কথায় বলে চোরের কোন ধর্ম নেই। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের রক্তে দুর্নীতি, রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। এই দুর্নীতি এতটাই ভয়াবহ পর্যায়ে পৌচেছে যে মডেল মসজিদ নির্মোণেও দুর্নীতির নতুন মডেল স্থাপন করেছে।
সরকার দেশব্যাপী ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণের প্রজেক্ট থেকেও টাকা লুট করছে। উদ্বোধনের আগ থেকেই মসজিদের ফ্লোরে থাকা টাইলস ফেটে ও উঠে যাচ্ছে। পিলার ও দেয়াল বাঁকা করে নির্মাণ করা হয়েছে। দেয়ালের রং উঠে যাচ্ছে। কোনোটির কাঠের দরজা ত্রুটিপূর্ণ; প্লাস্টিকের দরজা নিম্নমানের। কোনোটির টাইলস ভাঙা, যথাযথ হয়নি প্লাস্টার। টয়লেটসহ অধিকাংশ ফিটিংস নিম্নমানের। সামনের সিঁড়ি উঁচু হওয়ায় বয়স্কদের উঠতে সমস্যা। এ চিত্র দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত মডেল মসজিদগুলোর। শুধু নির্মাণ ত্রুটি নয়, জায়গা নির্বাচন নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। এমন জায়গায় মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে যার কাছেই রয়েছে একাধিক মসজিদ। ফলে নামাজ পড়ার জন্য মিলছে না প্রত্যাশিত মুসল্লি। মসজিদে শিক্ষার্থীদের কোরআন হেফজ করানো, হজযাত্রীদের ডিজিটাল নিবন্ধন করানোসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার কথা থাকলেও সেগুলো অনুপস্থিত।
মডেল মসজিদ নির্মাণ নিয়ে দেশের জনগণ আশা করেছিল যে, মসজিদগুলোতে যোগ্য ও পরহেজগার জনবল নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে সরকার ইসলাম ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্যে একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে দেশবাসী লক্ষ্য করছে যে মসজিদ নির্মাণ নিয়েও ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে। এর পূর্বেও মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের দেয়া ঘরও ধসে পড়েছিল উদ্বোধনের আগেই। এভাবে প্রজেক্টের নামে দেশের সম্পদ লুটেপুটে খাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকেরা।
মডেল মসজিদের এ চিত্র উঠে এসেছে খোদ সরকারি প্রতিবেদনে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে আইএমইডি ডেভেলপমেন্ট টেকনিক্যাল কনসালট্যান্ট (প্রাঃ.) লিমিটেডকে (ডিটিসিএল) পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি ৫৬০টি মডেল মসজিদ থেকে ১৭৫টি নমুনা মডেল মসজিদ পরিদর্শন করে। এতে উঠে এসেছে মডেল মসজিদ নির্মাণের বেহাল চিত্র।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মডেল মসজিদটি পরিদর্শনে দেখা যায়, কাঠের দরজা ত্রুটিপূর্ণ। চারটি প্লাস্টিকের দরজা নিম্নমানের। ঝড়-বৃষ্টি হলে জানালার গ্লাস খুলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার কুমিল্লার চান্দিনায় যে মডেল মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে সেটি উপজেলা প্রশাসন থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মাধইয়া বাজার সংলগ্ন এলাকায়। মসজিদটির কাছাকাছি জায়গায় আরও তিনটি মসজিদ রয়েছে। বাজার সংলগ্ন এলাকায় তেমন জনবসতি না থাকায় মডেল মসজিদে নামাজ পড়ার মুসল্লি সংখ্যা কম। মসজিদটি উদ্বোধন করা হলেও সিঁড়ি ও টাইলসের কাজ বাকি। রঙের কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। নামাজ ছাড়া প্রকল্পের অন্য কাজ এখনো শুরু হয়নি। চাঁদপুর জেলা সদর উপজেলার মডেল মসজিদ পরিদর্শনে দেখা যায়, মসজিদের কলাম ঢালাই যথাযথভাবে হয়নি। ইটের গুণগত মানও খারাপ।
আইএমইডি প্রতিবেদনে দেখা যায়, দিনাজপুরের বিরলে নির্মিত মডেল মসজিদে ব্যবহৃত টাইলস ভাঙা। খাগড়াছড়ির পানছড়ি মডেল মসজিদের কিছু কিছু জায়গায় রং ঠিকঠাক হয়নি। ভবনের কিছু স্থানে প্লাস্টার যথাযথ হয়নি। দরজা-জানালায় অসঙ্গতি। বাথরুমের অনেক জায়গায় কল নেই, টয়লেটে ফ্ল্যাশ নেই, যথাযথ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। দক্ষিণ দিকে শর্ট সার্কিট হয়ে আছে। সুইচগুলো মানসম্মত নয়। মসজিদের মেহরাব ড্রইং অনুযায়ী হয়নি। ছাদে পানি জমে। পার্কিং টাইলস কোটিং করেনি।
ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলায় টাইপ সি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয়। মসজিদটির প্লাস্টার নিম্নমানের। বাথরুমের ফিটিংসের অবস্থা নাজুক। দেওয়ালে ফাটল। টাইলস ঠিকমতো বসানো হয়নি।
ফরিদপুরের সালথা উপজেলা সদরে একটি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয়েছে। যা উদ্বোধনের আগে হাত দিলেই উঠে আসছে মডেল মসজিদের প্লাষ্টার, ফেটে যাচ্ছে টাইলস।
