নাম রিপন! পেশায় একটি শাড়ির দোকানের কর্মচারী। ১২ সদস্যের পরিবারের ছয় সদস্যকেই হারিয়েছে এক রাতে রিপন। এ ঘটনা ২০১০ সালের ৩ জুন মধ্যরাতে পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল গোডাউন থেকে লাগা আগুনের।
স্বজন হারানো রিপন আজও একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফেরেন। পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় থাকা কেমিক্যাল গোডাউনের মালিক কে? কী নাম তার। আজও তার কোনো বিচার করা হয়েছে কি না।
শুক্রবার পুরান ঢাকার ৪৩ নবাব কাটরা এলাকায় পরিবারের নিহত সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন রিপন। দেখা যায়, পাঁচতলা সেই ভবনটি এখন ছয়তলা করা হয়েছে। ভবনটিতে বসবাস করছে মানুষ। বয়াবহ আগুনে মৃত্যু বরণকারী ১২৪ জনের স্মরণে ভবনটির দক্ষিণ-পূর্বকোণ ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ।
নীমতলী ট্রাজেডি উপলক্ষে স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনসহ রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নিহতদের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। আগুনের ঘটনায় জড়িত কেমিক্যাল গোডাউন মালিকের পরিচয় প্রকাশ ও জড়িতদের বিচার বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন স্বজন হারানো বাসিন্দারা।
প্রতি বছরের মতো এবারও রিপন এসেছেন হারানো স্বজনদের স্বরণে। ভাগ্যজোরে বেঁচে যাওয়া রিপন এখনও হাতড়ে বেড়ান স্বজনদের স্মৃতি। আবেগতাড়িত কণ্ঠে রিপন বলেন, আমার পরিবারের ছয়জন মারা যায় ওই আগুনে। তখন আমি রমনা ভবনে চাকরি করি। সন্ধ্যার সময় বাসায় আম নিয়ে আসি। বাসার সবাইকে আম খাওয়াইয়া আবার চলে গেছিলাম। তাই আমি বেঁচে গেছি।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে রিপন বলেন, দুপুর থেকে ঘটনাস্থলে রান্নাবান্না চলছিল। ভেতরে ছিল জেনারেটর। ওটা থেকে আগুনের শুরু হয়। বাইরে ছিল মোটরসাইকেল। পাশে বিস্কুটের কারখানা, ববাকরখানির দোকান ছিল। সব মিলিয়ে ভয়াবহ আগুন লাগে। আটটা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আজও অজানা গোডাউনের মালিকের পরিচয়। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রিপন বলেন, ১২ বছর হয়ে গেল, এখনও কেমিক্যাল গোডাউনের আসামি কে তার নামটা পর্যন্ত জানতে পারলাম না। এত বড় বড় আসামি ধরে সরকার, এই আসামি কেন ধরা হয় নাই? এখনো আশেপাশে কেমিকেলের গোডাউন আছে। কিন্তু কেন এগুলো এখনো থাকে? এখনো এই এলাকায় প্লাস্টিক, পলিথিনের কারখানা আছে।’
নিমতলী ট্রাজেডিতে একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন মো. মামুন। ১০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ছেলের নাম স্বাধীন। বেঁচে থাকলে ১৯ বছরের এক তরুণের বাবা হতেন মামুন। নিহতদের স্মরণে তৈরি স্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে এমনটাই ভাবছেন তিনি।
ছেলের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো মামুন বলেন, আমার ছেলে বেঁচে থাকতো প্রায় ২০ বছর বয়স হতো। জুয়ান হইতো। খারাপ লাগে, এক যুগ চলে গেল। কিন্তু আমরা বিচারটা এখনো পাইলাম না। ১২ বছরেও জানতে পারলাম না ওই কেমিক্যাল গোডাউনের মালিক কে ছিল। আমরা যদি জানতে পারতাম উনি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াইছে, তাহলে মনে শান্তি পাইতাম। ‘সরকার চাইলে সব হয়। প্রধানমন্ত্রী চাইলে যে কোন সময় বের করে ফেলতে পারেন ওই কেমিক্যাল গোডাউনের মালিক কে ছিল। দেখেন এই বাড়ি আগে ছিল পাঁচ তলা। এখন আবার নতুন করে এক তলা বানাইছে। কিন্তু আমার ছেলে মরার বিচার পাইলাম না।’
স্থানী বাসিন্দা ফরমান আলী বলেন, নীমতলীর ঘটনায় আমাদের অনেক দাবি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় দাবি হলো একটি প্রশ্নের উত্তর জানা। ১২ বছর হয়ে গেলো। কিন্তু আমরা জানতে পারলাম না কেমিক্যাল গোডাউন কার, কোন প্রতিষ্ঠানের গোডাউন ছিল। তার বর্তমান অবস্থা কী। এই ঘটনায় তার শাস্তি হয়েছে কি না। এই প্রশ্নের উত্তর আজও কেউ জানতে পারলো না। এই প্রশ্ন শুধু আমার না পুরো এলাকাবাসীর। গোডাউনের মালিক কে। এই ঘটনায় অনেকগুলো রহস্যের মধ্যে এটি একটি। কে এই ব্যক্তি।