২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বরের হিসাবে তার বার্ষিক আয় ছিল পৌনে তিন লাখ টাকা। সম্পদ ছিল ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার। ব্যাংকে ঋণ ছিল প্রায় ১৩ লাখ টাকা। পাঁচ বছরের মধ্যেই যেন জাদুর চেরাগে বদলে যায় তার সবকিছু। আয় বাড়ে ১৪ গুণের বেশি। সাত বছরে বেড়েছে প্রায় ১৯ গুণ। পাঁচ বছরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা বেড়ে যায় সাড়ে ১২ গুণ। সাত বছরে তা ১৭ গুণ। সঙ্গে যুক্ত হয় অর্ধকোটি টাকা দামের গাড়ি, ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট ও প্লট। ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বরের এ হিসাবে সব ঋণও হয়ে যায় তার পরিশোধ।
ধনসম্পদে হঠাৎ ফুলে-ফেঁপে ওঠা এই ব্যক্তির নাম আয়েন উদ্দিন। তিনি রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ সদস্য। আওয়ামী লীগের মনোনীত এবং এখন তিনি জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। হিসাবের তথ্যগুলো তার নিজেরই দেওয়া। এর দুই বছরের মধ্যে তার আয় বাড়ে আরও দেড় গুণ। সম্পদ বাড়ে আরও সাড়ে চার গুণ। এর বাইরেও বিপুল সম্পদ রয়েছে তার। পাশাপাশি স্ত্রীও হয়েছেন বিপুল বিত্তের অধিকারী।
মানুষের শত শত বিঘা ফসলি জমি দখল করার অভিযোগ রয়েছে আয়েন উদ্দিনের বিরুদ্ধে। খোঁজ পাওয়া গেছে প্রায় ৩০০ বিঘা আয়তনের তিনটি পুকুরের। এলাকায় করেছেন সুদৃশ্য ভবন, যা জলসাঘর হিসেবে পরিচিত। সেখানে প্রায় প্রতিদিনই রাজাদের আদলে নারী, মদ ও জুয়ার আসর বসে বলে এলাকাবাসীর দাবি। এর পাশেই ‘পার্ক’ করার নামে শতাধিক বিঘা নিচু জমি মাটি ফেলে উঁচু করেছেন। রোপণ করেছেন নানা প্রজাতির গাছ।
সরেজমিন রাজশাহী-৩ আসনের মোহনপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে অনেক জমির মালিকের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, জোর করে দখল নেওয়ার পর কোনো কোনো জমির মালিককে রেজিস্ট্রির বিনিময়ে দিয়েছেন নামমাত্র টাকা। কাউকে টাকাপয়সা কিছুই দেননি। দেবেন বলে ঘোরাচ্ছেন বছরের পর বছর।
আয়েন উদ্দিন, সংসদ সদস্য, রাজশাহী – ৩
আয়েন উদ্দিন ২০১৩ সালে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় আয় দেখান কৃষি খাত থেকে ৫০ হাজার টাকা। ব্যবসা থেকে দুই লাখ ২৫ হাজার; পাশাপাশি চাকরি থেকে স্ত্রীর আয় দুই লাখ ২৮ হাজার টাকা। নিজের নগদ টাকা দুই লাখ এবং স্ত্রীর এক লাখ টাকা। নিজ নামে ব্যাংকে জমা ছিল চার লাখ টাকা। নিজের পাঁচ ভরি ও স্ত্রীর নামে ২০ ভরি স্বর্ণ দেখান। টিভি-ফ্রিজ ৬০ হাজার টাকা, খাট-আলমারি-শোকেস ৬০ হাজার টাকা। স্থাবর সম্পত্তি চার লাখ টাকার দুই বিঘা জমি, স্ত্রীর নামে ১২ লাখ টাকার ছয় কাঠা জমি। পৈতৃক যৌথবাড়িতে তখন তিনি বসবাস করতেন। প্রার্থীর নামে এক্সিম ব্যাংকে নিয়মিত ঋণ ও ব্যাংক গ্যারান্টি পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার ৯০৬ টাকা ৯১ পয়সা। ব্যাংক গ্যারান্টি ছিল দুই লাখ ৪২ হাজার ৮৫০ টাকা। তবে তার আয়কর নথিতে ঋণ দেখান এক্সিম ব্যাংকে ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৭৬৬ টাকা।