সিরাজগঞ্জে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক শিক্ষা কেন্দ্র নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারসহ নানা অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। জেলার উল্লাপাড়া উপজেলায় নির্মাণাধীন উপজেলা মডেল মসজিদ এবং ইসলামিক শিক্ষা কেন্দ্র নির্মাণ কাজে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, মূল ভবনের পিলারগুলো আঁকা-বাঁকা ও ছাদ ঢালাইয়ের আগেই সকল পিলার হেলে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। এলাকাবাসী জানান, নিম্নমানের কাজ গোপন করতে দ্রুত বালুমাটি দিয়ে পিলারগুলো ভরাট করার চেষ্টা করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পরে মসজিদের চারপাশে ভিত্তি ঢালাই ও পিলার করার জন্য গর্ত করে। কিন্তু বৃষ্টিতে মাটি সরে গিয়ে আঁকা-বাঁকা ও হেলে পড়া পিলার দৃশ্যমান হয়। স্থানীয় জনগণ মোবাইল ফোনে ছবি তুলে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানান।
রংপুরের দুই উপজেলা তারাগঞ্জ ও কাউনিয়া উপজেলায় প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি মডেল মসজিদ নির্মাণ প্রকল্পের কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে মসজিদে ইতালিয়ান মার্বেল টাইলস না দিয়ে নিম্নমানের দেশি টাইলস দিয়ে মেঝেসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যবহার করায় কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
নেত্রকোনার বারহাট্টায় কোর্ট ভবন এলাকায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে মডেল মসজিদ। গত ৩০ জানুয়ারি রাতে মসজিদের তিন তলার একটি গ্রেটবিম ধসে পড়লে বিকট শব্দে এলাকাবাসীসহ সবাই চলে যান দেখতে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা রাতারাতি বিমটি ভেঙে সরিয়ে ফেলেন। নিশ্চিহ্ন করে ফেলেন রাতের মধ্যেই। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে ঠিকাদার নিম্নমানের কাজ করছেন। প্রকৌশলীর সহায়তায় একটি মসজিদ নির্মাণেও তারা দুর্নীতি করেছে। শ্রমিকদের কম টাকা দেওয়ায় কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে পাশের একটি দোকানে বাকি রেখে শ্রমিকরাও চলে যায়। এরপর আবার নিয়ে আসা হয় নতুন শ্রমিক। এদিকে বাকি দেওয়া দোকানদাররাও পাননি টাকা। সেই সঙ্গে ঠিকাদারি ইঞ্জিনিয়ারও বাকি করেছেন অনেক টাকা।
দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মোট ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের অধিকাংশ মসজিদ সরেজমিনে পরিদর্শনে এমন চিত্র পেয়েছে আইএমইডি।
আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা প্রকল্পটি পরিদর্শন করে সরেজমিনে প্রতিবেদন তৈরি করেছি। প্রতিবেদনের কপিও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা মিটিং করবো। আলাদাভাবে সুপারিশ করে বিষয়গুলো জানতে চাইবো। পরবর্তী পদক্ষেপ কী নেওয়া হবে তা জানতে চাওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘বই আকারে প্রতিবেদন দিলে তেমন কোনো কাজ হয় না। অনেকে বই নিয়ে রেখে দেয়। মিটিং করে চিঠি দিলে কিছু কাজ হবে। একই ব্যত্যয় যাতে বারবার না হয় সে বিষয়েও আমরা সুপারিশ করবো। মডেল মসজিদ নির্মাণের মান কেন খারাপ হলো এ বিষয়েও আমরা জানতে চাইবো।’
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় ইসলামিক কার্যক্রমের সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত মডেল মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১৪ সালের সাজানো নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ছিল। ২০১৭ সালের ২৫শে এপ্রিল একনেক সভায় প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মোট ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। বাস্তবায়ন করছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মন্তব্য
মডেল মসজিদ প্রকল্পে অনিয়মের বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক বলেন, ‘প্রকল্পে বড় ধরনের কোনো অনিয়ম হয়নি। ছোটখাটো কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে। সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। উল্লাপাড়ায় পিলারগুলো ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। বিদ্যুতের কাজে আমরা ভালো মানের পণ্য ব্যবহার করেছি। আইএমইডি যে তথ্য সংগ্রহ করেছে, সেটাই সঠিকভাবে হয়নি। তথ্য সংগ্রহের জন্য তারা কয়েকজন স্টুডেন্ট পাঠিয়েছে, তারা কী বোঝে? দুই-একটা সুইচ নষ্ট পেয়েছে, বলে দিয়েছে ফিটিংস খারাপ।’
প্রকল্পটিতে অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান বলেন, ‘আমরা আইএমইডির প্রতিবেদনটি হাতে পেলে পড়ে সেখানে কোনো অনিয়ম পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। আমরা সব সময় আপ্রাণ চেষ্টা করছি প্রকল্পকে দুর্নীতি-অনিয়মের বাইরে রাখতে।’