- এস আলমের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অনুসন্ধান চলবে না: আদালত
ঢাকা, বাংলাদেশ: গত বছর ৪ আগস্ট ইংরেজি দৈনিক “দ্য ডেইলি স্টারে” শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বাংলাদেশের আলোচিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম (এস আলম) এর অর্থপাচার সম্পর্কে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম (এস আলম) বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমোদন ছাড়াই সিঙ্গাপুরে কমপক্ষে এক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
প্রতিবেদক এক সাক্ষাতকারে জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছিলেন,”ওপেন সোর্সেই তার ওই বিনিয়োগের ডকুমেন্ট আছে। আমরা সেই ডকুমেন্টগুলো সংগ্রহ ও ভেরিফাই করে সত্যতা নিশ্চিত করেছি। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে তিনি বাংলাদেশ থেকে অনুমোদন নিয়ে কোনে অর্থ সিঙ্গাপুরের নেননি।” বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এপর্যন্ত বৈধভাবে এক লাখ সাত হাজার মার্কিন ডলার পাঠিয়েছে সিঙ্গাপুরে। তার মধ্যে এস আলমের মালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। গত এক দশকে এস আলম সিঙ্গাপুরে অন্তত দুইটি হোটেল, একটি বাণিজ্যিক স্পেস ও আরো কিছু সম্পদ কিনে কাগজপত্র থেকে তার নাম সরিয়ে ফেলেছেন। এস আলমের স্ত্রী ফারজানা পারভিনও এর সঙ্গে যুক্ত। তারা অফশোর কোম্পানির (কাগুজে কোম্পানি) মাধ্যমে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে অর্থ নিয়েছেন। সিঙ্গাপুর ছাড়াও সাইপ্রাস এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে বিনিয়োগ করেছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনেছেন। এস আলম আলমের এই অর্থপাচারের ব্যাপারে কথা বলেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এস আলমও কোনো বক্তব্য না দিয়ে উল্টো মামলার হুমকি দিয়েছেন। চার মাস ধরে এই প্রতিবেদনের তথ্য নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। এর তথ্য ভেরিফাই করার জন্য একটি টিম আমাকে সহায়তা করেছে।”
এস আলম গ্রুপের মালিকানায় বাংলাদেশে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও একাধিক ব্যাংক আছে। ইসলামী ব্যাংক তার একটি। ওই ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ একাই ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। গত ডিসেম্বরে এই তথ্য প্রকাশ হলে হাইকোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এর নথি চায় এবং দুদককে তদন্ত করতে বলে। এর আগে দুইটি ভুয়া কোম্পানি খুলে একই ব্যাংক থেকে দুই হাজার ৪৬০ কোটি টাকা নেয়া হয় ঋণের নামে। আর আরো কয়েকটি ব্যাংক থেকে নেয়া হয় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে নেয়া হয় ৯ হাজার কোটি টাকা।
এই প্রতিবেদনটি যুক্ত করে ৬ আগস্ট একজন আইনজীবি বিষয়টি আদালতের দৃষ্টিতে আনেন। পরে আদালত এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি অর্থপাচার রোধে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না-এই মর্মে রুল জারি করেন। এছাড়া পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে মানি লন্ডারিং রোধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা বা ব্যর্থতা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত হবে না, অভিযোগ অনুসন্ধানে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না এবং এই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে।
তবে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে গ্রুপটির মালিক সাইফুল আলম ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন লিভ টু আপিল করেন। শুনানি শেষে ২৩ আগস্ট চেম্বার জজ বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছেন, তার ওপর ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থিতাবস্থা জারি করেন। ৮ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে শুনানি হয়। আপিল বিভাগ এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য ৫ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছিলেন। একইসঙ্গে স্থিতাবস্থার মেয়াদও একইদিন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার এস আলম গ্রুপের বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয় অনুসন্ধানে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছিলেন তা খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। সাইফুল আলম এবং তার স্ত্রীর করা লিভ টু আপিলের শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত ৬ সদস্যের আপিল বিভাগীয় বেঞ্চ এ আদেশ দেন। সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়, হাইকোর্ট বিভাগের ইস্যু করা সুয়োমটো রুল ডিসচার্জড (খারিজ) করা হলো। যা–ই হোক এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট(বিএফআইইউ) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বাধা হবে না। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে এস আলম ও তাঁর স্ত্রী ফারজানা পারভীনের করা আবেদন (লিভ টু আপিল) নিষ্পত্তি করে এ আদেশ দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার আশির্বাদপুষ্ট ব্যবসায়ীদের অন্যতম এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলম মাসুদ এবং তাঁর স্ত্রীর হাজার কোটি টাকা পাচার ছিল গত বছরের আলোচিত ঘটনা। শেখ হাসিনা, এস আলম, সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ও ওবায়দুল হাসানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা দেশের সচেতন নাগরিকদের কারো অজানা না। পাবনা জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের প্রাক্তন সভাপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু জেলা জজ হিসেবে দলের পারপাস সার্ভ করে অবসরে গেলে শেখ হাসিনা তাকে পুরস্কারস্বরুপ দুর্নীতি দমন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন। ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এখানে দায়িত্বে থাকাকালে বিশ্বব্যাংকের পদ্মাসেতু সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, তিনি অভিযোগটি মিথ্যা ও অন্তঃসারশূন্য বলে উড়িয়ে দেন। এর পুরস্কারস্বরুপ শেখ হাসিনা এস আলম গ্রুপের মাধ্যমে এস আলম গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান জেডএমসি বিল্ডার্স এর প্রতিনিধি হিসেবে তাকে ইসলামি ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দেন। সফলভাবে ইসলামি ব্যাংক লুটপাট শেষ হলে তিনি তাকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দেন। শেখ হাসিনার পরামর্শেই রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ওবায়দুল হাসানকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন।
জানা যায়, ডিজিএফআই ডিজি মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা এস আলমের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীন ব্যাংক খেকো এস আলমের থেকে পয়সা নিয়ে হাসিনা-রেহানার কাঁছে পৌঁছে দিতে দিতে নিজের কাছেও কিছু রেখে দিতেন। এভাবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা নিজ ও স্ত্রী ক্যামেলিয়ার ব্যাংক একাউন্টে রাখতে যেয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে আর্মি থেকে কোনো মতে অবসর নিয়ে আমেরিকায় পালিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন! এছাড়া ২০১৮ এর নৈশ নির্বাচনে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের সাথে মিলেমিশেও নির্বাচনের জন্য আর্মিকে যে টাকা দেওয়া হয়েছিল তা থেকেও নিজের ফরচুন গড়েন। বর্তমানে ইনভেস্টর ভিসা ক্যাটেগরিতে আমেরিকার অ্যাশবার্ন, ভার্জিনিয়ার মত দামি জায়গায় দামি বাড়িঘর কিনে তিনি স্ত্রীসহ বসবাস করছেন। ওয়াশিংটন ডিসিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের সামরিক এটাশের সরকারি গাড়ি নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে তিনি ব্যবহার করছেন।