আয়েন উদ্দিন এমপি হন এবং এর পরেই পাল্টে যায় সবকিছু। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় তিনি কৃষি খাতে আয় দেখান ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। পাঁচ বছর আগের চেয়ে প্রায় সাড়ে ২৩ গুণ বেশি।
আয়েন উদ্দিনের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৩ সালে এমপি হওয়ার পর তিনি মাছের ব্যবসা শুরু করেন এবং প্রতিবছর মৎস্য খাতে তার আয় হয় ২০ লাখ টাকা। যদিও মৎস্য খামারের কোনো সংখ্যা বা জমির পরিমাণ তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেননি। এবার তিনি ব্যাংক আমানত দেখান এক লাখ ১৫ হাজার ৫০৬ টাকা। স্ত্রীর শিক্ষকতায় আয় দেখান সাত লাখ ২৭ হাজার ২৫০ টাকা। সংসদ সদস্য হিসেবে প্রাপ্ত সম্মানী দেখান ছয় লাখ ৬০ হাজার টাকা। নগদ টাকা দেখান তিন লাখ। স্ত্রীর নামে দেখান এক লাখ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা দেখান ৪৩ লাখ ৮২ হাজার ৯২২ টাকা। স্ত্রীর নামে দেখান চার লাখ ৭৯ হাজার ৬৯১ টাকা। সঞ্চয়পত্র আগেরবার না থাকলেও এবার তিনি সঞ্চয়পত্র দেখান ১৫ লাখ টাকার। জীবন বীমা দুই লাখ ১৯ হাজার ৩০০ টাকার। আগে কোনো যানবাহন না থাকলেও এবার যানবাহন বাবদ ৫০ লাখ ৭৫ হাজার ৮৬৫ টাকা দেখান। নিজের নামে দুই লাখ ও স্ত্রীর নামে চার লাখ টাকার স্বর্ণ দেখান। কৃষিজমি অপরিবর্তিত দেখান। তবে যৌথ মালিকানায় নতুন সম্পত্তি দেখান ১২ বিঘা পাঁচ শতক জমি। ঢাকায় সংসদ সদস্য হিসেবে বরাদ্দ তিন কাঠা জমির দাম দেখিয়েছেন ছয় লাখ টাকা। এ ছাড়া স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট দেখান ৩০ লাখ টাকা দামের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘আমার সম্পদ আগে থেকেই ছিল। আমার বাপদাদাও সম্পদশালী মানুষ ছিলেন। এমপি হওয়ার আগেই আমি ঠিকাদারি করতাম বিভিন্নজনের লাইসেন্স দিয়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য করেই সম্পদ হয়েছে। এমপি হওয়ার সঙ্গে সম্পদের সম্পর্ক নেই।’
শত শত বিঘা জমি দখল :বুধবার (১৬ মার্চ) সকাল ১১টা। ঘাসিগ্রাম ইউনিয়নের তুলসীক্ষেত্র। চারদিকে সবুজ ধানক্ষেত। শিব নদের বাঁধসংলগ্ন বিলকুমারী বিলের একপাশে একটি ঝকঝকে তিনতলা ভবন। স্থানীয়রা বলেন ‘জলসাঘর’। ভবনের সামনে যতদূর চোখ যায় দেখা যায় বিশাল দিঘি। স্থানীয়রা জানান, এই দিঘির আয়তন প্রায় ১০০ বিঘা। এর পাশেই অন্তত আরও ১০০ বিঘা জমি মাটি ভরাট করে রাখা। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। গ্রামবাসীকে সাংসদ আয়েন উদ্দিন জানিয়েছেন, এখানে একটি পার্ক করা হবে।
আরেকটু এগিয়ে গেলে মাইলের বিল ও ডাইং বিল। এখানে ২০০ বিঘা আয়তনের আরও দুটি দিঘির খোঁজ পাওয়া গেল আয়েন উদ্দিনের। তবে এসব কোনো জমিই আগে ছিল না তার। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রথমবার এমপি হওয়ার পরই আয়েন উদ্দিনের চোখ পড়ে এসব বিলে। আগে বর্ষায় এসব বিলের পানিতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন এ অঞ্চলের হাজার হাজার জেলে। কিন্তু আয়েন উদ্দিন সাংসদ হওয়ার পর বিলে আর কোনো জেলেকে নামতে দেন না। নিজেই মাছ চাষ করেন। তার বড় ভাই আজহারুল ইসলাম বাবলু, তার চাচাতো ভাই বিজয় ও অভয় বিলের মাছ চাষ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক বাসিন্দা জানান, এসব বিল বর্ষার আট মাস থাকে আয়েনের দখলে। পানি শুকালে জমির মালিক শুধু ধান চাষ করার সুযোগ পান।
