ঢাকা, ১৮ আগস্ট- রাজধানীর নিউমার্কেট ও পল্টন থানার পৃথক দুটি হত্যা মামলায় পাঁচজন ভিআইপি আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু এবং সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া নিউমার্কেট থানার একটি মামলায় সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকে আটদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
আটককৃতরা রিমান্ডে দিচ্ছেন ভয়ংকর সব তথ্য। গ্রেপ্তার হওয়ারা বলছেন, দেশের বড় বড় দুর্নীতির সবকটির সঙ্গেই জড়িত ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনরা। বিশেষ করে তার আত্মীয়-স্বজনদের কারণে ব্যস্ত সময় পার করতে হতো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের। তবে তাদের বেশির ভাগই কমিশনের বড় একটি অংশ নিজেদের পকেটে রেখে দিতেন। আবার অনেক কর্তাব্যক্তি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের কথা বলে নিজেরাই বাগিয়ে নিতেন বড় বড় কাজ। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতদের এমন তথ্যে রীতিমতো চোখ কপালে উঠেছে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিউমার্কেট থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হলেও তাদের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে তাদের দেওয়া সব তথ্য এখনই আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এগুলো যাচাইবাছাইয়ের কাজ চলছে। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের সম্পর্কে আগে আসা অভিযোগগুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সূত্র বলছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির বিষয়ে এখনো মুখ না খুললেও বেশির ভাগ সময়ই তিনি নীরব থাকছেন। সালমান এফ রহমানের ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি দাবি করেছেন, বিষয়টিতে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নির্দেশনা ছিল। আমি কেবল ম্যাসেঞ্জার ছিলাম মাত্র।
সালমান দাবি করেছেন, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত নির্বাচনের বিষয়ে যাবতীয় নীলনকশা করেছিলেন। কেবল নির্বাচনের জন্যই তারা কয়েকজন শত কোটি টাকা নিজেদের পকেটে ভরেছেন। জ্বালানি সেক্টরের সবকিছুই নিজে ডিজাইন করতেন নসরুল হামিদ বিপু। বাপেক্সকে দেশের কল্যাণের বাইরে নিজের কল্যাণে ব্যবহার করতেন বিপু। গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের দাবি, সরকারের নির্দেশেই তিনি অপরাধে জড়িয়েছেন। তিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন, তার কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কাকে, কীভাবে এবং কত টাকা দিয়েছেন তা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন তিনি। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী সরকারের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে পলক লোপাট করেছেন কয়েক হাজার কোটি টাকা। এর বড় একটি অংশ নানা কায়দায় পাচার করেছেন বিদেশে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তার নাম ভাঙিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা করেছেন তথ্য প্রযুক্তি খাতে। শুধু পলক নন, হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তার স্ত্রী আরিফা জেসমিন কণিকাও। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া আমেরিকায় গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের নামে একের পর এক প্রকল্প বানিয়ে বাজেট থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট করেন। সজীব ওয়াজেদ আইসিটির উপদেষ্টা হওয়ায় এ খাতে ছিল না কোনো জবাবদিহি। পলকের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলার সাহস করেনি।
সবশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় হলফনামায় দেওয়া তথ্যমতে, পলকের গত পাঁচ বছরে সম্পদ ও আয় বাড়ে অস্বাভাবিক হারে। নিজের অবৈধ আয়ের অর্থ বৈধ করতে স্ত্রীকে বানিয়েছেন উদ্যোক্তা। তার স্ত্রীর নামে সিংড়ায় রয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ বিঘা জমি। ঢাকায় কমপক্ষে ১৫টি ফ্ল্যাট। পলক ও তার স্ত্রীর নামে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও আমেরিকায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়ি আছে। অভিযোগ রয়েছে, নামে-বেনামে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে পলক ও তার স্ত্রীর কণিকার। মাত্র ১০ বছরে তিনি কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় নিউমার্কেট এলাকায় হকার শাহজাহান হত্যা মামলায় এনটিএমসির সাবেক ডিজি বরখাস্তকৃত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে গোয়েন্দা দপ্তরে গত তিন দিন ধরে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে রয়েছে খুন, গুম ও অসংখ্য ব্যক্তির ফোনে আড়িপাতার অভিযোগ। তবে জিয়াউল আহসানের দাবি, তিনি সবকিছুই করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের নির্দেশে। এনটিএমসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলেও তা চলত তারিকের ইশারায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একটি সূত্র জানিয়েছে, মামলাগুলো এখনো থানা পুলিশের কাছেই তদন্তাধীন। তবে ভিআইপি আসামি হিসেবে তাদের মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে রাখা হয়েছে। সেখানেই তদন্ত কর্মকর্তাসহ ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। হত্যা মামলাসহ দেশে অরাজকতা ও রাজনৈতিক সহিংসতা এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গ্রেফতারের পর থেকেই বেশিরভাগ সময় কান্নাকাটি করছেন জুনাইদ আহমেদ পলক। ইন্টারনেট শাটডাউনের বিষয়েও তিনি দায় অস্বীকার করেছেন। তার ভাষ্য, প্রতিমন্ত্রী হলেও ইন্টারনেট বন্ধ করার ক্ষেত্রে তার একক কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। জিজ্ঞাসাবাদকারী সূত্রের দাবি, ভিআইপি আসামিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছেন জুনাইদ আহমেদ পলক। মাঝেমধ্যেই অগোচরে তার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। নিজেকে তিনি নির্দোষ দাবি করেছেন। এত দ্রুত সরকারের পতন হতে পারে, তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। যদিও একদিন আগেই স্ত্রী-সন্তানদের বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়ার কথাও তিনি স্বীকার করেছেন।
সূত্র আরও জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিষয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। তার দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পুরো বিষয়টি তিনি প্রায় নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। কিন্তু সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পুলিশকে দিয়ে বলপ্রয়োগ করে আন্দোলন দমাতে চাইলে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ভেস্তে যায়। এছাড়া আনিসুল হক অতি-উৎসাহী কিছু পুলিশ কর্মকর্তার ওপরও দায় চাপিয়েছেন। তার দাবি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচারে গুলি চালানোটা উচিত হয়নি। এতে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আসার বিপরীতে আরও বেশি তীব্র আকার ধারণ করেছে।
ডিএমপির একাধিক সূত্র জানায়, বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না বলে দাবি করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গুলি করার নির্দেশনা দেওয়ার তারা কোনো অথরিটি নন বলেও দাবি তাদের। আর ডেপুটি স্পিকার হওয়ার পর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না বলেও দাবি করেন শামসুল হক টুকু।
ভিআইপি আসামিদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় এ প্রসঙ্গে প্রকাশ্যে কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে চাননি। আসামিদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, ওষুধ ও খাবার দেওয়া হচ্ছে বলেও জানায় পুলিশের একাধিক সূত্র।