আমার হৃদয়
অনেকের মতো আমারও একটা হৃদয় আছে ;
কাউকে কোনোদিন সে কথা বলিনি– কী করে বলবো!
সে হৃদয়ে কত নদী কত জল কত নারী প্রিয়জন
সেয়ানা মাছের মত ঘাই মারে নীরব প্রহরে ;
এ হৃদয় বহু কষ্টে যত্ন করে রেখেছি গোপন।
কখনোই কেউ এসে এ হৃদয়ে রাখেনি হৃদয় ;
হৃদয়ে হৃদয় নিয়ে যে-জীবন যুক্ত হয়ে চলে
সে-জীবন প্রেমিকের শ্রমিকের রমণকাহিনী
ভ্রমণের নাম দিয়ে বিক্রি করে কবিতা পাড়ায়;
কেউ কি পড়েছে তাকে অবসরে খাটে শুয়ে একা!
মাঠের ফসল যদি খেয়ে ফেলে চতুর ইঁদুর
তাহলে কি কৃষকের খালি পেট নির্জল কলস?
আসলে হৃদয় বলে কিছু নেই–আছে মায়া ভূমি
যার নামে লিখে রাখি জীবনের বাকীর হিসাব।।
এখন আমি যে কবিতাটি লিখছি
এখন আমি যে কবিতাটি লিখছি তার জন্ম এক অগ্নিকুণ্ডে;
তার গায়ে লেগে আছে একটা নদীর লকলকে থাবা;
জল তাকে বুকে নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে দেশ মহাদেশঃ
করোনার চেয়ে আরও বেশি গতিবেগে সে ছুটছে
অবরুদ্ধ এক মৃত নগরীর অলিতে – গলিতে, গ্রামে গঞ্জে
লঞ্জঘাটে, ইস্টিমারে; ভ্রাম্যমাণ পতিতাশিবিরে
তার জন্য পাতা আছে এক পাহাড়ি মেয়ের বুক
অই বুকে নাচে মধ্যদিনে কী সুন্দর আগুনের শিখা –
পাহাড় কাঁপানো নাচ! তার শব্দে আমি শুনতে পাচ্ছি
বাতাসের ডাকাতি হুঙ্কারঃ খবরদার! কেউ ভয়ে
পালানোর চেষ্টা করলে গুলি করে ঠিক মেরে ফেলবো।
আমি ভয়ে ভয়ে চুপ্চাপ চল্লিশ দিন গৃহকোণে
আহ্ কী নির্মম অসুখের তাড়া খেয়ে খাদ্যহীন
পড়ে আছি– মহাদেবী কবিতার এতদিন নজর পড়েনি-
আজ ভোরে ঘুম ভাঙার নীরব শব্দে তিনি দেবী
সুন্দরের চোখ মেলে তাকালেন গরীবের দিকে–
কতদিন কবিতাকে কবিতার মতো করে পাইনি;
এইবার ধরা দিয়ে চড়া দামে মূল্য তুলে নেবে;
আমি এই কবিতার প্রতি দাড়ি- কমা শব্দ থেকে
বেপরোয়া বেতমিজ আগুনের টাটকা গন্ধ পাচ্ছি;
এই কবিতার আত্মা থেকে জন্ম নেবে আমার পৃথিবী।
বিগত চল্লিশ দিন
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি পোশাক পরিনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি ঘুমোতে যাইনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি আমাকে দেখিনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি আকাশে উড়িনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি বাগানে হাঁটিনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি আগুনে নামিনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি স্বদেশে থাকিনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি শুধু লাশ দেখি
বিগত চল্লিশ দিন আমি খুঁজি লাশের ঠিকানা
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি ঘরেও থাকিনি
বিগত চল্লিশ দিন পৃথিবীতে ভুবন ছিলনা
বিগত চল্লিশ দিন পৃথিবীতে সঙ্গীত ছিলনা
বিগত চল্লিশ দিন কেউ নাকি সঙ্গম করেনি
বিগত চল্লিশ দিন শিশু যেন শিশুতে ছিল না
বিগত চল্লিশ দিন গাছপালা রকুতে যায়নি
বিগত চল্লিশ দিন দিন বলে কিছুই আসেনি
বিগত চল্লিশ রাত রাত বলে কিছুই ছিলনা
