সাধারণ ভাবে বলা হয় যে আওয়ামী লীগ ভারতপন্থী একটি রাজনৈতিক দল। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক বাস্তবতায় ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ভিন্নরকম। শুধু কংগ্রেস নয়, ভারতে যখন যে দলই আসে না কেন তারা আওয়ামী লীগকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করে। তার চেয়েও বড় কথা হলো আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে ভারত আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে দেখে না, দেখে হলো বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসেবে। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতিতে এটাই বাস্তবতা যে শুধু ভারতমুখী কূটনীতি করে একটি রাজনৈতিক দল টিকতে পারে না। আর এ কারণে আওয়ামী লীগ পঁচাত্তরের পর তার কূটনৈতিক মেরুকরণ পরিবর্তন করেছে। আওয়ামী লীগ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক রেখে চলেছে তেমনি গত এক যুগে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগকে আমন্ত্রণ জানায় তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। আওয়ামী লীগও চীনের প্রতিনিধি দলকে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে এখন চীনের সম্পর্ক অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এখন চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানের ঘটনার পর এখন চীন যে কিছুদিনের মধ্যেই পুরো বিশ্বের কর্তৃত্ব নিতে যাচ্ছে এই নিয়ে কূটনৈতিকদের মধ্যে কোনো সংশয় নেই। এতদিন চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য ছিল। এখন চীন অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও বেশ দৃশ্যমান এবং সরব হচ্ছে। আর এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ দলের ভেতরে এবং জোটে চীনপন্থী নেতাদেরকে আবার লাইমলাইটে আনছেন। আওয়ামী লীগ এবং তার জোটের যাদের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তাদেরকে আবার কাছে টানার চিন্তা-ভাবনা চলছে এবং সরকারের নীতিনির্ধারক মহল তাদেরকে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য সবুজ সংকেত দিয়েছেন বলেও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, আওয়ামী লীগ মনে করছে যে এই উপমহাদেশে এখন শান্তিপূর্ণ এবং নির্বিঘ্নভাবে দেশ চালাতে গেলে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটা জরুরি।
সৈয়দ আবুল হোসেন: আওয়ামী লীগে প্রধান চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত সৈয়দ আবুল হোসেন। ২০০৯ সালে সৈয়দ আবুল হোসেনকে সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং চীনের সঙ্গে তার বিপুল ব্যবসা-বাণিজ্যের রয়েছে বলেও জানা যায়। তিনি মন্ত্রী হওয়ার পর তার উদ্যোগে পদ্মা সেতুর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল কিন্তু বিশ্বব্যাংকের কথিত দুর্নীতির অভিযোগের পর এক পর্যায়ে সরকার সমঝোতার অংশ হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেন। আবুল হোসেন এখন না আছেন মন্ত্রী, না আছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে। এমনকি নির্বাচনে তিনি মনোনয়নও গ্রহণ করেননি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা যায়। এখন সৈয়দ আবুল হোসেন আবার সরব হয়েছেন। চীনের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই চীনের সঙ্গে তিনি নতুন করে ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
রাশেদ খান মেনন: আওয়ামী লীগের জোটে রাশেদ খান মেনন দীর্ঘদিন চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিশেষ করে যখন বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় তখন রাশেদ খান মেনন এবং হায়দার আকবর খান রনোরা চীনপন্থী হিসেবেই আলাদা অবস্থান গ্রহণ করেন। যদিও চৈনিক ফর্মুলায় একমত না হয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে সময়ে চীনপন্থী কমিউনিস্টরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই হিসেবে অভিহিত করেছিল। কিন্তু রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো এই ফর্মুলা মানেননি। তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু চীনের সঙ্গে এই দ্বিমতের পরও চীনের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন কমরেড হিসেবেই পরিচিত হলেন রাশেদ খান মেনন। এখন রাশেদ খান মেননকেও সক্রিয় করে তোলা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
দিলীপ বড়ুয়া: দিলীপ বড়ুয়া সাম্যবাদী দলের নেতা কিন্তু অনেকেই বলেন যে, বাংলাদেশে চীনের স্বার্থ রক্ষায় প্রধান রাজনীতিবিদ হলেন দিলীপ বড়ুয়া। বিএনপির আমলেও যেমন তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে চীন সফরে গিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ আমলেও তিনি চৈনিক সম্পর্কের কারণেই মন্ত্রী হয়েছিলেন। এখন দিলীপ বড়ুয়ার কদর বেড়েছে। চীনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজন এই নেতা আবার নতুন করে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
এসব যোগাযোগের উদ্দেশ্য একটা। বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে চীন যেন কোনো বিকল্প না খুঁজে। এখন দেখার বিষয় এই চীনপন্থী তিন নেতা আওয়ামী লীগ এবং জোটে নতুন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ বা দায়িত্ব পান কিনা।