ভোটের আগে বিএনপিকে আর কোথাও কোনো ধরনের ছাড় দিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। রোববার থেকে শুরু হতে যাওয়া ৪৮ ঘণ্টার অবরোধসহ বিএনপির সামনের সব কর্মসূচি মোকাবিলায় পালটা প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে থাকবে ক্ষমতাসীনরাও। আন্দোলনের নামে বিএনপি যদি কোনো ধরনের সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে তা কঠোরভাবে প্রতিহত করার পরিকল্পনাও রয়েছে দলটির।
দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা পালটা আঘাতের হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তারা বিএনপিকে ছাড় না দেওয়ার বার্তা স্পষ্ট করেছেন। একই সঙ্গে বিএনপি ও তাদের মিত্রদের হুমকিও আমলে নিচ্ছেন না ক্ষমতাসীনরা। দলটির নেতারা বলছেন, যথাসময়েই নির্বাচন হবে। এক্ষেত্রেও সংবিধানের বিদ্যমান ধারার বাইরে গিয়ে কোনো ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ। এমনকি এ ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে আর কোনো ধরনের আলোচনায় বসতেও রাজি নয় দলটির হাইকমান্ড।
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও একাধিকবার এ বিষয়ে নিজের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। সর্বশেষ মঙ্গলবার বিকালে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন-খুনিদের সঙ্গে কিসের সংলাপ? তিনি বলেছেন, সময়মতোই নির্বাচন হবে। কে চোখ রাঙাল আর কে চোখ বাঁকাল, তা নিয়ে পরোয়া করি না। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও একই ধরনের অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও এক অনুষ্ঠানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, বিএনপি এরই মধ্যে নিজেদের সন্ত্রাসী দল হিসাবে প্রমাণ করেছে। এমন একটি সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে না। এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমিও বলছি।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, আমাদের দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমাদের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইতোমধ্যেই স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন-সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয় না। বিএনপি যে সন্ত্রাসী দল সেটা তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছে। কানাডার আদালতও সেটা বলেছে। তিনি আরও বলেন, ২৮ তারিখের কর্মসূচি ঘিরে তাদের নৈরাজ্য এবং এরপর হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তারা সেটা আবারও প্রমাণ করেছে। তাই তাদের সঙ্গে বসার তো আর কোনো অবকাশ নেই। আমাদের নেত্রী দলের নেতাকর্মীদেরও তাদের এসব কর্মসূচির বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, বিএনপি যেটা করছে, তা আন্দোলন নয়। তারা রাস্তায় আগুন দিয়ে গাড়ি পোড়াচ্ছে, জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করছে। এগুলোকে তো আন্দোলন বা রাজনৈতিক কর্মসূচি বলা যায় না। এগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে, তারা এগুলো কঠোরভাবে দমন করবে। সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। আলোচনা বিষয়ে তিনি বলেন, কার সঙ্গে আলোচনা হবে? যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বা সন্ত্রাসী দল তাদের সঙ্গে কিসের আলোচনা? সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়।
গত বছরের ডিসেম্বরের পর থেকে বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচির দিনে ‘শান্তি সমাবেশ’ কর্মসূচি পালন করেছে আওয়ামী লীগ। একই দিনে কর্মসূচি পালন করলেও এতদিন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নেতাকর্মীদের কোনো ধরনের সহিংসতায় না জড়ানোর কঠোর নির্দেশনা ছিল। তবে গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ ঘিরে সৃষ্ট অস্থিরতা এবং এরপর বিএনপির হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচির ঘিরে পালটা কর্মসূচি দেয় আওয়ামী লীগও। তবে এসব কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের কঠোর অবস্থান দেখা গেছে। প্রায় প্রতিটি মিছিল সমাবেশে বাঁশের লাঠি, স্টাম্প, হকিস্টিক নিয়ে শোডাউন দিতে দেখা গেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের।
দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারাও আগের চেয়ে কঠোর ভাষায় কথা বলছেন।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবরের পর বিএনপি হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিতে চলে গেছে। আগামীকাল রোববার ও সোমবার ফের টানা অবরোধ ডেকেছে দলটি। চলতি মাসের মাঝামাঝিতে তফশিল ঘোষণা করা হবে। এরপর নির্বাচন। ফলে এখন আর কোনোভাবেই রাজপথের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া করতে চায় না ক্ষমতাসীনরা।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের রাজনীতির মাঠ পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। ফলে সামনের দিনের প্রতিটি কর্মসূচির দিনেও নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এজন্য ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি কর্মসূচিতে ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি থাকবে।
ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে আলাদা দৃষ্টি রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মূলত বিএনপি বড় ধরনের অঘটন ঘটাতে পারে এমন শঙ্কা থেকেই প্রস্তুতি রাখছে দলটি। কর্মসূচি ঘিরে যদি কেউ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টির চেষ্টা করে- তাহলে পালটা জবাব দেওয়ার পরিকল্পনাও আছে তাদের। তবে অকারণে বিএনপির সঙ্গে বিশৃঙ্খলাতে না জড়ানোর নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে হাইকমান্ড থেকে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের কঠোর ভূমিকায় দেখতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
অন্যদিকে বিগত দুটি নির্বাচনে বিএনপিকে ভোটে আনতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীনরা বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে একাধিক প্রস্তাব দিয়েছিল। ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে ফোন করে তার বাসভবন গণভবনে এসে আলোচনার আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। সেই নির্বাচনের আগে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছিল, সেই সরকারে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বিএনপিকে দেওয়ার কথা বলেছিল আওয়ামী লীগ।
২০১৮ সালে বিএনপি ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করেছিল। একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর ডাকা সংলাপে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে অংশ নিয়েছিল বিএনপিও। নির্বাচনেও গিয়েছিল তারা। কিন্তু এবার আর কোনো ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা বলছেন, যথাসময়েই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এক্ষেত্রে সংবিধানের বিদ্যমান ধারার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে এলে তাদের স্বাগত জানানো হবে। কিন্তু কাউকে নির্বাচনে আনতে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না। উলটো নির্বাচন বানচালের চেষ্টা চালানো হলে তা কঠোর হাতে প্রতিহত করা হবে।