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি মানুষ দেখিনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি খবর পড়িনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি কোনো কবিতা পড়িনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি কবিতা লিখিনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি তোমাকে ডাকিনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি মন্দির দেখিনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি নামাজ পড়িনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি শূন্যে ঝুলে আছি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি অন্ধ কানামাছি
বিগত চল্লিশ দিন জ্বরে কাঁপে নির্বাক পৃথিবী
বিগত চল্লিশ দিন হাসপাতালে করোনা জল্লাদ
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি কবর খোদক
বিগত চল্লিশ দিন ঘুম নেই পাশের বাড়িতে
বিগত চল্লিশ দিন খাদ্য নেই ভাতের হাঁড়িতে
বিগত চল্লিশ দিন কারো হাতে গোলাপ ফুটেনি
বিগত চল্লিশ দিন পানালয়ে মাতাল ঢুকেনি
বিগত চল্লিশ দিন পথে কোন ট্রাফিক ছিল না
বিগত চল্লিশ দিন রাজপথ ফাঁকা পড়ে থাকে
বিগত চল্লিশ দিন নদী নাকি নদীতে ছিলনা
বিগত চল্লিশ দিন পৃথিবীতে পৃথিবী থাকেনি
বিগত চল্লিশ দিন জনপদে জনতা নামেনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি কেন আমাকে দেখিনি
বিগত চল্লিশ দিন আমি নাকি কবরে ছিলাম।
বিধবার গান
সবুজের সমারোহ চারিদিকে; চমৎকার স্বরে
বসন্তে কোকিল ডাকে প্রকৃতির সহজ নিয়মে —
এটাই জেনেছি সত্য শৈশবের কাক ডাকা ভোরে ;
বিচিত্র দৃশ্যের মাঝে অপরূপ সৌন্দর্য্যের মায়া
পরম আদরে যিনি নির্বিচারে মোহ জাল পেতে
মায়ের মমতা দিয়ে বিছিয়ে দিলেন তাঁকে চিনি
জন্ম থেকে, তিনি প্রভু দয়াময় মহান রহিম ;
কী খেলা খেলেন তিনি নিরাকার হাতের ছোঁয়ায়!
একবার যাকে পান তাকে দেন রাজার পোশাক,
আবার রাজার হাতে তুলে দেন ভিক্ষুকের থলে।
পৃথিবীতে তার জন্য ঘটে গেছে কত রক্তপাত!
মানুষে মানুষে যুদ্ধে ভাগ্য খোলে হিংস্র দানবেরঃ
অদিনে কোকিল ডাকে সংগে আছে কাকের চিৎকার ;
বাসরে বসার আগে বধূ যায় বৈধব্যের ঘরে!
নূহের সাম্পান
অবরুদ্ধ এই গৃহ-কারাগারে অদৃশ্য শৃঙ্খল
আমাকে পরিয়ে দিলে কেন কার কোন অপরাধে?
প্রভু! তুমি নিরালোকে দিব্যরথে মাতাল সওয়ারী।
অন্ধকারে ঢুবে আছে জনপদ পাহাড় জঙ্গল;
বিপন্ন সাধুর ডেরা ভুলে গেছে মন্ত্র সাধনার,
বোশেখি ঝড়ের থাবা কেড়ে নেয় পাখির সংসার;
বিশ্ব জুড়ে মরণের বাজপাখি দেশে দেশে ওড়ে–
চাঁদের ওলান ফেটে নেমে আসে অশনিসংকেত।
তবুও তোমার নামে করোনাকে সুবেহ-সাদিকে
আজানে তাড়াতে গিয়ে ধরা খায় ইমাম বেচারা ;
লাওয়ারিশ লাশ হয়ে শুয়ে পড়ে অন্তিম শয়ানে।
এতটা করুণ দৃশ্য মানবতা কখনো দেখেনি!
স্বজনের আহাজারি গুমরে কাঁদে খোদার মহলে–
মুক্তির মোহনা জলে কে ভাসাবে নূহের সাম্পান!
তিন যুগ পরে
তিন যুগ পার হয়ে গেছে ; এক বিকেলের স্মৃতি
আজো কী মধুর হয়ে ঘুরে ফিরে মনের শাখায়
অবরুদ্ধ মহাকালে ঝুলে আছে স্তব্ধ জাগরণে;
হারানো তোমার খুঁজে চোখ বুজে পাহাড়ি ঝর্নার
নির্জন স্রোতের জলে শুনতে পাই যুগল সংলাপঃ
একজন বলেছিল, ” যদি আমি মরে যাই!”! তবে?
