লন্ডন, ৩ মার্চ- সাম্রাজ্যবাদী ইন্ডিয়া ও তাদের সেবাদাস পতিত ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করার কঠিন শপথ নিয়ে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’। শুক্রবার বিকেল ৪টা ২০ মিনিটের দিকে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধমে আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর পবিত্র গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়৷ ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের পর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়েছে। পাশাপাশি সবাইকে নিজ নিজ ধর্মমত অনুযায়ী শহীদদের জন্য প্রার্থনা করতে বলা হয়৷
জাতীয় নাগরিক পার্টি’র আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে এদিন স্লোগানে স্লোগানে মিছিল নিয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জড়ো হন বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতা। তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশকে ঘিরে পতাকা হাতে মিছিল নিয়ে তাঁরা উচ্ছ্বাস করছেন। কেউ এসেছেন রংপুর থেকে, কেউ এসেছেন খুলনা থেকে। বেলা তিনটা পর্যন্ত নীলফামারী, জয়পুরহাট, রাজশাহী, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষের মিছিল দেখা গেছে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে। জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা৷ এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা ও ঢাকার বিভিন্ন থানা থেকে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও সমর্থকেরা জমায়েত হয়েছেন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে৷ জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত যোদ্ধারা অংশ নেন এই আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে।
অনুষ্ঠানে তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক হিসেবে নাহিদ ইসলামের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। সদস্যসচিব আখতার হোসেন। আহ্বায়কের দায়িত্ব নিতে গত মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন নাহিদ ইসলাম। দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। নতুন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক পদে রয়েছেন সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদীব। জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব পদে রয়েছেন তাসনিম জারা ও নাহিদা সারওয়ার নিভা৷ মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) পদে রয়েছেন হাসনাত আবদুল্লাহ এবং মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) পদে রয়েছেন সারজিস আলম।মুখ্য সমন্বয়ক পদে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক পদে আবদুল হান্নান মাসউদ দায়িত্ব পালন করবেন। নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের নাম ঘোষণার পর দলের আংশিক অর্গ্যানোগ্রাম পড়ে শোনান আখতার হোসেন। কমিটিতে মোট ১৫১টি পদ রয়েছে।
নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির ওপর সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ। এর বহুবিধ কারণ রয়েছে। গণবিপ্লবের আগে বিপ্লবের অংশীজনদের সকলের সামনে কমন শত্রু ছিল আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী ঘরানা। আরেকটি কমন শত্রু ছিল ইন্ডিয়ান প্রভূত্ব। আগস্ট বিপ্লবের পর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ যেমন উৎখাত হয়, তেমনি দৃশ্যমানভাবে অবসান ঘটে ইন্ডিয়ান প্রভূত্বের। শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই আন্দোলনকারীরা ঢাকাসহ সারা দেশে শেখ মুজিবের মুর্তি ভেঙ্গে ফেলে এবং তার ছবি পদতলে পিষ্ট করে। ৫ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাড়ি গুড়িয়ে দেয় এবং সারা দেশে শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা এবং শেখ পরিবারের সাথে যুক্ত সকলের সব রকম চিহ্ন মুছে ফেলে। এই কাজটির বিরুদ্ধে ছদ্মবেশী কিছু আওয়ামী লীগার মৃদু প্রতিবাদ করলেও জনগণ তাতে কান দেয়নি। শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদির ছায়াতলে বসে ৫ ফেব্রুয়ারি যখন তার নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার খায়েশ প্রকাশ করেন, তখন সেই রাতে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাসভবনটি গুড়িয়ে দেয়।
এইসব জীবন বাজি রাখা দুঃসাহসিক ছাত্রনেতারা যে একটি রাজনৈতিক দল করবেন সেটি বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। সেই রাজনীতির আদর্শ ও লক্ষ্য কী হবে, সে সম্পর্কেও একটি ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল। সেই সব ধারণাই শব্দগুচ্ছ হয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া এ্যাভিনিয়ের বিশাল ছাত্র-জনতার সমাবেশে মানুষের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করেছে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দেন, পরবর্তীতে রাজনীতিতে প্রবেশ করলে ওরা অনেককেই ছাপিয়ে যান। ৯০ এ এরশাদ বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতও ছিল। কিন্তু বিএনপি সেই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়ায় ৯১ সালের নির্বাচনে সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়ে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জয়লাভ করে।
২৪ এর গণঅভ্যুত্থান যেসব ছাত্রনেতা লক্ষ লক্ষ জনতার মিছিলের পুরো ভাগে ছিলেন তারাই গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। নবগঠিত রাজনৈতিক দলের যেসব লক্ষ্য রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
(১) ২৪ এর বিপ্লবকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। (২) বাংলাদেশকে সেকেন্ড রিপাবলিক বা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র হিসেবে বিনির্মাণ করা। (৩) বর্তমানের ৭২ এর সংবিধান, যেটি মুজিববাদী সংবিধান হিসেবে বহুল পরিচিত, সেই সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনা। (৪) সংবিধান রচনার জন্য প্রথমে পার্লামেন্ট বা জাতীয় সংসদ নয়, একটি সংবিধান সভা বা গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। (৫) বজ্রের ধ্বনি কেড়ে নিয়ে আওয়াজ তোলা- ইনকিলাব জিন্দাবাদ। (৬) চিরদিনের জন্য ফ্যাসিবাদি স্বৈরতন্ত্র এবং একটি সংঘবদ্ধ আওয়ামী ক্ল্যানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুন্ঠন করে চোরতন্ত্র বা Kleptocracy এর অবসানের জন্য বুলন্দ আওয়াজ তোলা- দিল্লি না ঢাকা/ঢাকা ঢাকা। (৭) পরিবার তন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে মেধা ও যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার গঠন।
২৪ এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বা গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন একটি দিন বা মাসের ঘটনা নয়। এটা দেশে এক নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটিয়েছে। অভ্যুত্থান-পর্ব শেষে এখন সেই নতুন রাজনীতি শুরুর পথে বাংলাদেশ।