সোমাদ্রি সাহা: বাঙালির মন উরু উরু। সে তো বাঁধ মানে না। পাগল করা প্রকৃতি প্রেম সমস্ত কিছু ভাসিয়ে দেয়। ফেরারি মনের ডাকে মনশূন্যপুরে উড়ে চলে বোহেমিয়ান মন। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আত্মাকে তৃপ্ত করতে ঘর থেকে দুই পা ফেলে বেরোতেই হবে। ছোটবেলার সবুজ দ্বীপের রাজা থেকে কালাপানি-এর মোহে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জতে রবীনসন ক্রুশো হতে দোষ নেই। প্রকৃতি ও পুরষের মেলবন্ধনের সাথে ইতিহাসের স্থাপত্য রাজকাহিনিরা মিলে মিশে যায় আকাশ থেকে সমুদ্রের নীল সীমানায়। জারোয়ার দেশে সেলুলার জেল এটা ভেবেই ছুটির মন কেমন যেন যাযাবর হয়ে যায়। আসলে আন্দামান অদ্ভুত এক স্থানে যেখানে প্রকৃতির ভার্জিনিটি আর ইতিহাসের ওরিজিনালিটি দুইয়ের যুগপৎ মেলবন্ধন ঘটেছে। গোটা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে মোট ৫৭২টি দ্বীপ আছে। কিন্তু আন্দামানের ভ্রমণকারীদের জন্য মাত্র ৩৬টি দ্বীপই প্রবেশযোগ্য। কিন্তু দুঃখের কথা কেউই এই ৩৬খানা দ্বীপ একবারের ট্রিপে দেখে আসতে পারবেন না।
এখানকার অন্যতম আকর্ষণ বিভিন্ন ধরনের উপজাতির মানুষের জীবনশৈলী ও প্রকৃতির মাঝে তাদের বসবাসের অভিনব ব্যবস্থাপনা, যা আমাদের তথাকথিত সভ্যতা থেকে যোজন মাইল দূরে। মূলত ছয়টি উপজাতির বাস আন্দামান-নিকোবর জুড়ে — ১। জারোয়া, ২। সেন্টিনেলি মঙ্গোলয়েড, ৩। ওঙ্গে, ৪। সাম্পেন, ৫। নিকোবরিস, ৬। গ্রেট আন্দামানিস। শেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বর্তমানে ২৪০ জন জারোয়া, ৯৮ জন ওঙ্গে, ৩২ জন গ্রেট আন্দামানি, ২০০ সাম্পেন, ২৫০ সেন্টিনেলি মঙ্গোলয়েড এবং ৩০,০০০ নিকোবরিস রয়েছেন। (তথ্যসুত্র: গাইডবুক এবং আন্দামানের সরকারি ডেটাবেস)
এখানে ৩টি স্বাদু জলের নদী বয়ে গেছে — কালোং, গাল্টিয়া এবং আলেকজান্দ্রিয়া। এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন কাঠচেরাই মিল (চ্যাথাম শ’মিল) এখানেই অবস্থিত ‘চ্যাথাম আইল্যান্ডে’।
অক্টোবরের এক দুপুরে বিমানে করে যখন পোর্ট ব্লেয়ার-এ ‘বিনায়ক দামোদর সাভারকর এয়ারপোর্ট’-এর মাটি ছোবে তখন মেঘলা আবহাওয়ার খামখেয়ালি বাতাস বইতেই পারে। নির্দিষ্ট হোটেলে চেক-ইন করে বিকেল ৪টেয় আপনারা ‘কোরভিন কোভ বীচ’ দেখতেই পারেন। আন্দামানের জনপ্রিয় চার-পাঁচটি সৈকতের মধ্যে এটি একটি অসাধারণ সমুদ্রসৈকত। তখন থাকবে গোধূলিবেলা, ক্যামেরার কারসাজি করার আদর্শ সময়। বিচ ফটোগ্রাফি জমিয়ে করতেই পারেন। তারপর সন্ধ্যে ৭টায় সেলুলার জেলের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখে নিন। জানুন অজানা ইতিহাস। তবে ঐ শো দেখার জন্য টিকিটের জন্য ভিড় ও মারাত্মক ধাক্কাধাক্কি সহ্য করতে হতে পারে। ট্যুর ম্যানেজার থাকলে তিনি সব আয়োজন করে দেবেন।
আমাদের পূর্বপুরুষরা আমাদের পরাধীন ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার মুক্তিযুদ্ধে বন্দী হয়ে অসহ্য সাজা ভোগ করতে প্রবেশ করেছিলেন, তাদের হাতে পায়ে বেড়ি দিয়ে এই সিংহদুয়ার দিয়েই ভেতরে আনা হতো, সেই পথে যেখানে নেতাজি এসেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তৎকালীন বন্দীদের মুক্ত করতে, সেই মুহূর্তে আপনার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে পারে, রোমাঞ্চে কেঁদে ফেলতেই পারেন। সেলুলার জেলের প্রবেশ পথের সামনেই খাড়া রয়েছে ঐতিহাসিক এক অশ্বত্থ গাছ, যেসময় সেলুলার জেল নির্মাণ করা হয় তখন থেকেই সে রয়েছে। মাঝে অনেক ঝড়ঝাপটা এবং সুনামির মত আঘাত সয়েও সে অনড় থেকেছে একইভাবে। কেন জানেন? আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পরাধীন ভারতের বীর সন্তানদের গল্প বলবে বলে। লাইট অ্যাণ্ড সাউন্ড শো-এর ‘গল্পদাদু’ হলো সেই সর্বংসহা অশ্বত্থগাছ।
সেলুলার জেল নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৮৯৬ সালে, শেষ হয় ১৯১০ সালে। কিন্তু আধা নির্মিত ওই জেলে ১৮৯৭ সাল থেকেই রাজবন্দীদের কয়েদ করতে শুরু করে ব্রিটিশ সরকার যা চলে ১৯৩৩ সাল অবধি। “এখানেই ইংরেজ শাসকেরা নির্মম ও নৃশংসভাবে বহু রাজবন্দীকে হত্যা করে ভাসিয়ে দিয়েছে বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলরাশিতে। এই জেলের প্রত্যেক খানি ইঁট অগনিত রাজবন্দীর অবর্ণনীয় দুঃখ যন্ত্রণার নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে।”
(কমরেড গণেশ ঘোষ: ‘মুক্তিতীর্থ আন্দামান’ )
পরদিন সকালে যখন সেলুলার জেল পরিদর্শনে যাবেন, তখন গাইডের কাছে অনেক অজানা কথা শুনতে পাবেন। প্রবেশপথের দু’ধারে যেখানে আগে ব্রিটিশ অফিসারদের কুঠুরি ছিল সেটা এখন জেল-মিউজিয়াম। এখানে আছে তৎকালীন সময়ের বন্দীদের ব্যবহৃত নানা দ্রব্য, তাদের জেল পোষাক, খাওয়ার পাত্র, নানা মুদ্রা এবং সাল অনুযায়ী বন্দীদের ছবি, জেল জীবনে তাদের হাতে আঁকা অনেক ছবি যা কালের নিয়মে হলুদ হয়ে গেছে।
মিউজিয়াম দেখার পরে মূল জেল ক্যাম্পাসে প্রবেশ করবেন, এই বিশাল জেল স্টারের মতো আকৃতির। সাতখানা উইংস দিয়ে গঠিত, এখন দেখার মধ্যে মাত্র তিনটে উইং ঠিকঠাক আছে, দুটি শাখা সুনামীতে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং বাকি দুটি মিলে গড়ে উঠেছে এখানকার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ‘গোবিন্দ বল্লভ পন্থ হাসপাতাল’। সেই সময় সাতটা উইং যুক্ত ছিল একটা মিডিল টাওয়ারের সাথে যেখানে ২৪ X ৭ পাহারা থাকতো।
তিন তলা এই বিশাল জেলের কুঠুরিগুলো বেশ ছোট, একজন প্রমাণ সাইজের মানুষের ঠিকমত শোয়ার জন্য কোণাকুণি ভাবে জায়গা লাগবে এমন। প্রতিটা তলায় দু’জন করে অর্থাৎ প্রতিটা উইং-এ ৬ জন প্রহরী = একসাথে গোটা জেলে ৪২ জন প্রহরী ২৪x৭ পাহারায় থাকতো। জেলের কুঠুরিগুলো আজও একইরকম অক্ষত আছে, গারদের রডগুলো স্পর্শ করলে শিহরিত হতে হয়, মধ্যবর্ত্তী টাওয়ারের মধ্যে আছে বন্দীদের নামাঙ্কিত ফলক, সাল ও রেজিমেন্ট অনুযায়ী। সেই সময় ৬৯২ জন বন্দী এখানে ছিলেন।
গাইডের মুখে জেলের নানা কাহিনী শুনে আপনার মাথা ঝিমঝিম করতেই পারে, দেখবেন সেই স্থান যেখানে একসাথে তিন জনকে ফাঁসি দেওয়া হতো খোলা ময়দানে, বিনায়ক দামোদর সাভারকারের কুঠুরির ঠিক সামনে। সেই ফাঁসির মঞ্চ আজও একইভাবে মজুত, শুধু সংরক্ষণের জন্য ঘিরা দেওয়া হয়েছে। সেই লিভার যা দিয়ে একসাথে তিনটে ফাঁস টানা যেত, একই ভাবে দণ্ডায়মান ইতিহাসের নির্মম দলিল বুকে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকবে। বড় অসহনীয় কালো অন্ধকার।
এই নস্টালজিয়া পেরিয়ে এরপর আপনি বারাটাং দ্বীপে যেতে পারেন আসলে যা জারোয়া ল্যান্ড নামে খ্যাত। জিরকাটাং নামে চেক পোস্টে আপনার তল্লাশি নেওয়া হবে ও পারমিট দিয়ে জানানো হবে আপনি ৫১ কিমি বিস্তৃত এলাকা জারোয়া ভূমিতে প্রবেশাধিকার পেয়েছেন। গভীর গহন রেন ফরেস্ট স্থানে টানা ৫১ কিমি গাড়িতে যাওয়া এক রূদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতা আপনার লাইফটাইম এক্সপিরেয়েন্স। সেখানে ফটোগ্রাফি নিষিদ্ধ, গাড়ির কাঁচ নামানো নিষিদ্ধ, মোবাইল নেটওয়ার্ক মেলে না এবং কোনো অবস্থাতেই গাড়ি থামানো নিষিদ্ধ। পুরো স্থানটি সিসিটিভি ক্যাম ও জ্যামার দিয়ে সুরক্ষিত। কারণ সভ্য সমাজ সভ্যতার নামে এর আগে বহু অসভ্যতামি করেছে নিরীহ জারোয়াদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে। তাই কেন্দ্রিয় সরকার থেকেই পুরো আন্দামানে সুরক্ষা ব্যবস্থা এমনই শক্ত। ওরাই কিন্তু সুনামীর সময় সুরক্ষিত ছিল। কারণ আগের থেকেই বুঝতে পেরেছিল ভয়ংকর এক সমুদ্র দানব আসছে। এটাই আদিম অভিজ্ঞতা। এটাই বেঁচে থাকার আদিমত্ব। জারোয়াদের নিয়ে নানা মিথ্যের মিথ মুখে মুখে তৈরি হয় আমাদের মত মেইনল্যান্ডের বাসিন্দাদের কাছে। আসলে কিন্তু এরা এখন যথেষ্ট সভ্যতার আলোকপ্রাপ্ত। কিছু জন হিন্দিভাষাও বোঝে। এরা থাকে নিজস্ব কুঁড়ে ঘরে, এই বিশাল ৫১ কিমি রেন ফরেস্টের সুরক্ষিত দ্বীপে এরা মর্জির মালিক। যদি খাদ্য সন্ধানে এরা বেরোয় তবেই মিলবে দেখা। কিন্তু সাধারণ পর্যটকের জন্য ফটোগ্রাফি নৈব নৈব চ!
সৌভাগ্যক্রমে আপনি আসা-যাওয়ার পথে কিছু তীর ধনুকধারী জারোয়া পরিবার দেখতেই পারেন। বারাটাং-এর জারোয়া ল্যান্ড থেকে আপনার গাড়ি সোজা বেরিয়ে যাবে লাইমস্টোন কেভ দেখতে, ম্যানগ্রোভ অরণ্যের পিছল ভূমি পেরিয়ে যখন একটা খাঁড়িতে থামবে। সেখানে আপনাকের স্পিড বোটে রেন ফরেস্টের উঁচুনিচু বন্ধুর পথ দিয়ে অজস্র সরীসৃপ ও পোকামাকড়ের কামড় বাঁচিয়ে লাইন করে এগোতে হবে লাইমস্টোন কেভের দিকে। পায়ে হাঁটা ছাড়া প্রায় ৩ কিমি-র এই বিপদ সঙ্কুল পথ পাড়ি দেওয়ার অন্য কোনো মাধ্যম নেই। সেই চুনাপাথরের গুহায় প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে নির্মাণ করেছে অজস্র ডিজাইনের মূর্তি – হাতির মাথা, শঙ্খ, চক্র ইত্যাদি অনেক রকমের ডিজাইন নির্মিত হয়েছে মানুষের অবদান ছাড়াই। গুহাটি বেশ গভীর ও অন্ধকার (টর্চ নিয়েই যেতে হবে)।
তার পরেরদিন যাবেন হ্যাভলক দ্বীপে, ক্রুজ-এ চড়ে। এককথায় অসাধারণ সেই সমুদ্রযাত্রা। ফ্লাইং ফিশ ও ডলফিনের মধ্য দিয়ে যখন আপনাদের জাহাজ এগোবে তখন মনে হবে স্বর্গ যদি সত্যি কোথাও থাকে তো সেটা ওখানেই। রাধানগর বীচ ওখানকার সবচেয়ে সুন্দর বীচ, সান বাথের জন্য আদর্শ। সেখান থেকে আপনি যেতেই পারেন নীল আইল্যান্ডে। প্রকৃতির সবটুকু মণিমাণিক্য বোধহয় এই সৈকতে সাজানো রয়েছে।
প্রবালের যে এত বৈচিত্র্য হয়, এত রূপ হয় তা ওখানে না গেলে জানতেই পারবেন না। নীল দ্বীপে একরাত থাকুন, প্রাপ্তি হবে অতুলনীয় মুহূর্ত। নীল দ্বীপের ভরতপুর বীচ সূর্যাস্ত দেখার এক আদর্শ স্থান। গ্লাস বোটিং, স্নোরকেলিং-এর সুযোগ ছাড়া যাবেই না। জীবন্ত প্রবালের ওপর দাঁড়িয়ে পায়ের নিচে তাকে অনুভব করার যে কী আনন্দ তা ইউটিউব দেখে তা অনুভব করা যায় না।
নীল আইল্যান্ড থেকে কোস্টাল ক্রুজে ফিরে আসার পথে দেখবেন নর্থ বে দ্বীপ যার লাইট হাউজের ছবি আমাদের 20 টাকার নোটে দেখা যায়। এই দ্বীপেই আছে মাউন্ট হ্যারিয়েট যা আন্দামানের দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ (প্রথমটি হল স্যাডেল পিক)।
এর পরদিন আপনারা ঘুরে আসুন রস আইল্যান্ড। সেখানে যেতে হলে ‘রাজীব গান্ধী ওয়াটার কমপ্লেক্স জেটি’ থেকে জাহাজ ধরতে হয়। ব্রিটিশদের সময় ঐ রস আইল্যান্ড ছিল আন্দামানে ব্রিটিশদের প্রথম প্রশাসনিক অফিস। সেখানে আজও ব্রিটিশ কলোনীর ধ্বংসাবশেষ, পুরোনো গীর্জা, জল পরিশুদ্ধ করার মেশিন, জাপানি ট্যাঙ্কার, সিমেট্রি ইত্যাদি আছে কালের প্রাচীন শিকড়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা অবস্থায়। আর আছে একটি মিউজিয়াম। সেখানে সবচেয়ে সুন্দর হল খোলামেলা প্রকৃতি ও তার মধ্যে খেলা করা হরিণ, ময়ূর, খরগোশ ইত্যাদি বহু প্রাণী।