বাংলাদেশে নির্বাচন এলেই নানা রকম জোট গড়ে উঠে। কিন্তু নির্বাচন চলে গেলেই এই জোটগুলোর আর কার্যকারিতা থাকে না। গত দেড় বছরে বাংলাদেশের যে জোটগুলোর নির্বাচনের আগে গড়ে উঠেছিল সেগুলো মৃত প্রায়। ক্ষমতাসীন দলের জোট বা বিরোধী দলের জোট, কোন জোটেরই কার্যকারিতা নেই, কোথাও তাদের কর্মতৎপরতার কথাও শোনা যায়না। বাংলাদেশে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল গুলো নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কৌশল হিসেবে জোট গঠন করে এবং এই জোট গঠনের সংস্কৃতির মাধ্যমে তাদের মূল নজর থাকে ভোটারদের আকর্ষণ করার জন্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রধান দল গুলো ছাড়া জোটের অন্যান্য শরিকদের তেমন কোন জনভিত্তি নেই। তারপরও তারা জোট করেন জনগণকে দেখানোর জন্য যে, তারা একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে জনগণের কাছে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুটি জোট রয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নির্বাচনী জোটের নাম মহাজোট। এই মহাজোটে যেমন ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা আছে, আছে জাতীয় পার্টি এবং বিকল্প ধারার মত রাজনৈতিক দলগুলো। আর এই জোটটি গত নির্বাচনে অংশগ্রহন করে কিন্তু চতুর্থাংশের বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু বিজয়ী হওয়ার পর আর মহাজোটের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। গত দেড় বছরে মহাজোটের কোন আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে বলেও কোন খবর প্রকাশিত হয়নি। কাজেই এই জোটটি আছে না নেই এই নিয়ে এখন প্রশ্ন।
যদিও জাতীয় পার্টি বা আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন যে, মহাজোট নির্বাচনী জোট এবং এই জোট আছে। মহাজোট গতবার নির্বাচন করলেও জাতীয় পার্টি এখন বিরোধী দলের বেঞ্চে বসে এবং তারাই দেশের প্রধান বিরোধী দল। আওয়ামী লীগের আরেকটি জোট রয়েছে সেই জোটকে আওয়ামী লীগ বলে আদর্শিক জোট। এই জোটটি হল ১৪ দলীয় জোট। ১৪ দলীয় জোটটি মোহাম্মাদ নাসিম যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন কিছু না কিছু কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছিল এবং বিভিন্ন ইস্যুতে ১৪ দলের বৈঠক হতো এবং বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের অবস্থান প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি ব্যক্ত করতেন। কিন্তু মোহাম্মাদ নাসিমের মৃত্যুর পর ১৪ দলের সমন্বয় করা হয় আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা আমির হোসেন আমুকে। আমির হোসেন আমু দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত ১৪ দলের আনুষ্ঠানিক বৈঠকের তেমন কোন খবর পাওয়া যায়নি। ১৪ দলের একজন নেতা বলেছেন, করোনা পরিস্থিতির কারনে এখন সামাজিক দূরত্ব স্বাস্থ্যবিধি ইত্যাদি বাস্তবতায় জোটের বৈঠক হচ্ছে না কিন্তু এই সময় আওয়ামী লীগ তার নিয়মিত সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তাছাড়া জুম বা টেলি আলাপের মাধ্যমে এ ধরণের বৈঠকগুলো করা যায় বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু বাস্তবতা হল যে ১৪ দলের কোন কার্যক্রম নেই। বিভিন্ন ইস্যুতে ১৪ দলের অবস্থান ভূমিকা কি তা জোটবদ্ধ ভাবে প্রকাশেরও তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যায়না যা কিছুদিন আগেও দেখা যেত।
বিএনপির নেতৃত্বেও এই রকম দুটি জোট রয়েছে। বিএনপির নির্বাচনী জোটের নাম ঐক্যফ্রন্ট, যদিও এই ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন তিনি বিএনপির কেউ নন। গত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দাওয়ার তীব্র মনবাঞ্চনা থেকে এই জোট গঠিত হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের ওই ভরাডুবির পর এই জোট নিয়ে বিএনপির মধ্যে এক টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির অধিকাংশ নেতা ও কর্মীরাই মনে করেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দিকে যাওয়া এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল। নির্বাচনের পর ঐক্যফ্রন্টের কিছু বৈঠক হলেও সেই বৈঠকে বিএনপির খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি, এখন দীর্ঘদিন ধরে ওই জোটের কোন বৈঠক হয়নি। সাম্প্রতিক সময় বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে কিছু সমালোচনা করেছেন বলে গনমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। ঈদে যখন তিনি স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেন সে সময় তিনি ঐক্যফ্রন্টের সমালোচনা করেছিলেন বলে কোন কোন পত্রিকায় খবর প্রকাশ করেছিল। যদিও বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওই খবরগুলোকে অসত্য বলে চিহ্নিত করেছেন। সত্য হোক অসত্য হোক, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এখন মৃত প্রায়। আওয়ামী লীগের মত বিএনপির একটি আদর্শিক জোট আছে, যে জোটে হলো ২০ দলীয় জোট, যে জোটে জামাতসহ ইসলামপছন্দ রাজনৈতিক দলগুলো আছে। নির্বাচনের পর পরই ওই জোট থেকে বেরিয়ে যায় আন্দালিব রহমান পার্থর নেতৃত্বাধীন বিজেপি। এই জোটটিও এখন অকার্যকর, দীর্ঘদিন ধরে জোটের কোন বৈঠক হয়না। তাছাড়া জামাতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আপত্তি রয়েছে। আর এই আপত্তির কারনে বিএনপি এখন প্রকাশ্যে এই জোটের বৈঠক ডাকতে ভয় পায়। কিন্তু বিএনপির নেত্রীবৃন্দ প্রকাশ্যেই বলেন ২০ দলীয় জোট আছে থাকবে, কিন্তু ২০ দলের মধ্যেই এখন এই জোটে থাকা নিয়ে অনেকের আগ্রহ নেই। বিএনপি এই জোটকে শুধু ব্যবহার করে নিজেদের উদ্দেশ্যে। বিএনপি এই জোটের অন্যান্য শরিকদের মূল্যায়ন করেনা এই রকম অভিযোগ জোটের পক্ষ থেকে হরহামেশাই ওঠে।
বাংলাদেশে নির্বাচন এলেই যেমনভাবে জোটের রাজনীতি নিয়ে উত্তাপ তৈরি হয়, ঠিক তেমনি নির্বাচন চলে গেলে জোটের রাজনীতি আইসোলেশনে চলে যায়। এখনো জোটের রাজনীতি তেমনি আইসোলেশনেই গেছে। আবার হয়ত যখন নির্বাচন হবে তখন আবার হয়ত নতুন মেরুকরণে নতুন নতুন জোট গঠিত হবে। উৎসঃ বাংলা ইনসাইডার