অন্যজন বলেছিল, “অসম্ভব ; তা কখনো নয়,
তোমাকে কবর থেকে তুলে নেবে আমার কবিতা।”
কবি যাকে ভালোবাসে মরনেও তার রক্ষা নেই–
সময়ের অনিবার্য নিয়মেই সন্ধ্যা যদি নামে
তখনো আগের মতো অন্ধ তাকে দেখে নানা রূপে;
কখনো জড়িয়ে রাখে কল্পনার নগ্ন বাহু দিয়ে ;
আবার কখনো তাকে আলতো করে ছুঁয়ে দেয়
যৌবনের গাঢ়তম চুম্বনের গভীর আবেশে ।
২.
সেদিন বিকেল যাকে দিয়েছিল প্রাণের সুষমা
সময় শিকারী বাঘ ধীরে ধীরে খেয়ে গেছে তার
বিদেহী প্রেমের মাংস হাড় গোড় চোখের ইশারা,
জীবনের চাওয়া আর পাওয়া নিয়ে যে হয় উন্মাদ
কে তাকে প্রেমিক বলে? সে তো এক চতুর শিয়াল
কৃষকের মুরগী নিয়ে গর্তে ঢুকে আপন স্বভাবে
চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে ; মাঝে মাঝে জোরে মারে হাঁকঃ
মানুষ যদিও মরে, মনে রেখো — প্রেমিক মরে না।
শিয়ালের পথে হেঁটে যে-প্রেমিক দীর্ঘ আয়ু চায়
মহামারি করোনায় তার মৃত্যু ঠেকানো কি যাবে?
বিশ্ব জুড়ে এ কেমন মৃত্যুলীলা মড়ক সন্ত্রাস!
নির্বিচার হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত থেকে নির্বিকার যিনি
আমি তাঁর নামে দিব্যি খেয়ে বলি– করোনাউত্তর
মানুষ দাঁড়াবে ফের জীবনের সবুজ উঠোনে।
৩..
স্মৃতির পেছনে ছায়া কালো এক বিড়ালের মত
আশার বেগুন গাছে পানি দেয় সকাল- বিকাল–
অদৃশ্য মনের দ্বীপে স্বপ্ন জ্বালে মোমের আলোয়।
হাতেগোণা যে-ক’জন রমণীকে বলেছি সুন্দর
তুমি তো তাদের চেয়ে আরও বেশি ছিলে মনোরম ;
কিছুটা নিভৃতাচারী, অন্তরঙ্গে কবিতা রসিক–
অথচ খেয়েছ ধরা বেরসিক স্বজনের জালে
স্বপ্নহীন গোবেচারী অন্য সব রমণীর মতো!
খাও দাও ফূর্তি করো, ইচ্ছে মতো দেহকলা সারো
দু’একটা বংশবীজ যদি আসে তা কিন্তু মন্দ না–
এই তো জীবন! তাকে নিয়ে কেন এত আয়োজন?
জীবন ফুরিয়ে যাবে একদিন জীবনের মত
বাতাসে পাখির মতো ডানা মেলে শূন্যে উড়ে যাবে;
তবুও তোমার বুকে ফুটে যেন প্রেমের কুসুম।
সনেট কুহুর জন্য
এমন আকালে আজ ভোর থেকে একটি কোকিল
আমার কন্যার নামে থেকে থেকে অমেয় মধুর
সুরের বেলুন কেন উড়িয়ে দিয়েছে আমাদের
স্বঘোষিত কয়েদখানায়? যখন বসন্ত গত
প্রকৃতির বিধি মতে কোকিলের এ ডাক এখন
কোথাও শোনার কথা নয় কারও; তবু সে নিজের
প্রাণের তাগিদে আসে উড়ে রমনার ছায়ানীড়ে
কুহুকে জানাতে তার জন্মদিনে মঙ্গল শুভেচ্ছা ।
মেয়েটা এখনও ঘুমে; রাত জেগে কী সুন্দর করে
বানালো একটি কেক! – এ আনন্দ অসীম অপার।
এবার ও জন্মদিনে পরিবে না নতুন পোশাক
আসিফ বাকুম আর মা-বাবার ভালোবাসা ছাড়া
কোনো ফুল প্রিয় দামি উপহার কিছুই নেবে না–
বুকে তার পৃথিবীর হাহাকার ব্যথার নীলিমা।
স্বাধীন কয়েদি
আমি যে শহরে আছি
এ শহর একদিন কবরে ছিল না ;
এখানে পথের পায়ে বাঁধা ছিল কত কোলাহল
আনন্দের বাড়ি ছিল পথের দু’ ধারে
মায়েরা শিশুর হাতে ফুল দিয়ে ফিরেছে বাড়িতে
গাড়িতে ছিল না ব্রেক মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ
এখন গাড়িও নেই কোনওখানে সংকেত জ্বলে না।
আমি যে শহরে থাকি সে শহর
এখন ভিখারি হয়ে খুঁজে নিচ্ছে গ্রামের আশ্রম।
এ আশ্রমে চাল ডাল নূন যায় রিলিফের নামে
আমি যে শহরে আছি সে শহরে
যারা আছে তারা সব স্বাধীন কয়েদি।।
মানুষ তোমার নামে
না, আমি মৃত্যুর আগে ইঁদুরের চোখের ভেতরে
জীবন্ত ধানের ক্ষেতে না-বাঁচার ছাড়ব না আশা;
চাষার লাঙল হয়ে খুব ভোরে দক্ষিণের চরে
মাটিতে হৃদয় খুঁড়ে ঢেলে দিতে স্বপ্ন ভালোবাসা–
ছিটাবো গমের বীজ; ঝড় ঠেলে নদীতে উদ্দামে
নৌকো বেয়ে পাড়ি দেবো কল্লোলিত জলের পাহাড়;
স্রোতের বিরুদ্ধে যেতে যেতে দয়াল মুর্শিদ নামে
নতুন মরমি টানে আলীমের গানের বাহার
কণ্ঠে তুলে ছিঁড়ে দেবো আকাশের স্তব্ধ নীরবতা ;
যে-অামি মেশিন হাতে পরিয়েছি সভ্যতাকে জামা
তার হাতে কাজ আর গায়ে কুর্তা নেই! এ কী কথা!
এ লজ্জা কোথায় রাখি তার নেই মা- বাবা ও মামা!
না, আমি জীবন থাকতে এক বিন্দু পরোয়া না- করে
মানুষ তোমার নামে যুদ্ধে আছি স্ববন্দীর ঘরে।
চুমুর আগুন
পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে মৃত এক কাছিমের মতো;
আমি কি ঘুমোতে যাব ঘর ছেড়ে অন্যের গাড়িতে-
যে- জলে নদীর আয়ু তার বুকে সাহারার জ্বালা!
যে আমারে ভালোবাসে তার চোখে বেদনার পাখি–
সামান্য ঘুমের মধ্যে কত টুকু স্বপ্নপোকা ওড়ে!
পাহাড়ে বেড়ানো মেয়ে যার বুকে সমুদ্র লাফায়
তার জন্য বাঁশি হাতে বৃন্দাবনে অস্থির কানাই
কেন যে চোখের দ্বীপে বানিয়েছে বেহুলা নগর?
জলের সানাই শুনে থেমে গেছে পূর্ণিমার হাসি
যত বেশি দূরে থাকি তত বেশি গোপন নেশায়
তোমাকে জড়িয়ে বুকে চলে যাই মেঘের গুহায়;
বেগানা পুরুষ যারে টেনে নেয় তৃতীয় বাসরে
দু’ দিন মেয়াদি এক প্রায় মৃত দেহনদী ছাড়া
কী আর পেয়েছে মেয়ে! পেয়েছে কি জলের উচ্ছাস!
অদূরেই সন্ধ্যাবাড়ি — লাভ নেই পেছনে তাকিয়ে।
যে যাকে যেমন চায় তার চেয়ে সে কি বেশি পায়?
জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে অবিরাম সময়ের স্রোতে,
তবুও তোমাকে খুঁজি অন্তহীন কবরের ঘাসেঃ
একটি নিমেষ আজো স্মৃতিকুঞ্জে গুঞ্জরিয়া ওড়ে–
আলোটা নিভিয়ে রাখি ঠোঁটে জ্বেলে চুমুর আগুন।
পৃথিবীর মনের অসুখ
আমি যে-বাসায় নিয়মিত বেখেয়ালি একজন
অলস অতিথি — যিনি তার মালিকান তাঁর নাম
নাজমা মান্নান– মনে মনে প্রচণ্ড কর্তৃত্ববাদী–
রয়েছে গানের প্রতি গাঢ় অনুরাগ, মাঝে সাঝে
টিভি কিংবা বেতারের ডাকে দেখি ঘুম নেই চোখে,
তালিমে তালিমে তিনি সারাক্ষণ থাকেন অস্থির ;
ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের রন্ধনশালায়
ত্বরিত গতিতে ছুটে সংসারের ঝামিলা সামলান ;
কখনো গানের খাতা খুলে বসে হারমোনিয়ামে
নিবিড় নিমগ্ন চিত্তে ডুবে যান যখন-তখন,
মাঝে মাঝে গানের সুরেলা কলি ওলি হয়ে ওড়ে
আমার ভাবের দ্বীপে বাতিঘরে হানস জ্বালাতেঃ
মন দিয়ে মন ধরা এ যে এক ভাবের লড়াই
আমি তো ডরাই তাঁকে যদি পাছে পরাজিত হই!
