বই: আমেরিকান গডস; লেখক: নিল গেইম্যান; রূপান্তর: মো: ফুয়াদ আল ফিদাহ প্রকাশনী: আদী প্রকাশন; অক্টোবর, ২০১৭।
কাহিনি সংক্ষেপ: ‘যখন দেবতার উপর বিশ্বাস হারিয়ে যায়…তখন হারিয়ে যান দেবতাও!’ শ্যাডোর স্বপ্ন কেবলমাত্র একটা: জেল থেকে বের হয়ে নতুন একটা জীবন শুরু করা। কিন্তু মুক্তি পাবার মাত্র কয়েকদিন আগে সে জানতে পারে, দুর্ঘটনায় তার স্ত্রী আর সবচেয়ে কাছের বন্ধু মারা গিয়েছে! বাড়ি ফেরার পথে তার দেখা হলো এক অদ্ভুত লোক, মি. ওয়েডনেসডের সাথে। আশ্চর্য লোকটা ওর ব্যাপারে সবকিছু জানে। মি. ওয়েডনেসডের দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করতে রাজি হয় ও। পুরনো আর নতুন দেবতার যুদ্ধের মাঝে নগণ্য এক ঘুঁটিতে পরিণত হলো সে। কে জানে, কার জয় হবে এই যুদ্ধে!
আলোচনা: মিথলজি বা পুরাণের গল্প পড়তে কমবেশি সবার-ই ভালো লাগে। তবে নিছক গল্প হিসেবে পড়ার সময় একটা কথা আমরা ভুলে যাই, এই গল্পগুলো আসলে কোন এক প্রাচীন সময়ের সংস্কৃতি, সভ্যতা আর ধর্মের কথা বলে। জাতি আর কালভেদে পৃথিবীতে উপাসনা করা হয়েছে অনেকের; কখনো চন্দ্র-সূর্য-বজ্র, কখনো দেবতা হিসেবে মানা হয়েছে বনের প্রাণিদের, কখনো দেবতারা বাস করেছেন অলিম্পাস নামক পাহাড়ের চূড়ায়, আবার কখনো বা মিশে রয়েছেন মানুষের সাথে একই সমাজে। কালক্রমে সেগুলো আজ রুপকথা হয়ে দাঁড়িয়েছে সত্যি; তবে, একটা সময়ে এই দেবতারাই নিয়ন্ত্রন করতেন সংস্কৃতি আর মানুষের আচরণকে। সভ্যতার বিলীন ঘটে, পরিবর্তন হয় সংস্কৃতির। আর তারপর, সেই দেবতারাই হয়ে যান বিস্মৃত। না, আমেরিকান গডস সরাসরি কোন মিথলজি বা পুরাণের কাহিনী নয়। তবে এর জনরা বলা কঠিন। ফ্যান্টাসি, হরর এবং সায়েন্স ফিকশন-একই সাথে তিন ক্যাটেগরিতে তিন তিনটি ঐতিহ্যবাহী সম্মানসূচক এওয়ার্ড পেয়েছে বইটি। তাই জনরা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ না হয় বাদ-ই থাক। নিল গেইম্যান আমার প্রিয় একজন লেখক। পুরো পৃথিবীজুড়ে তার পাঠক তথা ডাই হার্ড ফ্যানের সংখ্যা কয়েক মিলিয়ন। তাদের কথা জানি না। আমার ব্যক্তিগত পছন্দের কারণ হচ্ছে নিল গেইম্যানের দৃষ্টিভংগি। খুব সহজ স্বাভাবিক দৃশ্য অথবা ছোটবেলার রূপকথার গল্পগুলোকে তিনি আলাদা চোখে পর্যবেক্ষণ করেন। তার কল্পনার জগতটা একান্তই তার নিজের, সেই বিচিত্র জগতে নানা রঙ-এ রঙিন হয় সেই গল্পগুলো। তারপর ভাষার যাদুতে ফুটে ওঠে সাদা কাগজে। আমেরিকান গডস নিল গেইম্যানের সবচাইতে বিখ্যাত কাজগুলোর একটি। ঢাউস আকারের এই বইয়ের মূল বিষয়বস্তু হিসেবে পুরনো বিলুপ্ত দেবতাদের সাথে নতুন দেবতাদের যুদ্ধকেই ধরে নেয়া যাক। নর্স, স্লোভিক, ঈজিপশিয়ান, আফ্রিকানসহ আরো অনেক পুরাণের দেবতাদের দেখা মিলেছে এই উপন্যাসের পাতায় পাতায়। আধুনিক যুগে তারা বিস্মৃত হয়েছেন, হারিয়েছেন মানুষের ভক্তি, শ্রদ্ধা আরর শক্তি। বর্তমান বিশ্বের উন্নয়নের শিখরে থাকা আমেরিকায় (যা