ঢাকা অফিস: কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতা প্রতিরোধ করার শক্তি দেখাতে পারেনি টানা চারবারের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে রাজধানীর সাংগঠনিক দুর্বলতার ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে দলের নীতিনির্ধারকদের কাছেই।
ক্ষুব্ধ হয়েছেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে কারণে ওয়ার্ড-থানার নেতা-কর্মী এবং জনপ্রতিনিধিদের ঐক্যবদ্ধ করতে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সঙ্গে থাকছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। ঐক্য ফেরানোর গতকাল ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে তৃতীয় দিনের বৈঠকে অনেক-হট্টগোল হয়েছে। আন্দোলনে যেসব নেতা গা-ঢাকা দিয়েছিলেন সেসব নেতা কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে নিজেদের ‘বীরত্ব’ দেখাতে মিথ্যার আশ্রয় নিলে তাদের ‘ভুয়া-ভুয়া-ভুয়া’ স্লোগানসহ চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ফলে সভা স্থগিত করতে বাধ্য হন কেন্দ্রীয় নেতারা। এখানেই শেষ নয়, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের জন্য নির্ধারিত রুমে সহিংসতাকালে মাঠে কার শক্তি বেশি ছিল সেটা নিয়ে বাহাসে লিপ্ত হন ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা-১৪ আসনের এমপি মাইনুল হোসেন খান নিখিল। পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে শান্ত হন তারা।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এ বৈঠকে অংশ নেন কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের শীর্ষ নেতা ছাড়াও ঢাকা-১১, ঢাকা-১৪, ঢাকা-১৫, ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য এবং থানা-ওয়ার্ড নেতারা। সভার শুরুতে সূচনা বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। পরে শুরু হয় রুদ্ধদ্বার আলোচনা। এ সময় থানা ও ওয়ার্ড নেতারা বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ড থেকে একজন করে নেতার বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানান, সভার শুরুতে কথা বলেন উত্তরের একটি ওয়ার্ডের সভাপতি আমির উদ্দিন। তিনি তার বক্তব্যে মিরপুর-১০ এলাকায় স্থানীয় সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারের নির্দেশনায় মাঠে থাকার দাবি করেন। তার এমন বক্তব্যের পরপরই উপস্থিত নেতা-কর্মীরা হট্টগোল শুরু করেন। তারা দাবি করেন কামাল আহমেদ মজুমদার ও তার অনুসারীরা কেউ ওই এলাকায় ছিলেন না। এ সময় মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বারবার চেষ্টা করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হন। পরে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
এরপর বক্তব্য শুরু করেন কাফরুল থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি জামাল মোস্তফা। তিনি বলেন, আজকে দলের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী সমন্বয়হীনতা। দলের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় নেই। এই সমস্যার মূলে রয়েছে থানা-ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি না থাকা। কমিটি থাকতে এমন সমস্যায় পড়তে হতো না। ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনি দলের সাধারণ সম্পাদক। আপনি নগরের থানা-ওয়ার্ড কমিটি দেন। কমিটি থাকলে এমন পরিস্থিতি হবে না। এ সময় উত্তর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি তাকে থামিয়ে দেন। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সবাই সে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবেন। এখানে কমিটি গঠন নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবেন না।
পল্লবী থানার ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আশিকুল ইসলাম আশিক বলেন, আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু বাস্তবে আমাদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। এক নেতা আরেক নেতার কথা শুনে না। তিনি দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশ করে বলেন, দলের সবাই যেন সবার কথা শুনে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে দল ঘুরে দাঁড়াবে।
নিজ এলাকায় দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা মাঠে থাকার দাবি করেন পল্লবী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার আলম। তার এমন বক্তব্যের জবাবে উপস্থিত নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান অনেকে। কেউ কেউ বলতে থাকেন আপনি নিজেই মাঠে ছিলেন না। এ সময় তাকে উদ্দেশ করে ভুয়া-ভুয়া-ভুয়া স্লোগান দিতে শোনা যায়। এ সময় ঢাকা-১৪ আসনের এমপি মাইনুল হোসেন খান নিখিলের অনুসারীরা তার মাইক কেড়ে নেয়। এ পর্যায়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়। পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাইক্রোফোন হাতে নেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। তিনি সবাইকে চুপ থাকার অনুরোধ করে বলেন, দলের কোথায় সমস্যা আমরা বুঝেছি। এই পরিবেশে আর কারও বক্তব্য আমরা শুনব না। প্রয়োজনে প্রতিটি থানা-ওয়ার্ড নিয়ে পৃথক ভাবে বসা হবে। এরপর আর কাউকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরে সভা সমাপ্ত ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ সময় ওবায়দুল কাদের বলেন, আপনারা কারা মাঠে ছিলেন, আর কারা মাঠে ছিলেন না, আমাদের কাছে সব তথ্য আছে। আপনারা দলের পদে থেকে ঘরে বসে থাকবেন, দলের খারাপ সময়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখবেন, তা হতে পারে না। যারা মাঠে ছিলেন না তাদের তালিকা হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তালিকা ধরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সভায় উত্তর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওবায়দুল কাদের। বলেন, আমরা একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আজকের সভা করেছি। কিন্তু আপনাদের যে উপস্থিতি, তাতে আমাদের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়নি। আমরা আরও উপস্থিতি আশা করেছিলাম। এ সময় তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। পড়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে সভাস্থল ত্যাগ করেন তিনি।
