আশরাফুল ইসলাম রানা: ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর মামলা গ্রহণ না করা প্রসঙ্গে আদালতের দেওয়া পরামর্শ দেশব্যাপী ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। নিম্ন আদালতের মন্তব্য উচ্চ আদালতের রুলস উপেক্ষা করেছে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। আগামীকাল রবিবার বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে এনে প্রতিকার চাইবেন বলে জানিয়েছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না। আর মানবাধিকারকর্মী, রাজনীতিবিদ ও সমাজের নানা স্তরের মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন রেইনট্রি হোটেলের ধর্ষণ মামলার রায়ে নারী জাতিকে অপমান করা হয়েছে। এই রায়ের প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার দিনভর নানা মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা।
২০১৭ সালে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুজন শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ঘটনাটি সে সময় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। ওই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদের নাম আসে। পরে ওই দুই শিক্ষার্থী বাদী হয়ে ধর্ষণের মামলা করেন।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, জন্মদিনের পার্টির কথা বলে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই তরুণীকে ধর্ষণ করেন সাফাত ও তার বন্ধু নাঈম। গত বৃহস্পতিবার ছিল এই মামলার রায়ের দিন। রায়ে পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দিয়ে ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছাম্মাৎ কামরুন্নাহার তার পর্যবেক্ষণে যেসব মন্তব্য করেছেন সেটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিচারক বলেন, মামলাটির তদন্ত প্রক্রিয়ায় পুলিশের গাফিলতি ছিল। রাষ্ট্রপক্ষ তেমন সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। তিনি বলেন, মামলার দুই ভিকটিম বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভিকটিম দুজন আগে থেকেই সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত, হাসপাতাল রিপোর্ট তাই বলে। অহেতুক তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন। এতে আদালতের ৯৪ কার্যদিবস নষ্ট হয়েছে। এরপর থেকে পুলিশকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। এছাড়া এখন থেকে ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর যদি কেউ মামলা করতে যায়, তা না নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। দুজনের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক হলে সেটি ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আদালতের এই পর্যবেক্ষণের খবর গণমাধ্যমে আসার পর থেকে নানা স্তরের মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। সেদিন সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে প্রতিবাদ জানায় বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন। তারা ‘৭২ ঘণ্টা পার হলে ধর্ষণ ন্যায্য?,’ ‘চরিত্রের প্রশ্নে বিচারহীন, আর কতদিন’, ‘চলন-বলন-পোশাক রাখো, রাষ্ট্র এবার দায় নাও’, ‘পুরুষের ক্ষমতা, ভেঙে হোক সমতা’, ‘পথে-ঘাটে দিনে-রাতে, চলতে চাই নিরাপদে’ এ রকম নানান প্ল্যাকার্ড আর সেøাগানে শাহবাগ মোড় মুখর করে তোলেন।
এ সময় আইনজীবী ফারাহ হোসেন বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ১৮৭২ সালে প্রণীত সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছি। আজ (বৃহস্পতিবার) একটি মামলার রায়ে দেখা গেল, যে নারীরা বিচার চাইতে এসেছেন, তাদের বিচার না দিয়ে বরং তাদের চরিত্র নিয়ে কথা বলা হলো। বলা হলো যে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে না হলে তার মামলা নেওয়া হবে না। এটি অত্যন্ত নিন্দনীয়।