২০১৮ সালে দ্বিতীয়বার এমপি হওয়ার পর এই বিলের জমিতে পুকুর ও পার্ক করার নামে দখল শুরু করেন আয়েন উদ্দিন। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, জমিগুলোতে পুকুর কাটা কিংবা পার্কের নামে মাটি ভরাটের আগে মালিকের সঙ্গে কোনো আলোচনা বা মূল্য নির্ধারণ করেননি আয়েন উদ্দিন। তিনি উপস্থিত থেকে ‘লাল নিশান’ টানিয়ে সীমানা নির্ধারণ করেন।
একজন বলেন, প্রাচীনকালে রাজারা ঘোড়া ছেড়ে দিত। যতদূর ঘোড়া যেত, ততদূর রাজার সীমানা হতো। এমপি আয়েন ঘোড়া ছাড়েননি, তিনি লাল নিশান টানিয়ে দেন। জমির মালিকদের কাউকে কিছু না জানিয়ে পুকুর করতে থাকেন। ঘাসিগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আফজাল হোসেন বকুলের নেতৃত্বে আয়েন উদ্দিনের বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছিলেন জমির মালিকরা। কোনো প্রতিকার পাননি তারা।
মহিষকুণ্ডির গ্রামের মুদি দোকানি অখিল চন্দ্র দাস বলেন, “আমার অনুমতি ছাড়াই ৪৮ শতক জমিতে পুকুর খনন করা হয়। জমি দিতে রাজি হইনি। তখন আমাকে বলা হয়েছে, অন্য জায়গায় আমাকে জমি দেবেন। দুই বছর ধরে জমি তার দখলে। আমাকে টাকাও দেননি, জমিও দেননি। এখন জমি ফেরত চাইতে গেলে আমাকে ধমক দেন। বলেন, ‘সামান্য জমি নিয়ে এত কথা বলিস কেন? দিয়ে দেব।’ দিচ্ছেন না। পুকুর খননের সময় ডিসি-এসপিকে অভিযোগ করেও কোনো ফল পাইনি।”
মোহনপুরের চক কৃষ্ণপুরের ৮০ বছরের আহমেদ আলী বলেন, “আমাদের ৮৬ শতক জমি এমপি হুমকি দিয়ে ১০ হাজার টাকা শতাংশ দর ধরে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন। এমপির লোকেরা বলে, ‘নিলে নিবি, না নিলে চলে যা।'”
চোখ মুছতে মুছতে আহমেদ আলী বলেন, ‘১৯২০ সালে দাদার নামে রেকর্ড ছিল জমিটা। খুব সুন্দর ধান হতো। এই ধানই বছর ধরে খেতাম। আমাদের না জানিয়েই পুকুর করে ফেলল। এমপির সঙ্গে কি আমরা পারব? বেকায়দায় পড়ে দিতে বাধ্য হলাম। জমিটার কথা মনে হলে খুব কষ্ট হয়।’
একই গ্রামের আবদুস সামাদ বলেন, “আমরা জমি দেব না, কিন্তু তারা চারপাশে পাড় বেঁধে পুকুর কেটে ফেলেছে। আমাদের জমি মাঝখানে। পুকুর কাটায় তো জমিতে যেতে পারব না। তখন এমপি বলেন, ‘জমিটা দিয়ে দাও। ১০ হাজার টাকা শতক দাম দেব।’ আমরা বলি, ১০ হাজার টাকা শতক জমি আছে? তখন তিনি বলেন, ‘না দিলে যাও।’ কোনো প্রতিবাদ করতে পারিনি। এমপি প্রভাবশালী মানুষ।”
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা আলবেরুনী ফারুক বলেন, ‘আমাকে না জানিয়ে আমাদের পাঁচ কাঠা জমিতে পুকুর খনন করেছেন আয়েন উদ্দিন। পরে জানতে পেরে অভিযোগ করেছিলাম। তিনি আমাদের কিছু টাকা দিতে চান। আমরা সেই টাকা নিইনি।’
ঘাসিগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য শেখ হাবিবা বলেন, ‘এলাকার মানুষের জমি দখল করাই এমপির প্রধান কাজ। তার বাবার পৈতৃক সম্পত্তি কয় বিঘা আছে? অধিকাংশ কৃষকের জমি জোর করে দখল করা হয়েছে। কয়েকজনকে কিছু টাকা দিয়েছে। যারা দুর্বল তাদের জমি জবরদখল করে নিয়েছে। এলাকার মানুষের শান্তি কেড়ে নিয়েছে আয়েন উদ্দিন ও তার লোকজন।’
