ঢাকা, ১৪ আগস্ট- পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন তার বেসরকারি খাতবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান পরিচিত ছিলেন দরবেশ বাবা নামে। হাঁটু অব্দি নামানো দীর্ঘ পাঞ্জাবী-পায়জামা পরা শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত এই ব্যক্তিটিকে প্রথম দর্শনে দেখে বোঝার উপায় ছিলোনা যে এই চেহারার অন্তরালে রয়েছেন, একজন প্রবল পরাক্রমশালী মাফিয়া, অলিগার্ক ব্যবসায়ী। এই মানুষটি বিগত পনের বছর বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সমাজের কাছে ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্কও! সর্বশেষ গণভবনে ব্যবসায়ীদের জোরপূর্বক নিয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর পাশে আছি’ বলে বক্তব্য রাখানোর অভিযোগ উঠেছে। আর এর আগে নানান আর্থিক লুটপাট অপরাধে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শিরোমনি! আওয়ামী লীগের ক্ষমতা আরোহনের আগে জেলও খেটেছেন তিনি।
তবে এবার আর রক্ষা হলো না কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের অন্যতম ক্ষমতাধর এই ব্যক্তির। ক্ষমতার পটপরিবর্তন হওয়ার পর নিজের আলঙ্কারিক শ্বেত শুভ্র দাড়িও তিনি ফেলে দিয়ে লুঙ্গি-গেঞ্জি পড়ে মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) নৌপথে পালানোর সময় রাজধানীর সদরঘাট এলাকায় পুলিশের হাতে হয়েছেন গ্রেপ্তার। মূলত ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সালমান এফ রহমান। শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যবসায়ী নেতার পর ২০১৮ সালে এমপি ও টানা দুইবার প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হন। কিন্তু অপরাধ আর জালিয়াতিতে তিনি হাত পাকিয়েছেন আরও আগে। সূত্র জানায়, সালমান এফ রহমানের বিভিন্ন অপকর্মের মধ্যে জমি জালিয়াতি অন্যতম। ঢাকার কালিয়াকৈরে সাধারণ মানুষের প্রায় ২৪১ একর জমির জাল দলিল করার মতো প্রতারণার সাথে তিনি জড়িত বলে অভিযোগ আছে।
২০০০ সালের দিকে বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজম্যান্ট লি. এসব জমির ভুয়া দলিল নিয়ে আইএফআইসি ব্যাংকে গিয়েছিল, বড় অঙ্কের ঋণের জন্য। ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পরবর্তীতে এসব জমির ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারেন— জমিগুলো আসলে ক্রয়ই হয়নি। জমির মালিকরা আতঙ্কিত হয়ে গাজীপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসকের শরণাপন্ন হলেও তিনি তাদের সাহায্য করেননি।
এরপর তারা তৎকালীন ইউএনওর কাছে গেলে তিনি তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ব্যক্তিগতভাবে ইউএনও খোঁজ-খবর নিয়ে নিশ্চিত হন যে, প্রকৃত মালিকরা বেক্সিমকোর কাছে জমি রেজিস্ট্রি করে দেননি। বরং রেজিস্ট্রি অফিসে ভুয়া মালিক সাজিয়ে এসব দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। এরপর ইউএনও লিখিতভাবে বেক্সিমকো প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজম্যান্ট লি. কে নোটিশ পাঠান। এই সময় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি ওই ইউএনওকে নানা লোভ এবং ভয়ভীতি দেখিয়েও ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে ইউএনও নিজে বাদি হয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। এই জমি জালিয়াতির সাথে সালমান এফ রহমান সরাসরি জড়িত দাবি করে তিনি আর্জির সঙ্গে ১০৮ পৃষ্ঠার তথ্যপ্রমাণও জুড়ে দেন। তবে সালমান বা তার প্রতিষ্ঠানের কিছুই হয়নি বরং শেষ পর্যন্ত বদলি হন সেই ইউএনও।
২০০৬-০৭ সালের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী একটি টাস্কফোর্স করা হয়েছিল। টাস্কফোর্স বিভিন্ন দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে তথ্য বের করেন যে, ১২২ জন রাজনৈতিক নেতা ও আমলা দুর্নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে ৪৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ মোট ১৭টি দেশে এসব অর্থ পাচার করা হয়েছে। পাচার হওয়া ৪৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এক হাজার কোটি টাকা সালমান এফ রহমানের। আমেরিকায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসার নামে এসব টাকা পাচার করা হয়েছে।
২০০৬-২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও ঋণখেলাপিসহ নানা অভিযোগে জেলে গিয়েছিলেন সালমান এফ রহমান। এরপর বের হয়ে নাম জড়ান ২০১০-১১ সালের শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিতে। এতকিছুর পরও তাকে স্পর্শ করার সাহস হয়নি কারও। হাজারো ব্যবসায়ীকে পথে বসানো শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির এক অবিচ্ছেদ্য নাম সালমান এফ রহমান। ২০১০-১১ সালে শেয়ার বাজার ধসের পর এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। রিপোর্টে তিনি সালমান এফ রহমান থেকে পুজিবাজারকে সতর্ক রাখার পরামর্শ দেন।