এর আগে রায়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল বলেন, এ ধরনের পরামর্শ ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল যারা নির্যাতনের শিকার হন, তারা যেন বিচার পান সেই পথ যত সুগম হয়, সেই ব্যবস্থা করা। সেখানে যদি ভিকটিমের বিপরীতে যায়, এমন কোনো পরামর্শ আসে, তখন হতাশ লাগে। তিনি বলেন, ধর্ষণের পর ৭২ ঘণ্টার মেডিকেল পরীক্ষা এখন একমাত্র উপায় নয়, ডিএনএ টেস্টের সুযোগ আছে। সাক্ষী পাওয়া না যাওয়ার কথা বলা হয়, সেটিও যাতে অন্য প্রক্রিয়ায় করা যায় সেসব নিয়ে না ভেবে মামলা না নেওয়ার পরামর্শ কতটা যৌক্তিক ভেবে দেখার বিষয়।
গতকাল শুক্রবারও বিভিন্ন সংগঠন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এর প্রতিবাদ জানান। গতকাল শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমি এই রায়ের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি, হতাশ হয়েছি, ক্ষুব্ধ হয়েছি। আমরা এটা মেনে নিতে পারি না। রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ে গোটা নারী জাতিকে অপমান করা হয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যায় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না দেশ রূপান্তরকে বলেন, রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ের আদালত যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে সেটি উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপন্থী। রায়ের পর্যবেক্ষণগুলো হাইকোর্টের নজরে এনে প্রতিকার চাইবেন বলে জানান তিনি। জেড আই খান বলেন, ‘আমি নিজেই রবিবার হাইকোর্টে যাব। বিষয়টি উপস্থাপন করব। মূলত ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টার কথা যে বলেছেন তিনি (বিচারক) এটা কোন আইনে। এ বিষয়ে তো তার এখতিয়ার নেই। পুলিশ কেন মামলা নেবে না? দেখা গেল কাউকে ধর্ষণ করে ৭২ ঘণ্টা আটকে রাখা হলো। তাহলে ডশ ভুক্তভোগী মামলা করতে পারবেন না। অধস্তন আদালতের একজন বিচারক তো এই ধরনের কোনো নির্দেশনা বা মতামত দিতে পারেন না।’
তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের মামলা গ্রহণ করা নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এই নির্দেশনা তো বিচারক অবজ্ঞা করতে পারেন না। সংবিধান অনুযায়ী উচ্চ আদালতের কোনো নির্দেশনা অধস্তন আদালত মানতে বাধ্য।’
জেড আই খান পান্না বলেন, ‘রায়ে দুই তরুণীর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে বিচারক যে কথা বলেছেন সেটা আপত্তিকর। তাহলে কি একজন বিবাহিত নারী ধর্ষণের শিকার হলে তিনি প্রতিকার পাবেন না। এটার সঙ্গে সেক্সুয়াল অভ্যস্থতার সম্পর্ক কী? বিবাহিত নারীরা কি ধর্ষণের শিকার হয় না।’
‘উই ক্যান’-এর সমন্বয়ক জিনাত আরা হক তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমাদের দেশে এই আইনটি অনেক পুরনো এবং নারীকে বিচারটি পাওয়ানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রে উপযোগী নয়। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের আদেশ বিচার না পাওয়াকে আরও নিশ্চিত করবে। যেহেতু সাক্ষী পাওয়া যায় না, নানা দিক বিবেচনায় প্রক্রিয়াটা বিচারবান্ধব করতে হবে। এখানে কোনো অভিমান বা রাগের জায়গা নাই। যে দোষী তার বিচার হতে হবে। যে ভিকটিম সে বিচার পাবে। সেটা নিশ্চিত করতে হলে ঠাণ্ডা মাথায় বুদ্ধির সঙ্গে আইনি সিস্টেম দাঁড় করাতে হবে। বাইরের দেশগুলো সাত দিন পর্যন্ত মামলা-অভিযোগ নেয়। সেখানে ৭২ ঘণ্টা বেঁধে দেওয়ার যুক্তি ঠিক বোধগম্য নয়।’
ব্যারিস্টার মিতি সানজানা বলেন, ‘ভিকটিম মানসিকভাবে স্থিতিশীল হতেও অনেক সময় ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে যেতে পারে। এই সুপারিশ ভিকটিমের জন্য ন্যায়বিচার পেতে সহায়ক হবে না। এমনিতে ভিকটিম ও পরিবার মামলা করতে ভয় পায়। সেখানে বাধানিষেধ জুড়ে দিলে কেউ এগিয়ে আসবে না।’ তিনি প্রশ্ন করেন, ধর্ষণের পর ভিকটিমকে যদি ৭২ ঘণ্টা আটকে রাখে তাহলে কী হবে?