কবিতাকে সঙ্গে নিয়ে দিনরাত নিজের ভুবনে
নীরবে কাটাতে গিয়ে কেটে ফেলি মিলনের সুতো
কখনো আড়ালে বসে দেখি তাঁর হৃদয়ের ছবি
ওটা যে নদীর মতো তরতর বহমান ধারা
আমাকে কখনো করে দিশেহারা জলের হরিণ
সন্ধিজালে বন্দি হয়ে মাঝে মাঝে সুন্দরবনের
ভ্রমণের গল্প শুনে বলি তাঁকে মধুর কাহিনী।
গুণগান বাদ রেখে বলা যাক ভিন্ন কিছু কথাঃ
হুকুমে হাকিম আমি তাঁর সঙ্গে কখনো পারিনি
এটা -ওটা আনো নাই? বাজারের থলে ঘিরে মাছি!
স্যানিটারি ন্যাপকিনের পরিবর্তে কটন এনেছ —
তিন কালে ঠেকে আজ কোন হাটে গোপন ব্যাপারী?
সতীনের ঈর্ষা চোখে মাঝেমধ্যে তুমুল হুঙ্কার
যদি পারো বাদ দাও কিছুদিন কবিতার নেশা
কবিতা দেবে কী আটা চাল ডাল লবণের বাটি
করোনা রোধক যদি তোমাদের কবিতা না- হয়
তা হলে যে পৃথিবী গভীর এই মহামারী জ্বরে
আতঙ্কের জীবাণুতে সভ্যতার বারোটা বাজাবে।
কবিতা বাপের বাড়ি যদি চায় দাও তাকে যেতে ;
পারো তো আগের মতো উদাসীন ঘড়ির কাঁটায়
চাবিকাঠি না-ঘুরিয়ে যথাযথ ব্যাটারি লাগাও
নতুন পেশার দিকে সর্বক্ষণ মনোযোগী হও
মন রাখো প্রয়োজনে সংসারের টুকিটাকি কাজে
খবরদার! শুনো, কোমড় ভাঙিয়া দেবো যদি দেখি
কবিতার নাম করে সবিতার শাড়ি নিয়ে ভাবো?
২.
করোনার করুণায় ঘরে আমি একা নিরুপায়
কবিতা জ্বীনের মতো ভর করে আমাকে আবার-
ঘরণীর অভিমান অগ্নিকুণ্ডে ঘিয়ের বদলে
মাঝে মাঝে অবিরলভাবে ভাঙি প্রেমের কলস
রান্নাঘরে ঘামে ভেজা শরীরের বেহাল দশায়
যখন মমতা নিয়ে সান্ত্বনার দুই চারটি কথা
বলতে গিয়ে বলি তাঁর ঘামঝরা সংসারের কথা
তখন তিনিও বেশ খোশদিলে আমাকে শুনলেন–
আমাকে অবাক করে তারপর সহসা বললেন,
“তুমি জ্বলো কবিতায়, আমি জ্বলি চুলোর আগুনে–
দু’জনেরই লক্ষ্য এক আগুনের গরম উত্তাপ ;
আমি যে-আগুন দিয়ে রান্না করি জ্বলে তা ক্ষণিক–
প্রয়োজনে জ্বালি আর কাজ শেষে বন্ধ করে রাখি;
তোমার আগুন কিন্তু অনির্বাণ দীর্ঘ দাবানল —
ভেতরে ভেতরে জ্বলে এ আগুন নিভানো যায় না।
যে-আগুনে ঘাম ঝরে সে -আগুন রান্নাঘরে জ্বলে
তুমি সে -আগুন আর তার সঙ্গে দেখো ঘামঝরা,
কবিতার আগুনে কি ঘাম ঝরে? কেমন সে ঘাম ?
আমি বলি, “কবিও শ্রমিক বটে, কিন্তু তার শ্রমে
ঘামের বদলে ঝরে রক্ত রক্ত শুধু রক্ত ঝরে…
এ রক্ত এতই লাল তার রঙে সূর্যের পোশাক
কখনো বা কালো হয়ে ম্লানমুখে পরাজিত হয়;
তার মানে কবিতা যায় না লেখা রক্ত ছাড়া; কবি
যে আগুনে পুড়ে পুড়ে শব্দ দিয়ে কবিতা বানায়
সে আগুনে পুড়ে যায় পৃথিবীর মনের অসুখ।”