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আফজাল হোসেন বকুল বলেন, ‘আয়েন উদ্দিন এমপি হয়ে তিনশ বিঘা আয়তনের তিনটি পুকুর কেটেছে। পুকুরের এসব জমি অধিকাংশই মানুষের কাছ থেকে দখল নিয়েছে। প্রায় দুই হাজার বিঘা আয়তনের বিলকুমারী, শুঁটকি বিল দখল করে বর্ষায় মাছ চাষ করে। ডুবির বিলেও একইভাবে মাছ চাষ করে। আর এলাকার জেলেরা বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছে।’
এসব বিষয়ে সাংসদ আয়েন উদ্দিনের ভাষ্য, ‘জমি দখলে নেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন। এখানে জমির সর্বোচ্চ দাম ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা শতাংশ। আমি ১০ হাজার টাকা শতক দর ধরে কিনেছি। কারও কাছে জোর করে জমি নিইনি। যারা বিক্রি করেছেন, তারা জমির ন্যায্য দাম পেয়েছেন। যারা লিজ দিয়েছেন, তারা বছরে বছরে লিজের টাকা পান। তিনতলা ভবনটি কফি হাউস করার জন্য করেছি। সেখানে মানুষ নামাজও পড়ে। নাচ-গান-জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগ ভিত্তিহীন।’ তিনি বলেন, ‘এখানে মৎস্য ও কৃষি পার্ক করব। বাচ্চাদের রাইড থাকবে।’ তবে এসব সম্পদের হিসাব আয়েন উদ্দিনের হলফনামা বা আয়কর বিবরণীতে নেই।
আছে কর ফাঁকি
আয়েন উদ্দিন ২০০৯-১০ সালে প্রথম আয়কর দেন। তখন নগদ টাকা দেখান দুই লাখ ৭৫ হাজার টাকা। মোট সম্পদ দেখান পাঁচ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এক্সিম ব্যাংকে তার ঋণ ছিল ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৭৬৬ টাকা।
বিভিন্ন স্থানে পুকুরসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে যেসব জমি কিনেছেন বলে আয়েন উদ্দিন স্বীকার করেছেন, সেসব জমি তিনি আয়কর বিভাগে প্রদর্শন করেননি। এ ছাড়া পৈতৃক ভিটায় প্রায় অর্ধকোটি টাকায় করেছেন নতুন দ্বিতল ভবন। এটাও আয়কর বিভাগকে দেখাননি। বিলকুমারী বিলে প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ‘জলসাঘর’খ্যাত তিনতলা ভবনটি আয়কর বিভাগকে দেখাননি। রাজশাহীর তেরখাদিয়া হাউজিংয়ে প্রায় ৩০ লাখ টাকায় তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্তের পাঁচ কাঠার প্লট কিনলেও তা আয়কর বিভাগে প্রদর্শন করেননি। ২০১৫ সালে ৫০ একর এবং ২০১৭ সালে ২৭ দশমিক ৮৯ একর জমি লিজ দেখালেও কোনো লিজমূল্য দেখাননি আয়কর বিভাগকে।
সরকরি শুল্ক্কমুক্ত অর্ধকোটি টাকার গাড়ির বাইরেও একটি নোয়া মডেলের মাইক্রোবাস ব্যবহার করেন আয়েন উদ্দিন। তবে তা তিনি আয়কর বিভাগকে দেখাননি।
২০২০ সালে আয়েন উদ্দিনের দাখিল করা আয়কর বিবরণীতে দেখা যায়, তিনি ২২ লাখ ৮২ হাজার ৮৯২ টাকা এমপি হিসেবে সম্মানী পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। ২০১৮ সালে তার এ সম্মানী দেখিয়েছিলেন ছয় লাখ ৬০ হাজার টাকা। মাত্র দুই বছরে তার সম্মানী প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেড়েছে উল্লেখ করেছেন।
