- ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর
- ছাত্র হত্যার হোতা শতাধিক পুলিশ
লণ্ডন, ৪ সেপ্টেম্বর- রাজধানী ঢাকা থেকে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহিদুল হক ও আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, দিবাগত রাত ১২টার দিকে সাবেক এই দুই আইজিপিকে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সাবেক আইজি শহিদুল হককে উত্তরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেফতার করা হয় কচুক্ষেত এলাকা থেকে।
গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান (অতিরিক্ত কমিশনার) রেজাউল করিম মল্লিক। তিনি বলেন, সাবেক আইজিপি শহিদুল হক ও আবদুল্লাহ আল মামুন ডিবি হেফাজতে রয়েছেন। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার মিছিলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মুদি দোকানি আবু সায়েদকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আবদুল্লাহ আল মামুনের ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) তাকে সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে আদালতে আনা হয়। এসময় মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাকে দশ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আক্তারুজ্জামান এ আদেশ দেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার মিছিলে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহীদুল হকের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) তাকে সকাল ৬ টা ৪৫ মিনিটে আদালতে আনা হয়। এসময় মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাকে দশ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আক্তারুজ্জামান এ আদেশ দেন।
উল্লেখ্য, এ কে এম শহীদুল হক ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এবং চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। সাবেক এই দুই আইজির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র হত্যার অভিযোগে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ আছে গণহত্যারও।
ছাত্র হত্যার হোতা শতাধিক পুলিশ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। এসব গুলির ঘটনায় শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। আন্দোলনে গুলি চালিয়ে লাশ ফেলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছেন শতাধিক পুলিশ সদস্য।
আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞে সরাসরি অংশ নেওয়া ও নেতৃত্বদানকারী ৯৫ জন পুলিশ সদস্যের নামে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় ২৮৪টি মামলা করা হয়েছে। গত ১৩ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত এসব মামলা করা হয়। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানায় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ৯১টি। সম্প্রতি কয়েকজন মাস্টারমাইন্ড পুলিশ সদস্যকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৮টি মামলা হয়েছে ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশিদের নামে। এর পরের অবস্থানে রয়েছেন পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তাঁর নামে মামলা হয়েছে ৩৬টি। সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নামে মামলা হয়েছে ৩৩টি, ডিএমপি যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের নামে ২৭টি, স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান মনিরুল ইসলামের নামে ১১টি, ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইকবাল হোসাইনের নামে আটটি মামলা হয়েছে।
এই ছয়জন হাই প্রফাইল পুলিশ সদস্যের মতো আরো শতাধিক পুলিশ সদস্য সরকারের কাছ থেকে আন্দোলন দমাতে যে মাত্রার নির্দেশনা পেয়েছেন প্রয়োগ করেছেন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। এ পর্যন্ত এ ধরনের ৯৫ জন পুলিশ সদস্যের নামে মামলা হলেও আরো বেশ কিছু পুলিশ সদস্যের নামে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকা ও মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করার দায়ে মামলা প্রক্রিয়াধীন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট বিকেলেও রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, গাজীপুর জেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় বেপরোয়া পুলিশ সদস্যদের নেতৃত্বে নির্বিচারে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনা সরকার দফায় দফায় ইন্টারেট বন্ধ করে, যাতে ওই সময়ে পুলিশ সদস্যদের বেপরোয়া তাণ্ডব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ না পায়। কিন্তু সম্প্রতি পর্যায়ক্রমে সেসব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে শুরু করেছে। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কিছু মামলার এজাহার এবং ওই সময়ের ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশের তাণ্ডবের বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকার নিজেদের হত্যা, গুম ও দুর্নীতি আড়াল করতে পুলিশ বাহিনীকে যততত্র ব্যবহার করেছে। এই সুযোগে কিছু পুলিশ সদস্য নিজের স্বার্থসিদ্ধি, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন, পদ-পদবির লোভে প্রায় সব ধরনের অপরাধ কর্মে জড়িয়েছে। ফলে সরকার পতনের পর ওই সব পুলিশ সদস্য অসংখ্য মামলার আসামি হচ্ছেন। অনেকে পলাতক, আবার কেউ কেউ হারিয়েছেন চাকরি।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ সায়েন্স অ্যান্ড ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ খুবই নৃশংসতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। যেভাবে গুলি করে মানুষ মারা হয়েছে, এ ধরনের কাজ পুলিশের কাছ থেকে কখনো আশা করা যায় না। এসব নেতিবাচক ভূমিকার কারণে পুরো বাহিনী ইমেজ সংকটে পড়েছে। এই বাহিনীটিকে ফের দাঁড় করানো অনেক সময়ের ব্যাপার। এসব হত্যাকাণ্ডে বিপত্গামী যেসব পুলিশ সদস্য জড়িত তাঁদের শনাক্ত করে ফৌজদারি আইনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশ কোনো সরকারের জন্য না, পুলিশ রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য, এটা উপলব্ধি করতে হবে। উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে আইনগত প্রক্রিয়াগুলো যদি অনুসরণ করা যায় তাহলে জনগণের মাঝে পুলিশ নিয়ে স্বস্তি ফিরবে। এসব কারণে পুলিশে মৌলিক সংস্কার এখন সময়ের দাবি।