রিপোর্টে পুঁজিবাজারে ফিক্সড প্রাইস, বুক-বিল্ডিং, রাইট শেয়ার, ডিরেক্ট লিস্টিং, সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন, প্রেফারেন্স শেয়ারসহ সকল ক্ষেত্রেই অনিয়ম হয়েছে এবং এর সাথে সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। এ ছাড়া, তিনি বিভিন্ন কোম্পানির প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রমাণ পায় কমিটি। অথচ এসব অনিয়মের সঙ্গে সালমান এফ রহমানসহ আরও কয়েকজনের নাম জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তবে একসময় সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপটি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপ হিসেবে পরিচিত ছিল। বেক্সিমকো ফার্মা এদেশের ওষুধ শিল্পে অন্যতম একটি স্থান দখল করেছিল। সেই সময় তাকে অনেকটা পরিচ্ছন্ন ব্যবসায়ী হিসেবেই চিহ্নিত করা হতো। কিন্তু যতই দিন গেছে একের পর এক তিনি জড়িয়ে পড়েছেন বিতর্কিত সব ঘটনায়। আরও সম্পদ বাড়িয়ে তোলার নেশায় পা বাড়িয়েছেন ঋণ খেলাপ, জমি জালিয়াতি এবং শেয়ার কেলেঙ্কারি ও প্রতারণার মত অনৈতিক পথে। আর এসবের মাধ্যমে মানুষের অশ্রু আর দীর্ঘশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। এসব কারণে অনেককে এমনও বলতে শোনা যায়, একজন মানুষের আর কতটা সম্পদ অর্জিত হলে তিনি অবৈধ পথে এরকম অর্থ উপার্জন বন্ধ করবেন?
বাংলাদেশ এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট কোম্পানি বা বেক্সিমকো তাদের যাত্রা শুরু করেছিলো ১৯৭২ সালে। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বেক্সিমকো উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ শুরু করে। আশির দশকে ওষুধ শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগ হবার পরে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসে বিনিয়োগ করে। এরপর আসে টেক্সটাইলসের খাতে বিনিয়োগ। এখন বেক্সিমকো বিমান পরিবহন খাতকেও তাদের কোর বিজনেস-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু ৯০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের পাশাপাশি সালমান এফ রহমান ঢুকে পড়েন রাজনীতিতে। প্রথমে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আন্দোলন নামে একটি দল গঠন করেন। পরে যোগ দেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে। রাজনীতিতে যোগ দেবার ফলে প্রথমদিকে তার ব্যবসা-বাণিজ্যের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করা হয়। বিশেষত ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বেক্সিমকোকে বেশ খারাপ সময় পার করতে হয়। আর ২০০৭-২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাকে প্রায় দুইবছর জেলে থাকতে হয়েছে। কিন্তু এর পরপরই তিনি এসব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় বসার পর কেবলই তরতর করে এগিয়ে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি শেয়ারবাজারে বিশাল অংকের অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে তিনি বিপুল সম্পদের অধিকারী হন। এর ফলে ২০০১ থেকে দীর্ঘদিন যে আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে চলছিলেন তা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসেন।
১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির এক অবিচ্ছেদ্য নামও এই সালমান এফ রহমান। সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের জন্য তো বটেই ঘটনা প্রবাহে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার আগের দফায় ক্ষমতায় আসার চার মাসের মধ্যেই যে বড় শেয়ার কেলেঙ্কারির জন্ম দেয়, তার সাথেও ছিল সালমান এফ রহমানের সরাসরি যোগাযোগ। তখনও কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ। ওই ঘটনায় ১৫টি প্রতিষ্ঠান ও ৩৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিলো। কিন্তু এই ঘটনার অন্যতম অংশীদার বেক্সিমকো ও শাইনপুকুরের বিরুদ্ধে মামলার কোনো অভিযোগই গঠন করা সম্ভব হয়নি। মামলা করার পরের দিনই প্রতিষ্ঠান দুইটির ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান। উচ্চ আদালত থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠন করা যাবে না বলে জানানো হয়। পরে আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে এসইসি। কিন্তু তারপরও আজ পর্যন্তওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।