।। আসাদ মিরণ।।
মূল: এদুয়ার্দো গালেয়ানো; বাংলা তর্জমা: আসাদ মিরণ
চুক্তি
যখন অষ্টাদশ শতাব্দি শুরু হলো, তখন প্রথমবারের মতো কোন বোর্বান রাজা (ফিলিপ) মাদ্রিদের সিংহাসনে বসলেন। মুকুট ধারণ করার সাথে সাথেই, পঞ্চম ফিলিপ একজন দাস ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেন। তিনি ফরাসী কোম্পানী ডি গিনি ও তাঁর চাচাতো ভাই, ফ্রান্সের রাজার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করলেন। চুক্তির মাধ্যমে, পরবর্তী দশ বছরে আমেরিকার স্প্যানিশ উপনিবেশগুলিতে আটচল্লিশ হাজার ক্রীতদাস বিক্রি করে প্রত্যেক রাজা ২৫ শতাংশ হারে লাভ পেয়েছিলেন। সেই সাথে এটাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, এই বাণিজ্য শুধুমাত্র ক্যাথলিক জাহাজে, ক্যাথলিক নাবিক ও ক্যাথলিক অধিনায়কদের দ্বারা পরিচালিত হবে। বারো বছর পর, রাজা ফিলিপ ইংলিশ সাউথ সি কোম্পানী ও ইংল্যান্ডের রাণির সাথে আরেকটি চুক্তি সম্পন্ন করেন। সেই চুক্তির মাধ্যমে, পরবর্তী ত্রিশ বছরে আমেরিকার স্প্যানিশ উপনিবেশগুলিতে এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার ক্রীতদাস বিক্রি করে প্রত্যেক রাজা ২৫ শতাংশ হারে লাভ পেয়েছিলেন। একই সাথে এটাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, কৃষ্ণাঙ্গদের অবশ্যই বৃদ্ধ অথবা ত্রুটিযুক্ত হওয়া যাবে না। তাদের অবশ্যই সবকটি দাঁত থাকতে হবে এবং জায়গায় স্পেনের রাজা ও ব্রিটিশ কোম্পানীর সীলমোহর বহন করতে হবে। মালিকরা পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করেছিলেন।
আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
বংশ পরম্পরায় দাসবৃত্তি নতুন কিছু না। গ্রীস ও রোমের আমল থেকেই এর প্রচলন ছিল। তবে রেনেসাঁর সাথে সাথে ইউরোপ সেখানে সুনির্দিষ্ট কিছু নতুনত্ব এনেছে। প্রথমতঃ আগে কখনই গায়ের রং দিয়ে দাসত্ব নির্ধারণ করা হয়নি। দ্বিতীয়তঃ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দিনের আলোয় আগে কখনই মানব-দেহের বেচা-কেনা হয়নি। ষোড়শ, সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দিতে আফ্রিকা দাস বিক্রি করে রাইফেল কিনেছিল, তারা সহিংসতার জন্য অস্ত্রের ব্যবসা করত। পরে, ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দিতে, আফ্রিকা বাইবেলের বিনিময়ে সোনা, হীরা, তামা, হাতির দাঁত, রাবার ও কফি সরবরাহ করেছিল: তারা স্বর্গের প্রতিশ্রুতির জন্য পৃথিবীর ধন-সম্পদের ব্যবসা করত।
পবিত্র জল
১৭৬১ সালে প্যারিসে আফ্রিকার ভয়াবহতার উৎস উদ্ঘাটন করে একটি মানচিত্র প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, বিরল মরুভূমির জল পান করতে একটি কুয়োর চারপাশে নানা ধরণের বন্য পশুরা ভিড় করেছে। তারা জলের কাছে পৌঁছানোর জন্য একে অপরের সাথে লড়াই করছিল। প্রচন্ড উত্তাপে আর তৃষ্ণায় উত্তেজিত প্রাণীরা আশেপাশে কি ঘটছিল বা কোন প্রজাতির প্রাণিরাই-বা আছে, সেদিকে নজর না দিয়েই একে অপরের পিঠে সওয়ার হয়েছিল। আর এ ধরণের ভেদ-বিচারশূন্য আন্তঃপ্রজনন পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দানবের জন্ম দিয়েছিল। আফ্রিকার সৌভাগ্য যে দাস ব্যবসার মাধ্যমে তারা এই জাহান্নাম থেকে মুক্তি পায়। খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা (ব্যাপ্টিজম) তাদের জন্য স্বর্গের দরজা উন্মুক্ত করে। ভ্যাটিকান এটা আগেই অনুমান করেছিল। ১৪৫৪ সালে পোপ নিকোলাস (পঞ্চম) কৃষ্ণাঙ্গদের ধর্মান্তরিত করতে না পারা পর্যন্ত পর্তুগালের রাজাকে দাস ব্যবসার অনুমোদন দিয়েছিলেন। কয়েক বছর পর, আরেক আজ্ঞাবাহক পোপ কলিক্সতাজ (তৃতীয়) প্রতিষ্ঠা করলেন, আফ্রিকা দখল করা ছিল খ্রিষ্টানদের ক্রুসেডের অংশ বিশেষ। সেই থেকে ভয়ের কারণে আফ্রিকার উপকূলের বেশীরভাগ অংশ আজও চলাচলের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা: সেখানে ফুটন্ত জলে জাহাজ-খেকো সর্পরা অপেক্ষা করে থাকে। আর আফ্রিকার ভূমিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সাদা নাবিকরা কালোতে পরিণত হয়। তবে পরবর্তী শতাব্দিগুলিতে, ইউরোপের প্রায় সকল রাজা কিংবা তাদের সকলেই ঐ সব অশুভ উপকূলভাগের ব্যাপ্তির সমান দুর্গ আর চৌকি স্থাপন করেছিলেন। সেখান থেকে, তাঁরা সর্বাধিক লাভজনক ব্যবসা পরিচালনা করেন। আর তাঁরা ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণের নিমিত্তে ক্রীতদাসদের শরীরে পবিত্র জল ছিটিয়ে দেন। চুক্তিতে আর হিসাবের খাতায় দাসদের “একক(পিচ)” অথবা “পণ্যদ্রব্য” হিসেবে উল্লেখ করা হত। যদিও ব্যাপ্টিজম ঐ সকল শূন্য দেহে প্রাণ স্থাপিত করেছিল।
নরখাদক ইউরোপ
ক্রীতদাসরা কাঁপতে কাঁপতে জাহাজে উঠল। তাঁরা মনে করছিল যে তাদেরকে খেয়ে ফেলা হবে। তাদের ধারণা খুব একটা ভুল ছিল না। সর্বোপরি, ক্রীতদাস ব্যবসা ছিল একটা মুখ যা আফ্রিকাকে গ্রাস করেছিল। অনেক আগে, আফ্রিকান রাজারা দাসদের ধরে একে-অপরের সাথে লড়াই করাতো। এর বেশী কিছু তারা জানত না। কিন্তু ইউরোপের রাজারা এই ব্যবসাটি আবিস্কার করার পর পরই মানুষ ধরা আর বিক্রি করা, অর্থনীতি ও বাকি সমস্ত কিছুর হয়ে ওঠে। তারপর থেকে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকা যুবকদের রক্তে রঞ্জিত হয়। এভাবে দেশটিকে শূন্য করে, ভবিতব্যকে সীলমোহর করে দেয়া হয়। মালি এখন বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। ষোড়শ শতাব্দিতে এটি ছিল সমৃদ্ধশালী ও সুসংস্কৃত একটি রাজ্য। টিমবুক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পচিঁশ হাজার শিক্ষার্থী ছিল। মরক্কোর সুলতান যখন মালি আক্রমন করেন, তখন তিনি যে হলুদ সোনার সন্ধান করছিলেন, তা খুঁজে পাননি। কেননা, খুব সামান্যই তখন অবশিষ্ট ছিল। তবে তিনি ইউরোপে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করার জন্য কালো সোনা খুঁজে পেয়েছিলেন। এতে তার লাভও বেশী হয়েছিল, তাঁর যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ডাক্তার, আইনবিদ, লেখক, সংগীতশিল্পী এবং ভাস্কর ছিলেন, তাদেরকে ক্রীতদাস বানিয়ে আমেরিকার ক্ষেত-বাগানের দিকে যাত্রা করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ত্রীতদাস যন্ত্রটি যুদ্ধ চেয়েছিল আর যুদ্ধের জন্য অস্ত্র দাবি করেছিল। যুদ্ধ অর্থনীতির কারণে আফ্রিকার রাজ্যগুলি বাইরে থেকে আসা সমস্ত জিনিসের উপর আরও বেশী নির্ভর করতে শুরু করে। ১৬৫৫ সালে হল্যান্ডে প্রকাশিত একটি ট্রেড-গাইড থেকে আফ্রিকার উপকূলে সর্বাধিক আকাঙ্ক্ষিত অস্ত্রের তালিকা পাওয়া যায়, সেই সাথে রঙ্গমঞ্চের প্রতিপালক রাজাদের প্রলুব্ধ করার জন্য সেরা নৈবেদ্যের তালিকাটিও পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায়, জিন অত্যন্ত মূল্যবান ছিল আর এক মুঠো মুরানো কাঁচের পুঁতির মূল্য ছিল সাতজন মানুষের সমান।