সভা শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় উপস্থিত তৃণমূল নেতাদের তোপের মুখে পড়েন মহনগর উত্তর আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। তাদের ঘিরে ধরেন উপস্থিত নেতা-কর্মীরা। এ সময় তারা প্রস্তাবিত ওয়ার্ড-থানা কমিটি আবারও সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে জমা দেওয়ার দাবি জানান। একই সঙ্গে যারা মাঠে ছিলেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও করেন অনেকে।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমানের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচির সঞ্চালনায় সভায় উপস্থিত ছিলেন, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, মির্জা আজম, সুজিত রায় নন্দী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আবদুস সবুর, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান প্রমুখ।
কচি-নিখিলের বাহাস : উপস্থিত একাধিক নেতা জানান, সমন্বয় সভা স্থগিত করে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ওবায়দুল কাদেরের নির্ধারিত রুমে যান কাদেরসহ দলের সিনিয়র নেতারা। এ সময় সেখানে গিয়ে ওবায়দুল কাদেরসহ উপস্থিত নেতাদের সালাম দেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংরক্ষিত আসনের এমপি সাবিনা আকতার তুহিন। এ সময় ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশে করে তুহিন বলেন, লিডার আমি এসেছি। এ সময় সেখানে উপস্থিত যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-১৪ আসনের এমপি মাইনুল হোসেন খান নিখিল বলেন, ‘হ্যাঁ তুমি ১০-১২ জন লোক নিয়ে এসেছ। সব জায়গায় গ্যাঞ্জাম করার জন্য আস।’ এ সময় তুহিন বলেন, আমি কি ১০-১২ জন নিয়ে চলি নাকি, সব সময় আমার সঙ্গে ২-৩ শ নেতা-কর্মী থাকে। বিগত দিনে মাঠে প্রমাণ দিয়েছি। এ সময় নিখিল বলেন, দেখেছি, মহানগরের কেউই মাঠে থাকেনি। নিখিলের একথার প্রতিবাদ জানান ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি। তিনি বলেন, নিখিল তোমার কথা ভুল। তুহিন মেয়ে মানুষ হয়েও সে রাজপথে ছিল। সে সব সময় অনেক বেশি মানুষ নিয়ে মাঠে থাকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে তুহিন ছাড়াও মিরপুরে হানিফ, মাজহার আনাম, আনোয়ার হোসেন লিটু, গিয়াস, ডন, শ্যামল এরা ভালো ভূমিকা রাখছে। জীবনবাজি রেখে সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করছে। এ সময় নিখিল বলে ওঠেন আপনি (কচি) কোথায় ছিলেন। জবাবে কচি বলেন, আমি পুরো উত্তর এলাকায় ঘুরে বেরিয়েছি, নেতা-কর্মীদের মাঠে নামিয়েছি, দিকনির্দেশনা দিয়েছি। আমি মহানগরের সাধারণ সম্পাদক, এক জায়গায় থাকা আমার কাজ না। তুমিও একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তোমারও উচিত ছিল পুরো রাজধানীতে ঘুরে দেখা এবং নেতা-কর্মীদের মাঠে নামানো। এরপর আবার নিখিল বলে ওঠেন দেখেছি, কার কী ভূমিকা সেটা দেখা গেছে। সবাই ঘরে উঠে ছিলেন। এ কথা প্রতিবাদ করেন কচি। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কিছু সময় বাহাস চলে। পরে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম রাগান্বিত হয়ে নিখিলের উদ্দেশে বলেন, চুপ কর। সিনিয়রদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তা জান না। সে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার সঙ্গে বেয়াদবি কর? এ সময় উপস্থিত আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ নিখিলকে উদ্দেশ করে বলেন, তুমি কী আগে সেটা বুঝতে হবে। নিজের ওজন বুঝে কথা বলতে হয়। সে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাঁর সঙ্গে এভাবে কথা বলা ঠিক না। এরপর এস এম মান্নান কচি ও নিখিলকে মিলিয়ে দেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা একই দল করি। এক জায়গায় বসলে অনেক কথাবার্তা হয়। সংগঠনের স্বার্থে আমরা এক। পত্রিকায় লেখার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কচি ভাই আমার বড় ভাই। তেমন কিছু ঘটেনি। এসব আমলে নেবেন না।
ভেঙে দেওয়া হলো আওয়ামী লীগের ২৭ ইউনিট কমিটি : কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রতিরোধে ভূমিকা না রাখা নেতাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা আন্দোলনের নামে জামায়াত-বিএনপির সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারায় ভেঙে দেওয়া হয়েছে ঢাকা-১৩ আসনের অধীন মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলানগর থানার ২৭ ইউনিট কমিটি। গতকাল বিকাল থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় মোহাম্মদপুর সূচনা কমিউনিটি সেন্টারে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অন্তর্গত ঢাকা-১৩ আসনের তিন থানা ও ওয়ার্ড নেতাদের নিয়ে এক মত বিনিময়সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ইউনিটগুলো ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে থাকা একাধিক নেতা এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, এ ইউনিটগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা আন্দোলন মোকাবিলায় সরাসরি অংশ নেননি বলে অভিযোগ ওঠে। সে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এসব ইউনিটের কমিটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। ইউনিট ভেঙে ফেলার তথ্য জানালেও কয়টি ইউনিটের কমিটি ভেঙে ফেলা হয়েছে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান।