।। ফরীদ আহমেদ রেজা ।।
খুব ছোটবেলা আমি একবার পানিতে পড়ে গিয়েছিলাম বলে আম্মার কাছে শুনেছি। ঘটনাটি আমার মোটেই মনে নেই। বর্ষা কালে আমাদের বাড়ির চতুর্দিকে পানি থাকতো। যাতায়াতের প্রয়োজনে বা গরুর খাবার হিসেবে ঘাস কাটার জন্যে সব সময় একখানা খোলা নৌকা বাড়ির ঘাটে বাঁধা থাকতো। তখনও আমার সাঁতার কাটা শেখা হয়নি। আম্মা বলেছেন, আমি একদিন একাকী ঘাটে বাঁধা নৌকায় চড়ে ঝুপ করে পানিতে পড়ে যাই। আমার সম্পর্কে এক ফুফাতো ভাই তখন আমাদের বাড়িতে থাকতেন। আমার পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে তিনি মনে মনে ভাবেন, কাছাকাছি পানিতে হয়তো কোনো বড় মাছ লাফ দিয়েছে। সাথে সাথে তিনি মাছ শিকারের জন্য তৈরি ধারালো হাতিয়ার মানে কোচ হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। হঠাৎ তার নজরে পড়ে, আমি পানিতে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। তিনি তখন মাছ শিকারের কোচ ফেলে দিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে তুলে আনেন। কিছু পানি আমার নাক-মুখ দিয়ে ঢুকলেও আমার জীবন রক্ষা পায়।
আরো বড় হওয়ার পর আরেকবার আমি পানিতে পড়েছি এবং সেটা আমার মনে আছে। তখন আমি এবং বড়াপা কিছুটা সাঁতার শিখে নিয়েছি। আষাঢ় মাসে গ্রামে নতুন পানি এসেছে। মাঠঘাট সবকিছু ডুবিয়ে দিয়েছে। চারিদিকে পানি আর পানি। গ্রামের নতুন প্রজন্ম এ রকম পানির বাহার দেখা থেকে এখন বঞ্চিত হয়ে আছে। চারিদিকে সড়ক হওয়ার কারণে আমাদের গ্রামে এখন সে রকম পানি দেখা যায় না। আমাদের সামনের পুকুরের পানি বেড়ে পাশের মাগুরা নদীর সাথে একাকার হয়ে গেছে।
নতুন সাঁতার শেখার কারণে আষাঢ় মাসের পরিস্কার পানিতে নেমে সাঁতার দেয়ার শখ জেগে ওঠে। বড়াপাও আমার মতো নতুন সাঁতার শিখেছেন। তবে তিনি সে সময় আমার চেয়ে ভালো সাঁতারু ছিলেন। বাড়ির সবার অলক্ষ্যে আমরা দু জন পানিতে নেমে পড়ি। কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে এক সময় মাঝগাঙে চলে যাই। মাঝগাঙে গিয়ে আমার মনে ভয় ঢুকে যায় এবং এলোপাতাড়ি হাতপা নাড়ার সাথে সাথে চিৎকার দেয়া শুরু করি। কি ভাবে জানি না, একসময় নিজেকে নদীর ওপারে আবিস্কার করি। পায়ে মাটির ভর পেয়ে হেঁটে হেঁটে নদীর পারে উঠেই চিৎকার করে ক্রন্দন শুরু করি। যতটুকু মনে পড়ে, এক সময় মস্তান ফুতিকে ডাকতে থাকি। ডাক শুনে মস্তান ফুতি বাড়ি থেকে নৌকা নিয়ে এসে আমাকে বা আমাদের উদ্ধার করেন। নদীর ওপারে আমার সাথে বড়াপাও ছিলেন কি না সেটা এ মুহুর্তে ঠিক মনে পড়ছে না।
ভাটি অঞ্চলের জন্য বর্ষা মওসুম আনন্দ-ফুর্তির সময়। নাইরালী, মাছ ধরা , নৌকা বাইছ এবং গানবাজনার মওসুম। ছোট ছেলেমেয়ের জন্য বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান না থাকলেও মা বা বোন নাইওর গেলে সমবয়সী ছেলেমেয়ের সাথে খেলাধূলার সুযোগের সাথে সাথে আদর আপ্যায়ন ও মজাদার খাবার কম আকর্ষণীয় ছিল না। বর্ষাকালে গ্রামের মহিলারা নৌকা দিয়ে নাইওর যেতেন। আমাদের গ্রামের ভাষায় সেটাকে নাইওরালী বলা হয়। বাপের বাড়ি, ফুফুর বাড়ি, খালার বাড়ি, বোনের বাড়ি – সর্বত্র তারা যেতেন। আমাদের গ্রামের আত্মীয়তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রামের মধ্যেই ছিল। আশপাশ গ্রামের মধ্যে লুদরপুর, ইনাত নগর, হবিব পুর, বুধরাইল, তেঘরিয়া, শাহারপাড়ার সাথেও আত্মীয়তা ছিল। কোনো কোনো পরিবারের আত্মীয়তা আরো ভাটি অঞ্চল এবং আরো উজান অঞ্চলেও ছিল। গ্রামের কারো বাড়িতে মহিলারা যেতে হলে ছোটো নৌকায় চড়ে শুধু চোখ বাইরে রেখে বেতের তৈরি নামাজের মুসাল্লা বা চাটাই দিয়ে নিজেদের শরীর ঘেরাও করে নিতেন। যাদের ছইওয়ালা নৌকা আছে তারাও এ রকম ভাবে কুটুমবাড়ি যাওয়াকে পছন্দ করতেন। কারো কোরো বাড়িতে আলাদা ছই বা ঘোমটি থাকতো। ঘাসকাটার নৌকায় সে ছই বসিয়েও মহিলারা যাতায়াত করতেন। আম্মা চাটাই দিয়ে শরীর ঘেরাও করে নৌকায় চড়া পছন্দ করতেন না। তাই আমাদের বাড়িতে বাঁশবেত দিয়ে মজবুত ভাবে তৈরি একটা ঘোমটি ছিল। আম্মা কোথাও যেতে হলে সে ঘোমটি ঘাস কাটার নৌকায় বসিয়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যেতেন।
বর্ষাকালে মাছ ধরা ছিল অত্যন্ত উপভোগ্য বিষয়। সে সময় খাল-বিল, ধানক্ষেত – সর্বত্র প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। বর্ষাকালে মাছ ধরার কয়েকটি পদ্ধতি ছিল। বহুল প্রচলিত বড়শি এবং উড়াল জালের পাশাপাশি রাতের বেলা হারিকেন বা হ্যাজাক লাইট দিয়ে মাছ ধরা হতো। আমন ধানের খেতের মধ্যে হ্যাজাক লাইট দিয়ে বড় মাছ শিকার করা হতো। আর হারিকেন দিয়ে গ্রামের মধ্যে থেকে ছোট মাছ ধরা হতো। মাছ ধরার আরো দুটো পদ্ধতি ছিল দিনের বেলার। একটি দড়াটানা এবং ওপরটি ফুইট্টারা পাতানো। কোমর সমান পানিতে বাঁশ-বেতের তৈরি ‘এছু’ পাতানো হতো। তারপর নৌকা বাঁধার লোহার শেকল পানিতে ফেলে দু দিক থেকে দুজন ব্যক্তি শেকল টেনে-গড়িয়ে মাছ ধরার “এছু’র কাছে নিয়ে আসতেন। তাড়া খেয়ে অনেক মাছ এছুর মধ্যে এসে জড় হতো। এটাকে দড়াটানা পদ্ধতি বলা হয়। এ ভাবে নানা প্রকারের ছোট মাছ ধরা যায়। দড়াটানা মাছের স্বাদ ছিল ভিন্ন রকম এবং যারা মাছের ব্যবসা করেন তারা দড়াটানা শব্দটি ভুলে যাননি। এ জন্যে তারা নানা রকম ছোটমাছ এক সাথে প্যাকেট করে দড়াটানা মাছ হিসেবে বাজারজাত করেছেন।
মাছ ধরার আরেকটি পদ্ধতি ছিল ফুইট্টারা পাতানো। বাঁশবেত দিয়ে বিশেষ ধরনের কয়েকটি ছোট ছোট খাঁচা তৈরি করা হতো। খাচাগুলোতে মাছের খাবার হিসেবে ধানের কুড়ো রেখে দিয়ে সকাল বেলা বাড়ির আশপাশে পুঁতে রাখা হতো। বিকালে সেগুলো পানি থেকে তুলে আনলে দেখা যেতো পুঁটি, বাইম, মেনি প্রভৃতি মাছে খাচাগুলো ভরে আছে। দড়াটানা আর ফুইট্টারা দিয়ে ধরা মাছের সাথে অনেকে সিলেটি হাতকরা বা কমলার ছাল দিয়ে রাঁধতেন।
বর্ষাকালের একটা উৎসব ছিল নৌকা বাইছ। আমাদের গ্রামের আলেম সমাজ নানা সঙ্গত এবং অসঙ্গত কারণে নৌকা বাইছের প্রবল বিরোধিতা করতেন। কিন্তু এ কারণে নৌকা বাইছ থেমে থাকেনি। নৌকা বাইছে অংশ গ্রহণকারী এবং দর্শকদের অভাব কখনো হতো না। প্রতি বছরই বর্ষা মওসুমে আমাদের গ্রাম বা আশপাশের গ্রামে নৌকা বাইছ হতো। বিশেষ করে নৌকা বাইছ প্রতিযোগিতা হতো ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে। ১৪ আগস্ট উপলক্ষে আয়োজিত নৌকা সুদৃশ্য করে সাজানো হতো এবং নৌকাগুলোও ছিল দ্রুততার সাথে চলার উপযোগী করে তৈরি করা। আমি কখনো নৌকা বাইছে যাইনি। তবে নৌকা বাইছে অংশ গ্রহণকারী নৌকাগুলো আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাতায়াত করতো। তাই বাড়িতে বসেই তাদের উল্লাস ও আনন্দ-ফুর্তি আমরা প্রত্যক্ষ করতাম। (চলবে…)