- শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চতুর্থ গণহত্যার অভিযোগ দায়ের
- সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন
লণ্ডন, ২০ আগস্ট- কোটা সংস্কারের আন্দোলনে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে।
১৬ জুলাই আবু সাঈদ নিহত হওয়ার এক মাস পর রবিবার (১৮ আগস্ট) করা এই মামলায় সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চতুর্থ গণহত্যার অভিযোগ দায়ের
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পতন হওয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে এ পর্যন্ত চারটি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে এসব অভিযোগ দাখিল করা হচ্ছে।
সর্বশেষ ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে গুলি চালানোর ঘটনায় মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) গণহত্যার অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
আবেদনে আসামি হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, রাশেদ খান মেনন, সাবেক মেয়র ও সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক সংসদ সদস্য হাজী সেলিম, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, সাবেক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক ও বেনজীর আহমেদ, র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সদস্য মুনতাসীর মামুন ও তুরিন আফরোজ, গণজাগরণ মঞ্চের কথিত মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার, একাত্তর টিভির এমডি মোজাম্মেল হক বাবু, সময় টিভির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ জোবায়ের, এবি নিউজ টোয়েন্টি ফোর ডটকমের সম্পাদক সুভাষ সিংহ রায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ও দৈনিক আমাদের নতুন সময়ের সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান, বিজিবির সাবেক ডিজি ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি এম মনজুর আহমেদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে তৎকালীন কতিপয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও কতিপয় বিজিবি, র্যাব, পুলিশ সদস্য এবং তৎকালীন কয়েকটি ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার নীতিনির্ধারকেরা রয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অপরাধের ধরনে বলা হয়, হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনকারী নেতা-কর্মীদের সমূল বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে ১ থেকে ২৪ নম্বর আসামিদের নির্দেশে ও পরিকল্পনায় অন্য আসামিরা শহরব্যাপী ব্ল্যাক আউট করে টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করেন। এরপর আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা নির্বিচার গুলি করে হত্যার পর লাশ গুম করে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেন। হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মুফতি হারুন ইজাহার চৌধুরীর পক্ষে আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম এ অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার ধানমন্ডির কার্যালয়ে দাখিল করা হয়।
এ বিষয়ে এ সংক্রান্ত তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক আতাউর রহমান আজ সাংবাদিকদের জানান, কোর্ট রিফর্ম (সংস্কার) হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ওনাদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউটরের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির জন্য আবেদন করবো। প্রসিকিউশন টিমও রিফর্ম (সংস্কার) করতে হবে। জানা যায়, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে আলোচনায় এসেছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ ও নারী নীতির বিরোধিতা করাসহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে মাঠে নামে সংগঠনটি। সেই রাতে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বর ঘিরে তৈরি হয়েছিল এক ভীতিকর পরিবেশ। শেষ পর্যন্ত পুলিশ–র্যাব ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির অভিযানে খালি করা হয়েছিল শাপলা চত্বর। তখন মানবিধকার সংস্থা অধিকার শাপলা চত্তরে নিহতের সংখ্যা নিয়ে তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে।
সেখানে বলা হয়, শাপলা চত্বরে পুলিশের অভিযানে ৬১জন নিহত হয়েছে। এনিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে সরকারের তরফ থেকে। এরপর মামলা দায়ের করা হয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর দুই শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। প্রায় এক যুগ পর গত ১৯ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অধিকারের পেজে সেদিনের নিহতের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে ৬১ জনের নাম-পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে হেফাজত সংশ্লিষ্টদের দাবি, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা এর কয়েকগুণ বেশি। এবার প্রায় এক যুগ পর শাপলা চত্বরের ঘটনায় গণহত্যার অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে গতকাল অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