এককালে নির্বাসিতদের আশ্রয়স্থল ছিল) তারা জীবন ধারণ করেন সাধারন ভবঘুরে মানুষের ছদ্মবেশে। কোন এক বিশেষ স্বার্থকে হাসিলের উদ্দেশ্যে তাদেরকে ধীরে ধীরে একজোট করেন প্রাচীন এক আদিদেবতা। নতুন দেবতারা কারা? ইন্টারনেট, টেলিভিশন, রেডিও, মিডিয়া – এ যুগের মানুষ তো আসলে এদেরই আরাধনায় ব্যস্ত। আধুনিক যুগের পরাক্রমশালী দেবতা হিসেবে তাই এরাই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ঐতিহ্যলুপ্ত পুরাণের দেবতাদের বৃদ্ধাংগুলি প্রদর্শন করে ছুড়ে দেয় চ্যালেঞ্জ। শ্যাডো এ যুগের সাধারন এক মানুষ। জেল থেকে বেরিয়ে স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে সে হতবিহবল হয়ে পড়ে। নিজের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর সাথে স্ত্রীর পরকীয়ার খবরে দুমড়ে মুচড়ে যায় তার অন্তরাত্মা! এরই মাঝে হঠাত পরিচয় ঘটে মিস্টার ওয়েনসডে নামের এক রহস্যময় বৃদ্ধের সাথে, যার এক চোখ আবার কাচ দিয়ে বানানো। মিস্টার ওয়েনসডের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হয় শ্যাডো। একের পর এক বিচিত্র ঘটনার সম্মুখীন হতে থাকে সে। পদে পদে পরিচিত হয় সমাজের বিভিন্ন স্তরে লুকিয়ে থাকা অদ্ভুত মানুষদের সাথে, যারা কিনা প্রাচীন যুগের দেবতা হিসেবে দাবী করে নিজেদের। শ্যাডোর চোখের সামনে ওর মৃত স্ত্রী ফিরে আসে বারবার; বাস্তব নাকি স্বপ্ন- তা সে নিজেও জানে না। এদিকে কোন এক অজ্ঞাত কারণে পুরনো দেবতাদের অনেকেই তাকে বিশেষ মর্যাদা দিচ্ছে। নতুন দেবতাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতেও নিজেকে আবিষ্কার করে শ্যাডো। সঠিক কারণ জানা নেই, তবে ওয়েনসডের হয়ে কাজ করতে করতে আরো রহস্যের জালে জড়িয়ে যেতে থাকে সে। মূল উপন্যাসের সাথে সাথে দেবতাদের আমেরিকাতে আগমন, আমেরিকায় ঘাটি গাড়ার বর্ণনা এসেছে সাবপ্লট হিসেবে। অতীত স্মৃতির রোমন্থনের মাধ্যমে মূ্লগল্প হয়েছে আরো সমৃদ্ধ। তবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠককে শিহরিত করতে তা ভালোভাবেই সক্ষম।
অনুবাদ বই প্রসংগ: নিল গেইম্যানের বর্ণনাভঙ্গির অন্যরকম এক মাধুর্য আছে। অনুবাদে তা রক্ষা করা কঠিন।মো: ফুয়াদ আল ফিদাহ ভাইয়ের অনুবাদ নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই, তবে নি:সন্দেহে তিনি তার সেরা কাজ দেখিয়েছেন বইটায়। টুকটাক কিছু কবিতার অনুবাদ অসাধারণ লেগেছে। বিষয়বস্তু এবংং আকারের কারণে, আমেরিকান গডস অনুবাদ করা সত্যিই চ্যালেঞ্জিং ছিল। ইংরেজি বইটা আগে পড়া থাকায়, প্রত্যাশার মাত্রাও ছিল অনেক বেশি। ফুয়াদ ভাই সেই প্রত্যাশাকে কয়েক কাঠি ছাড়িয়ে গিয়েছেন। সবচেয়ে ভালো হয়েছে বিভিন্ন দেবতাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের বর্ণনামূলক সংযুক্তি, যা মূল বইয়ে নেই। সেই সাথে চোখ ধাঁধানো সংগতিপূর্ণ প্রচ্ছদ আমেরিকান গডসে যোগ করেছে নতুন এক মাত্রা।নিউজইনসাইড