সমরেশ মজুমদারের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বাংলা সাহিত্যজগতে। বলাই যায়, একটা যুগের অবসান। বাংলা সাহিত্যের অপর মহীরূপ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ভেঙে পড়েছেন কাছের মানুষের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে।
তিনি জানান, ‘সমরেশ চলে যাওয়া মানে এখন বাংলা সাহিত্যে আর কে রইল?’ পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে লেখক বলেন, লেখক হিসাবে সমরেশ মজুমদারের যাত্রা শুরুর অনেক আগে থেকেই তাদের পরিচিতি।
তখন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কলকাতার এক বোর্ডিং হাউসে থাকতেন। ‘প্রাণচঞ্চল’ সমরেশের নাটকের প্রতি ভালোবাসা ছিল প্রবল। সেই নিয়ে শীর্ষেন্দুর কাছে ‘ঠাট্টা’ পাত্রও হয়েছেন কখনও কখনও।
‘মৃত্যু কী সহজ, কী নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়’, এমনটা লিখে গিয়েছেন সমরেশ মজুমদার।
এদিন সহজভাবে মৃত্যু তার দরজায় কড়া নেড়েছিল কিনা জানা নেই, তবে বাংলা সাহিত্যের জগতকে অনাথ করে চলে গেলে ‘কালবেলা’র স্রষ্টা।
কত বাঙালির কৈশোরজুড়ে রয়েছেন সমরেশ মজুমদার। কতজনের মনে কৈশোরে অর্জুন হওয়ার সুপ্ত বাসনা জেগেছে। অনিমেষ-মাধবীলতা চরিত্র শিহরণ জাগিয়েছে কত হৃদয়ে। আজ নিজের সৃষ্টিকে রেখে কালপুরুষের দেশে লীন হয়ে গেলেন স্রষ্ট।
১৯৪২ সালে উত্তরবঙ্গের গয়েরকাটায় জন্ম প্রয়াত কথা সাহিত্যিকের। প্রাথমিক শিক্ষা জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে। তাই তো আজীবন উত্তরবঙ্গের প্রতি আলাদা টান ছিল সমরেশ মজুমদারের।
আর জলপাইগুড়ির ছেলে হওয়ায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের আলাদা একটা আকর্ষণ ছিল প্রয়াত লেখকের ওপর। তিনি বলেন, ‘আমি শিলিগুড়ির, ও জলপাইগুড়ির। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছে। নাটক করতে করতেই হঠাৎ করে ও একটা ছোটগল্প লিখল দেশ পত্রিকায়।….তদূর সম্ভব ওর প্রথম উপন্যাস ছিল দৌড়। আমি বরাবর ওকে বাবলু বলে ডাকতাম। ও বলত, তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে বাবলু বলে ডাকার নেই।’
সমরেশ মজুমদারের জনপ্রিয়তা দেখে অনেক সময়ই ঈর্ষা হত শীর্ষেন্দুর, প্রকাশ্যে সে কথা জানিয়েও ছিলেন অনুজ লেখককে। বরাবর সে-সব কথা হেসে উড়িয়ে দিতেন সমরেশ মজুমদার।
সাহিত্য অকাডেমি পুরস্কার জয়ী সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার গত ২৫শে এপ্রিল থেকে ভর্তি ছিলেন অ্যাপেলো হাসপাতালে। এরপর শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা বাড়তে থাকে, দীর্ঘদিন ধরেই সিওপিডির (ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ) সমস্যা ছিল তার।
তবে ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছিলেন, কিন্তু সোমবার বিকাল ৫টার পর ফের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় সমরেশ মজুমদারের। শেষরক্ষা হল না। এদিন ৫.৪৫ মিনিটে কালপুরুষের জগতে বিলীন হয়ে গেলেন ‘কালবেলা’র স্রষ্টা।
চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষেররা তার কলমে উঠে এসেছে। গোয়েন্দা চরিত্র অর্জুন তার সৃষ্টি। ‘উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ’ বাংলা সাহিত্য জগতের অনন্য সম্পদ। এর বাইরেও ‘সাতকাহন’, ‘তেরো পার্বণ’, ‘স্বপ্নের বাজার’-এর মতো উপন্যাস তার অনন্যা সৃষ্টি। তার মৃত্যু নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যজগত ও সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে এক অপূরণনীয় ক্ষতি।