আইনজীবী গাজী তামিম সাংবাদিকদের জানান, তৎকালীন রেব, পুলিশ ও বিজিবির কিছু উর্ধতন কর্মকর্তার নির্দেশে ও সৈনিকের দ্বারা ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে গণহত্যা সংঘটিত হয়। এ মামলায় শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও তৎকালীন কয়েকজন মিডিয়ার নীতিনির্ধারককে আসামি করেছি। সেদিন রাতে ব্লাক আউট করে এবং মিডিয়াকে বন্ধ করে ও নিয়নন্ত্রণ করে এই গণহত্যা চালনো হয়। রাতের আধারে নিহতদের লাশ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফেলে দেওয়া হয় এবং মতিঝিল এলাকা পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলা হয়। এ ঘটনা নি:সন্দেহে মানবতা বিরোধী অপরাধ। আমাদের অভিযোগটি নথিভূক্ত করা হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই তদন্ত শুরু হবে।
এর আগে ঢাকার সাভারস্থ ডেইরি ফার্ম হাইস্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্র আরিফ আহমেদ সিয়াম আন্দোলনকারী ছাত্র হওয়ার কারণে আসামিদের নির্দেশে পুলিশ সদস্য কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনায় গত ১৪ আগস্ট সিয়ামের বাবা বুলবুল কবির শেখ হাসিনাসহ ৯য় জন এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ দাখিল করেন। এছাড়া নারায়নগঞ্জে নিহত মেহেদীর বাবা মো: সানাউল্লাহর পক্ষে গত ১৫ আগস্ট আরও একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়। এ দুটি অভিযোগে শেখ হাসিনা ছাড়া গণহত্যায় অভিযুক্ত করা হয়েছে—আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশিদ, সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন আর রশিদকে। এছাড়া আবেদনে অজ্ঞাতনামা হিসেবে তৎকালীন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি, কতিপয় অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য, কতিপয় অসাধু র্যাব কর্মকর্তা ও সদস্য এবং কতিপয় অজ্ঞাতনামা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, আন্দোলনে ১-৭ নং আসামির প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় অন্যান্য আসামিরা সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র জনতার উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। এতে ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাইদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। একই দিনে আরো পাঁচজনকে আসামি কতিপয় পুলিশ সদস্য ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৮ জুলাই ৪২ জন, ১৯ তারিখে ৮৬ জন, ২০ তারিখে ৩৮ জন, ২১ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ৪৫ জন, ৪ আগস্ট ১১৪ জন এবং ৫ আগস্ট ১০৮ জনসহ কমপক্ষে ৪৩৯ জন আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে আসামি পুলিশ/র্যাব সদস্য ও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা কর্তৃক গুলি করে ও কুপিয়ে গণহত্যা করা হয়। এরপর ৫ তারিখে ছাত্র জনতার অসহযোগ গণআন্দোলনের মুখে ১ নং আসামি শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে সামরিক হেলিকপ্টার যোগে পালিয়ে যায়। অন্যান্য আসামিদের মধ্যে অনেকেই আত্মগোপনে চলে যায়।’
এরপর গত ৪ আগস্ট মিরপুরের দেশ পলিটেকনিক কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র নিহত শাহরিয়ার হাসান আলভীর (১৫) বাবা মো. আবুল হাসান গত ১৯ আগস্ট গণহত্যার তৃতীয় অভিযোগটি দায়ের করেন। আবেদনে শেখ হাসিনা, ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জেপির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান নিখিলসহ ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও অঙ্গ সংগঠনসমূহ এবং অজ্ঞাত ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, গত ৩০ জুলাই আসামিরা আন্দোলন দমানো ও হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করার জন্য বৈঠকে বসে এবং সর্বসম্মতিক্রমে সব শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলন দমানোর জন্য সিদ্ধান্ত নেয়।
সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন
প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ ও জাল-জালিয়াতির অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সদ্য আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান খায়রুল হকের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করা হয়েছে।
রবিবার (১৮ আগস্ট) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিলরুবা আফরোজ তিথির আদালতে ইমরুল হাসান নামে এক আইনজীবী এই আবেদন করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি রেকর্ড শেষে আদেশের জন্য রেখেছেন। মামলার বাদী ইমরুল হাসান সুরমাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।