এ ছাড়া আয়কর বিবরণীতে তিনি ওই বছর সঞ্চয়পত্রের সুদ হিসেবে এক লাখ ১০ হাজার ৪০০ টাকা পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। কৃষি খাত থেকে আট লাখ ৭০ হাজার টাকা আয় দেখিয়েছেন। মৎস্য খাত থেকে আয় দেখান ২০ লাখ টাকা। ২০২০ সালে তিনি তার মোট সম্পদ দেখিয়েছেন এক কোটি ৭২ লাখ ৯৮ হাজার ৩৪০ টাকার। এর মধ্যে নগদ টাকা রয়েছে ৯৩ লাখ ৯১ হাজার টাকা। ২০২১ সালে তিনি আয়কর রিটার্ন দাখিল করেননি।
এসব বিষয়ে আয়েন উদ্দিনের ভাষ্য, ‘আমার পৈতৃক বাড়ি এবং বিলকুমারী বিলের তিনতলা ভবনটি আয়কর বিভাগকে দেখানোর মতো সম্পদ নয়। যেসব সম্পদ দেখানোর মতো তার সবই দেখানো হয়েছে।’
‘তোরা শালা ক্রিমিনাল’
গত অক্টোবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় সাংসদ আয়েন উদ্দিনের একটি অডিও। এতে রায়ঘাটি ইউনিয়নের মনোনয়ন চাওয়ায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের উপজেলা সভাপতি সুরঞ্জিত সরকারকে তিনি বলেন, ‘তোরা জাইত হিন্দু, তোরা শালা ক্রিমিনাল।’ সুরঞ্জিতকে গালাগালিও করেন এমপি। সুরঞ্জিত সরকার অভিযোগ করেন, ২০১৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আয়েন উদ্দিনের ক্যাডাররা তাকে মারধর করে পঙ্গু করে দেয়। এ বিষয়ে আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘সুরঞ্জিতকে হিন্দুরাই মেরে পঙ্গু করেছে। আমার কোনো লোক তাকে মারধর করেনি।’ তিনি বলেন, ‘কথা বলার প্রেক্ষাপটে হিন্দুরা ক্রিমিনাল বলেছিলাম।’
দখল-সংস্কৃতি বাবার আমল থেকেই
আয়েন উদ্দিনের বাবার নাম হবিবর রহমান। এলাকায় পরিচিত হবির মণ্ডল হিসেবে। প্রভাষক মো. বাবলুর রহমানের লেখা ‘একাত্তরের মোহনপুর’ বইয়ে ঘাসিগ্রাম ইউনিয়নের মহিষকুণ্ডি গ্রামের শান্তি কমিটির তালিকায় হবির মণ্ডলের নাম ৩ নম্বরে রয়েছে। তার দুলাভাই আবদুস সালামের বাবা আবদুর রহমান মণ্ডলের নাম রয়েছে ৯ নম্বরে।
মোহনপুর হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি সুরঞ্জিত সরকার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মহিষকুণ্ডিতে রাজেশ্বর চন্দ্র সাহা নামের এক জমিদারের বসবাস ছিল। আয়েন উদ্দিনের বাবা ও তার দুলাভাই সালামের বাবা আবদুর রহমান মণ্ডল সেই হিন্দু জমিদারবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। পরে রাজেশ্বর ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নিলে তার বাড়ি ও জমি দখলে নেন হবির মণ্ডল ও আবদুর রহমান। দেশ স্বাধীনের পরে রাজেশ্বর এসে দেখেন, তার সব জমি দখল হয়ে গেছে। এসব জমি আয়েন উদ্দিনের পরিবারের দখলে রয়েছে।
মোহনপুর উপজেলার সাবেক এক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ‘আয়েন উদ্দিনের বাবা শান্তি কমিটির নেতা ছিলেন। ভারতে যাওয়ার আগে হবির মণ্ডলকে (হবিবুর রহমান) বলেছিলাম রাজাকার পদ থেকে পদত্যাগ করতে। পরে ভারত থেকে এসে শুনেছি যে তিনি পদত্যাগ করেননি; বরং লুটপাট করেছিলেন। এটা সর্বস্তরের মানুষ জানে।’
এ বিষয়ে সাংসদ আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘আমার বাবা ইউপি সদস্য ছিলেন। এ কারণে পাকিস্তানিরা এমনিতেই জোর করে শান্তি কমিটির সদস্য করেছিল।’ তার দাবি, ‘আমি এমপি হওয়ার পর একটি মহল আমাকে হেয় করতে বইটি লিখিয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘রাজেশ্বরের জমি আমরা কিনেছি। আমাদের মতো অনেকেই তার জমি কিনেছেন। দখলের অভিযোগ সত্য নয়।’