ফ্যাশন
দাস বিক্রি লাগামহীনভাবে আমদানীকৃত পণ্যের ধারা বইয়ে দেয়। যদিও আফ্রিকা ভালো মানের লোহা ও ইস্পাত উৎপাদন করত। ইউরোপের তরবারি অনেক দেশের রাজা-সম্রাট, রাজকর্মচারী ও ক্ষুদে রাজ্যের সামাজিক মর্যাদার প্রতীক ছিল। এইগুলি কালোরা সাদা কোম্পানীর কাছে বিক্রি করত। গাছের ছাল ও তুলার আশ দিয়ে তৈরী আফ্রিকার কাপড় নিয়েও একই ধরণের গল্প প্রচলিত আছে। ষোড়শ শতাব্দির শুরুতে পর্তুগীজ নাবিক দুয়ার্তে পাচেকো জানালেন, কঙ্গোর পাম-গাছের পাতা থেকে তৈরী বস্ত্র “মখমলের মতো নরম আর তা এত সুন্দর যে ইতালিতেও এ রকম ভালো বস্ত্র হয় না।” কিন্তু আমদানিকৃত বস্ত্রের দাম দ্বিগুণ হলেও সেখানে মর্যাদা নিহিত আছে। মূল্য পণ্যের মান নির্ধারণ করে। সস্তা ও সংখ্যায় অনেক হওয়ার কারণে, দাসদের কোন মূল্য ছিল না, যেখানে ব্যয়বহুল ও দুর্লভ বস্তুর প্রতি লালসা চিরকালের। আর যে জিনিসের ব্যবহার যত কম হয় ততই ভালো। নতুনত্ব আর মুগ্ধতা নিয়ে বিদেশ থেকে যা কিছু আসে তা নিয়ে গর্ব করা নিরর্থক। ফ্যাশনের পরিবর্তন হয়, আজ এইটা তো, আগামীকাল আরেকটা। তারপরে কি আসবে, কেউ তা জানেনা। এই ক্ষণস্থায়ী আড়ম্বর, ক্ষমতার প্রতীক, শাসককে শাসিতদের কাছ থেকে পৃথক করেছে। এখনকার মতো।
পাল তোলা খাঁচা
যে দাস ব্যবসায়ী স্বাধীনতাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন, তিনি তাঁর সেরা জাহাজ দুটির নাম রেখেছিলেন ভলতেয়ার আর রুশো। বেশ কিছু পাচারকারী তাদের জাহাজকে ধর্মীয় নাম দিয়ে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করেছিল: আত্মা, করুণা, নবী ডেভিড, যীশু, সেন্ট এ্যন্থনি, সেন্ট মিগুয়েল, সেন্ট জেমস, সেন্ট ফিলিপ, সেন্ট অ্যানা, আর আমাদের পবিত্র চিন্তার দেবী। বাকি সব পাচারকারীরা মানবতা, প্রকৃতি অথবা গার্লফ্রেন্ডদের প্রতি তাদের ভালোবাসার প্রমান রেখেছেন: আশা, সাম্য, বন্ধুত্ব, হিরো, ইন্দ্রধনু, পায়রা, নাইটিঙ্গেল, হামিং-বার্ড, আকাঙ্ক্ষা, মোহনীয় বেটি (এলিজাবেথের পরিচিত একটি রূপ), ছোট্ট পলি, ভালোবাসার সিসিলি, বিচক্ষণ হান্না । তাদের সবচেয়ে দ্রুতগামী জাহাজগুলিকে সাবঅর্ডিনেটর ও ভিজিল্যান্ট (অধস্তন ও প্রহরী) বলা হত। মানব-পণ্যবাহিত এই জাহাজগুলি সাইরেন বা আতশবাজি পুড়িয়ে বন্দরে তাদের আগমনী বার্তা দিত না। এটার দরকারও ছিল না। তাদের উপস্থিতির দুর্গন্ধ বহুদূর থেকেই অনুভূত হত। তাঁরা তাদের এই সব ভয়ংকর পণ্য জাহাজের গুদামে স্তুপাকারে রাখত। দাসদের দিন-রাত একসাথে এমনভাবে রাখা হতো যেন তারা কোন প্রকার নড়া-চড়া করতে না পারে। তাদেরকে শক্ত করে এমনভাবে বস্তাবন্দি করা হতো যেন জাহাজের জায়গা কোনভাবে নষ্ট না হতে পারে। তারা একজন অন্যজনের গায়ে প্রস্রাব-পায়খানা করে দিত। একে অপরের সাথে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত। এক ঘাড় থেকে আরেক ঘাড়ে, এক কব্জি থেকে আরেক কব্জিতে, এক গোড়ালি থেকে আরেক গোড়ালিতে, সকলকে লম্বা লোহার বেড়ি দিয়ে আটকে রাখা হত। সমুদ্র যাত্রায় অনেকেরই মৃত্যু হত। প্রতিদিন সকালে প্রহরীরা ঐ সব নষ্ট পণ্য জাহাজ থেকে জলে ছুড়ে দিত।