- হাসিনাকে নিয়ে বিপাকে দিল্লি।
- বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তুলসি গ্যাবার্ডের মন্তব্যে সরকারের উদ্বেগ প্রকাশ।
লন্ডন, ১৮ মার্চ: জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি বাংলাদেশে চারদিনের সফর শেষ করে ফিরে গেছেন। বাংলাদেশ সফরকালে তিনি বাংলাদেশে ন্যায়সঙ্গত, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক সমাজের যে পরিবর্তন হচ্ছে সেটিকে ইতিবাচকভাবে দেখেছেন। একই সঙ্গে জাতিসংঘের পাশাপাশি তিনি নতুন এ যাত্রায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের আহ্বান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের নিয়েও তিনি ইতিবাচক একটি অবস্থান নিয়েছেন। সেখানে যে আর্থিক ঘাটতি দেখা দিচ্ছে সেটিকে তিনি সবার সামনে এনেছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনের কথা বলেছেন। সব মিলিয়ে তিনি বাংলাদেশের সংস্কার ও রূপান্তরের ক্ষেত্রে একাত্মতা পোষণ ও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে জাতিসংঘের সমর্থনের কথা জানিয়ে গেছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সমর্থন চেয়েছেন। সফরের শেষে তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে তার অভিজ্ঞতা ও জাতিসংঘের অবস্থান তুলে ধরেছেন।
আন্তোনিও গুতেরেস এর আগেও বাংলাদেশ সফর করেছেন। ২০১৮ সালের ওই সফর আর ২০২৫ সালের সফরের তাৎপর্য আলাদা। কারণ এবার তিনি এমন এক সময় বাংলাদেশ সফর করেছেন যখন বাংলাদেশ একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হয়েছে। আর ২০১৮ সালে তিনি যখন সফর করেছেন তখন দেশে গণতন্ত্র সুসংহত ছিল না। অ্যান্তোনিও গুতেরেসের এবারের সফরে সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাব এসেছে। সাংবাদিকরা এ বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের মত জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করা জরুরি, যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। এ কারণেই, যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয়, বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু করাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।” তবে তিনি যোগ করেন, “বাংলাদেশকে চ্যানেল বা করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে যথাযথ অনুমোদন ও সহযোগিতা প্রয়োজন।”
বাংলাদেশে চলমান সংস্কার ইস্যুতে জাতিসংঘ মহাসচিব অত্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার কার্যক্রম বোঝার চেষ্টা করেছেন। বুঝতে চেয়েছেন সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান। জাতীয় পর্যায়ে যে রূপান্তর বা সংস্কার হচ্ছে তা সম্পর্কে সবার সঙ্গে কথা বলে বাস্তব চিত্র অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তিনি অন্তবর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমকে সমর্থন করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক, মানবিক, টেকসই, ন্যায়সঙ্গত সমাজ বিনির্মাণের উদ্যোগে জাতিসংঘের সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। বাংলাদেশের নতুন অগ্রযাত্রায় জাতিসংঘ কাজ করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশে ন্যায়সঙ্গত, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক সমাজের যে পরিবর্তন হচ্ছে সেটিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। একইসঙ্গে তিনি সংস্কার, নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থাবোধ ও ঐকমত্যের ওপর জোর দিয়েছেন। সংস্কার বিষয়ে যে যে সহযোগিতা প্রয়োজন, তার সবকিছুই তিনি করবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করার জন্য এবং বাংলাদেশ ও দেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, “বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আপনাদের ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে সমর্থন জোগানো।” তিনি আশ্বাস দেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে সমর্থন করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে।
দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন,‘জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে পারে। বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সম্পর্ক আরও গভীর ও শক্তিশালী হওয়ার আশা করা যায়। রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদী সমাধান ও দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
হাসিনাকে নিয়ে বিপাকে দিল্লি
এদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফর ও অন্তবর্তী সরকারের সকল কার্যক্রম সমর্থন এবং জুলাই গণহত্যার ঘটনায় জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকে হাসিনাকে নিয়ে দিল্লি বিপাকে পড়েছে। দিল্লি ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্টে শেখ হাসিনাকে হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার ফলে দিল্লিকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দিয়ে তার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে।
জাতিসংঘের এ তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, হাসিনা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গণহত্যার পরিকল্পনা, নির্দেশনা এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করেছিলেন। এর ফলে ১৪০০ মানুষ নিহত হয়েছিল, তাদের মধ্যে ১৩ শতাংশ শিশু। জাতিসংঘ এই হত্যাকাণ্ডকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে এর বিচার চাচ্ছে। বিএনপি এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে দিল্লিকে হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর দাবি জোরদার হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন যে তারা হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে আন্তর্জাতিকভাবে বিচার করবেন।
এদিকে, দিল্লি’র প্রতি চাপ বাড়াতে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা পরামর্শ দিচ্ছেন যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের মাধ্যমে হাসিনার বিচার প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাক, যাতে দিল্লিকে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ না থাকে। বিশিষ্ট কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দিল্লি যদি এই বিষয়ে নৈতিক দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে এটি আন্তর্জাতিকভাবে দিল্লির অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এভাবে, জুলাই গণহত্যা এবং শেখ হাসিনার বিচারের বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। হাসিনাকে নিয়ে দিল্লি বড় বিপাকে পড়েছে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তুলসি গ্যাবার্ডের মন্তব্যে সরকারের উদ্বেগ প্রকাশ
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স তুলসি গ্যাবার্ডে মন্তব্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ১৮ মার্চ, ঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, তুলসি গ্যাবার্ড অভিযোগ তুলেছেন যে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ‘নিপীড়ন ও হত্যা’ এবং দেশে ‘ইসলামি সন্ত্রাসীদের হুমকির’ মধ্যে ‘ইসলামি খিলাফত অনুযায়ী শাসন করার’ ‘আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিহিত’ আছে। তার এমন মন্তব্যে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও মর্মাহত। তার এই বিবৃতি বিভ্রান্তিকর এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। এই জাতি ইসলামের অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ চর্চা করে এবং চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।
এতে আরও বলা হয়, গ্যাবার্ডের মন্তব্য কোনো প্রমাণ বা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে নয়, বরং পুরো জাতিকে মোটা দাগে এবং অযৌক্তিকভাবে চিত্রিত করেছে। বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও চরমপন্থার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সামাজিক সংস্কার এবং অন্যান্য সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে অব্যাহতভাবে কাজ করছে। ভিত্তিহীনভাবে বাংলাদেশকে ‘ইসলামি খিলাফত’ ধারণার সঙ্গে যুক্ত করায় শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অসংখ্য বাংলাদেশি এবং বিশ্বজুড়ে তাদের বন্ধু ও অংশীদারদের কঠোর পরিশ্রমকে অবমূল্যায়ন করেছে। ‘ইসলামি খিলাফত’ এর সঙ্গে যুক্ত করার যেকোনো প্রচেষ্টার বাংলাদেশ তীব্র নিন্দা জানায়।
রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের উচিত সংবেদনশীল বিষয়গুলো মাথায় রেখে, প্রকৃত জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে এবং ক্ষতিকারক বাঁধাধরা ধারণাগুলো থেকে বেরিয়ে এসে, ভয় না দেখিয়ে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা যেন উসকে না দেয় সে ব্যাপারে যত্নশীল হয়ে মন্তব্য করা। চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অভিন্ন বৈশ্বিক প্রচেষ্টা এবং জাতির সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তথ্যভিত্তিক গঠনমূলক সংলাপে অংশ নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।