটো দল নেই। আমার গলা কেটে দিলেও শিরদাঁড়া উঁচু থাকবে। আর দুটো, তিনটে, চারটে যেকটা দলের কথাই বলুন না কেন, আমার কাজ সব জায়গায় ঢুকে জোড়া ফুল ফুটানো(তৃণমূলের প্রতীক)।
এবারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কটা আসন পাবেন এবং বিজেপি কটা পেতে পারে? অভিষেক বলেছেন, যারা ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দাবি করেছিল বিজেপি ২০০টা আসন পাবে, তাদের কি পরিণতি হয়েছিল আমরা সবাই দেখেছিলাম। ফলে মানুষ ঠিক করবে বিজেপি কটা আসন পাবে আর তৃণমূল কটা পাবে। এবং আমি চাই, এবারে পারফরমেন্সের ভিত্তিতে ভোট হোক। আর এই ভোটটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন করার ভোট নয়। এই ভোটটা ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করার। ফলে জনগণকে রিপোর্ট কার্ড তৃণমূল কংগ্রেস দেবে না, রিপোর্ট কার্ড নরেন্দ্র মোদি সরকার দেবে। তবে আমরা চাই রাজনৈতিক কর্মসূচি হোক কর্মের ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে নয়। তবে এবারের নির্বাচনে ২২ এর বেশি আসন পাবো আমরা। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল ২২টি এবং বিজেপি পেয়েছিল ১৮ আসন। বাকি দুই পেয়েছিল কংগ্রেস।
ভারতে কি হবে? বিজেপি কি আবার ক্ষমতায় আসবে নাকি ইন্ডিয়া জোট? তার অভিমত, বলা মুশকিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারেবারে বলছিলেন, যে রাজ্যে যে রাজনৈতিক দল শক্তিশালী তারাই ভোট করুক। পরে ঠিক করা হবে। কিন্তু সেটা ‘জোট’ শুনেনি। ফলে একপ্রকার বলা মুশকিল। এর জন্য অভিষেক কংগ্রেসকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, কংগ্রেস সারাদেশে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ছে আর বাংলা এসে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
ভোটে যে বিনোদোন জগতের কলাকুশলীদের টিকিট দেওয়া হয়, এনাদের আদতেই দেওয়া উচিত? তিনি বলেছেন, রাজনীতিতে সবাই আসতে পারেন। কিন্তু জেতার পর যদি মানুষের জন্য সময় না দিতে পারে, তার জনপ্রতিনিধি হওয়ার অধিকার নেই।
তাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাঙ্গে সক্রিয়ভাবে দেখা যাচ্ছে না কেন? অন্তত গত চারমাসে মমতার মুভমেন্টে সেভাবে কেন অভিষেককে দেখা যায়নি? এমন প্রশ্নে অভিষেক বলেছেন, সবই নির্ভর করে তৃণমূল প্রধানের পরিকল্পনার উপর। তিনি যেমনটা বলবেন তেমনটাই হবে। আমি দলের অনুগত সৈনিক মাত্র।
দলনেত্রী আপনাকে সৈনিক নয় সেনাপতি মনে করে, কালের নিয়মে সেনাপতিকেও একদিন ক্ষমতায় যেতে হয়, আপনি কি যাবেন? অভিষেক বলেছেন, আমার প্রশাসনে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। আমি দল নিয়ে ব্যস্ত থাকতে খুশি। আমি সংগঠনে থেকে কাজ করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমার লক্ষ্য কিভাবে সংগঠনকে আরো শক্তিশালী করা যায়। একদিন রাজা হয়ে ক্ষমতায় আসবো – এ ধরেন ম্যানুপুলেশন সিচুয়েশনগুলো নিয়ে এখনই কথা না বলাই ভালো।
সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে অর্থের পাহাড় উদ্ধার হয়েছিল। এ ঘটনা বাংলার কলঙ্কজনক অধ্যায় বলে অভিষেক উল্লেখ করেছেন। তিনি জানান পার্থকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, আমি এখনও মনে করি বয়স্কদের রাজনীতি বেশিদিন থাকা উচিত নয়। শুধু রাজনীতি নয় সমাজের যেকোনো সেক্টরে। তবেই কাজের উদ্যম আসে।
মূলত এই নিয়ে মমতার দলে বিভেদ তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন মমতাকে সরিয়ে অভিষেক মুখ্যমন্ত্রী হতে চান। জবাবে তিনি বলেছেন, সবক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমী চরিত্র থাকে। যেমন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অথবা সাবেক ক্যাপ্টেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। তারা এই বয়সে যা ওয়ার্ক লোড নিতে পারেন অনেক তরুণরাও পারেন না। এটাকেই ব্যতিক্রমী চরিত্র বলে। আমিও ওনাদের মত পারবো না। এখন আমার বয়স ৩৬, কিন্তু ৬০ বছর বয়সের আগেই আমি রাজনীতি থেকে অবসর নেবো।